গত বছরের ১৫ নভেম্বর চীনের উদ্যোগে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৫টি দেশ নিয়ে রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। অনেকের মতে, এই চুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থা বা জোট গঠন করা হয়েছে। কারণ, বিশ্ব ব্যাংকের ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, আরসিইপি’র সদস্য দেশের সংখ্যা ১৫। এখানকার মোট জনসংখ্যা ২,২৬২ মিলিয়ন, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৯ ভাগ। মোট জিডিপির পরিমাণ ২৫.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গ্লোবাল জিডিপির ২৯ ভাগ। এছাড়া মোট রপ্তানির পরিমাণ ৫.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের মোট রপ্তানির ২৮ ভাগ।
Advertisement
বাণিজ্য জোট বা চুক্তি তো আরো আছে। তাহলে আরসিইপি তার সদস্য দেশগুলোর মুক্ত বাণিজ্যে কিভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে, সেটাই চুক্তির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আরসিইপি এর চুক্তি কার্যকর হওয়ার পরবর্তী ২০ বছরে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে আমদানিকৃত পণ্যের উপর শতকরা ৯২ ভাগ পর্যন্ত ট্যারিফ কমানো হবে। সেবা খাতে কমপক্ষে ৬৫ ভাগ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ( অন্যান্য সদস্যদের জন্য প্রযোজ্য) জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। তথ্য প্রবাহের জন্য ক্রস-বর্ডার রুলস চালু করে ডিজিটাল বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ কমিয়ে আনা হবে। সদস্য দেশগুলোকে উৎসাহিত করা হবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অপ্রয়োজনীয় বিরোধ যেমন কোটা বা লাইসেন্সের মাধ্যমে বাণিজ্যে বিধিনিষেধ না দেওয়ার জন্য।
আরসিইপি'র সদস্য দেশগুলো যখন উপরের সুবিধাগুলো পাবে, স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে তুলনামূলক কম খরচে কার্যকর ব্যাকওয়ার্ড এবং ফরওয়ার্ড সাপ্লাইচেইন গড়ে উঠবে। অনেক কম সময়ে এবং কম খরচে কাঁচামাল সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। ফলশ্রুতিতে উৎপাদন খরচ কম হবে। উৎপাদন খরচ যখন কমে যাবে, স্বাভাবিকভাবেই পণ্যের বিক্রয় মূল্য বা রপ্তানি মূল্য কমে যাবে। এর ফলে, আমদানিকারক পূর্বের তুলনায় কম মূল্যে পণ্য আমদানি করতে পারবে এবং আমদানি ব্যয় কম হবে। এতে করে, রপ্তানিকারী দেশের মোট পণ্য রপ্তানির পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে। অর্থাৎ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সদস্য দেশগুলো অন্য প্রতিযোগীদের থেকে কম মূল্যে পণ্য রপ্তানি করে নতুন বাজার দখল করবে এবং অধিক রপ্তানির মাধ্যমে বাড়তি বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে সক্ষম হবে।
আরসিইপি'র সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে, বড় বড় বিনিয়োগকারী দেশ যেমন চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া তাদের জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে যেমন কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামে বেশি বিনিয়োগ করবে। এতে করে ঐ সকল দেশের বিনিয়োগ অন্যান্য দেশে কমে যেতে পারে।
Advertisement
এর ফলে, আরসিইপি'র সদস্য দেশগুলো অন্যদের থেকে কি প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পেতে পার? উদাহরণ হিসেবে আমাদের দেশের কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন দৃশ্যমান। অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে এগিয়ে চলেছে। যে কারণে বাংলাদেশ ২০১৮ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে।
মনে রাখা প্রয়োজন, একই সময়ে লাওস ও মিয়ানমার উভয়ই স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। তারা ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। আমরাও তাই। এর পরের তিন বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাবে। কিন্তু তারপর এই সুবিধা থাকবে না।
বাংলাদেশকে শুল্ক সুবিধা ছাড়াই তখন বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতা করতে হবে। অপরদিকে লাওস, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া আরসিইপি চুক্তির আওতায় ট্যারিফ সুবিধা পাবে। পোশাক খাতে আমাদের অন্যতম প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনামের কথা ভুলে গেলেও চলবে না, কারণ ভিয়েতনামও ইতোমধ্যে বৃহৎ এই বাণিজ্যিক জোটের সাথে চুক্তি করে ফেলেছে।
বাংলাদেশ এলডিসি দেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে, এখনো শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাচ্ছে। যে কারণে এখনই অর্থাৎ স্বল্পমেয়াদে বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতিযোগী দেশসমূহ নিয়ে উদ্বিগ্ন না হলেও চলবে। কিন্তু ২০২৭ এর পর আমাদের যখন শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা থাকবে না কিংবা আমাদের মত অন্য দেশের যদি একই অবস্থা হয় , তখন ভিয়েতনাম, লাওস কিন্তু আরসিইপি’র সদস্য হবার কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পাবে । তাই দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা করে বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় রাখা উচিত ।
Advertisement
লেখক : অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ।
এইচআর/এমএস