ইসলাম শান্তির ধর্ম। কোনোভাবে জিহাদের নামে জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না ইসলাম। তাই দেশে ইসলামকে পুঁজি করে যেন জঙ্গিবাদী তৎপরতা আর না হয়, মানুষকে সচেতন করতে আসছে একটি ‘কমন’ ফতোয়া। বাংলাদেশের এক লাখ ইমাম, ওলামা-মাশায়েখ একযোগে সমর্থন দিয়ে এই ফতোয়া দেবেন।বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দফতরে ওলামা মাশায়েখদের নিয়ে ‘ইসলামের দৃষ্টিতে জঙ্গিবাদ : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় এ সিদ্ধান্তের কথা ব্যক্ত করেন দেশের প্রখ্যাত আলেম-ওলামাগণ।পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হকের সভাপতিত্বে পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সের সম্মেলন কক্ষে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুরব্যাপী এ মত বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।ওলামায়ে কেরামরা বলেন, জঙ্গিবাদ ইসলাম পরিপন্থী। জঙ্গিরা পথ ভ্রষ্ট। তাদের মদদদাতারা বিদেশি, বিধর্মী এবং ইসলাম ধর্মের প্রকাশ্য শত্রু। ইসলামে জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। পবিত্র কুরআন, হাদিস এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) এঁর জীবনীর আলোকে তারা জঙ্গিবাদ বিরোধী পুস্তক প্রণয়ন করবেন। সেটা সারাদেশে মসজিদ, মাদরাসা, ওয়াজ-মাহফিলে তুলে ধরা হবে। ইসলাম ধর্মের কথা বলে যারা জঙ্গিবাদ করছে- তাদের বিরুদ্ধে একযোগে রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন আলেম ওলামাগণ।শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের ঈমাম ও জমিয়াতুল উলামাহ এর চেয়ারম্যান মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুউদ বলেন, যারা ইসলামের নামে জঙ্গি তৎপরতা চালাচ্ছে তারা ইসলামের দূশমন, মুসলমানদের দুশমন। তারা ইসলামের যে ক্ষতি করছে তা আবু যাহেলও করতে পারেনি। তারা বিকৃত চেতনার মানুষ।জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আলেমদের সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এখন চুপ করে থাকার সময় নেই। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলা ঈমানি দায়িত্ব। নিজেদের আত্মরক্ষার জন্যও প্রয়োজন। নইলে তারা হুর-পরি পাওয়ার জন্য আপনাদের গলায়ও ছুরি ধরতে পারে। ওলামা-মাশায়েখদের বয়ান ও ওয়াজ মাহফিলে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে।মাওলানা মাসউদ বলেন, সারা দেশে প্রায় তিন লাখ ইমাম আছেন। আরো তিন লাখ মুয়াজ্জিন আছেন। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এক লাখ ইমামের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি ফতোয়া বের করে তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। তিনি এ বিষয়ে পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন।মুফতি আব্দুল কাইয়ুম খান বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম। মানুষের কাছে ইসলামের সত্যিকার আদর্শ তুলে ধরতে হবে।মাওলানা আব্দুল হক বলেন, ইসলাম সন্ত্রাস, মানুষ হত্যা, মানুষের জানমালের ক্ষতি করা সমর্থন করে না। মানুষকে সত্য পথে চলা, সৎ কাজ করার পরামর্শ দিতে হবে। তিনি প্রত্যেক জেলায় আলেম-ওলামাদের নিয়ে এ ধরনের সভা করার পরামর্শ দেন।মাওলানা কাজী ফজলুল করিম বলেন, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও অপরাধ এ তিনটি ভিন্ন জিনিস। ইসলাম কখনো জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দেয় না। ওলামা-মাশায়েখগণ যেন সরকারের প্রতিপক্ষ না হয় সেজন্য সকলকে পরমত সহিষ্ণু হতে হবে।মাওলানা আরিফ উদ্দিন মারুফ বলেন, ইসলাম হলো চেতনা তৈরির ধর্ম। ইসলামের প্রতি মানুষের মানসিকতা তৈরি করতে হবে। তিনি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয়, জেলা ও থানা পর্যায়ে কমিটি গঠনের পরামর্শ দেন। তিনি মানুষের মানসিকতা গঠনে লেখালেখি করার জন্য ওলামা-মাশায়েখদের প্রতি আহ্বান জানান।হযরত মাওলানা ইমদাদুল্লাহ কাসেমি বলেন, হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর হাদিসসমূহ ঘাটলে একবিন্দু রক্তের সন্ধানও পাওয়া যাবে না। ইসলাম শান্তির ধর্ম, এখানে রক্তপাতের কোনো স্থান নেই।হযরত মাওলানা তাজুল ইসলাম কাসেমি বলেন, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চলছে তার সাথে আলেম-ওলামাদের কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট করার জন্য একটি গোষ্ঠী চক্রান্ত করছে।উত্তরাস্থ জামে আতুস সাহাবাহ এর প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল শাইখুল হাদিস ঢাকা হযরত মাওলানা রুহুল আমীন খান উজানী বলেন, যে জঙ্গিবাদের উসকানি দেয় সে সত্যিকারের মুসলমান নয়। জঙ্গিবাদের মূল উৎপাটনের জন্য সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে।সভাপতির বক্তব্যে আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলেন, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আলেম ওলামা মাশায়েখগণই বিভ্রান্তির হাত থেকে তরুণদেরকে সুপথে পরিচালিত করতে পারেন। যারা বিপথগামী হয়েছে তাদের বিভ্রান্তি দূর করতে পারেন। আর বিভ্রান্ত করার জন্য যারা প্ররোচিত করছে ইসলামের প্রকৃত মর্মবাণী তুলে ধরে তাদের প্ররোচনা প্রতিহত করতে পারেন।তিনি বলেন, ইসলাম ধর্ম নিয়ে একেকজন একেক ধরনের কথা বললে মানুষ বিভ্রান্ত হবে। ইসলামের ব্যাখ্যা একই রকম হতে হবে। শহীদ হবার লোভে যে সব যুবক সন্ত্রাসে লিপ্ত হচ্ছে তাদেরকে সঠিক পথে আনতে হবে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ফসল হচ্ছে আইএস বলেও উল্লেখ করেন আইজিপি।তিনি আরো বলেন, আমরা কোনো মসজিদ-মাদরাসায় খবরদারি করি না, গোয়েন্দা দিতেও চাই না। মসজিদে জুমার খুতবার পূর্বে বয়ানে, ওয়াজ-মাহফিলে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য আলেম-ওলামাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।স্পেশাল ব্রাঞ্চের অতিরিক্ত আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, আলেমরা ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সজাগ করতে পারেন। আমরা এক সঙ্গে হাজার কণ্ঠে মানুষকে বোঝালেও বুঝবে কিনা সন্দেহ। তবে একজন মাওলানাই লাখো মানুষকে বোঝাতে সক্ষম যে ইসলাম জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না। জঙ্গিবাদ মূলোৎপাটনে ৮৮ শতাংশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন ওলামায়ে কেরামগণ।অতিরিক্ত আইজিপি (অ্যাডমিন অ্যান্ড অপস্) মো. মোখলেসুর রহমান বলেন, মুসলমানদেরকে নিয়ে নানা চক্রান্ত চলছে। মুসলমানের নামে মুসলমানদেরকে হত্যা করে ইসলামের ভাবমূর্তি ধ্বংস করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ঐক্যবদ্ধভাবে এ চক্রান্ত, জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করতে হবে।পুলিশ হেডকোর্টার্সের এআইজি (গোপনীয়) মো. মনিরুজ্জামানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, অতিরিক্ত আইজিপি মো. মঈনুর রহমান চৌধুরী, অতিরিক্ত আইজিপি (অর্থ) আবুল কাশেম, ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়াসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ।অন্যদিকে বিশিষ্ট ওয়ায়েজ ও মহাখালীস্থ আইপিএস জামে মসজিদের খতিব মাওলানা দেলোয়ার হুসাইন সাইফী, চট্টগ্রামের হযরত মাওলানা যাকারিয়া নো’মান ফয়েজী, প্রিন্সিপ্যাল, দিনাজপুরের হযরত মাওলানা আইয়ূব আনসারী, পূর্ব নাখালপাড়ার সিএন্ডবি জামে মসজিদের খতিব হযরত মওলানা যাইনুল আবেদীন, সাতক্ষীরার হযরত মওলানা হাবীবুর রহমান খান, ঢাকার হযরত মাওলানা শোআইব আহমদ, খুলনার হযরত মাওলানা নাসীরুদ্দীন কাসেমী, ইক্বরা’র (বাংলাদেশ) প্রধান সমন্বয়ক মাওলানা সদরুদ্দীন মাকনুন, শাইখুল হাদীস (মোমেন শাহী) হযরত মাওলানা আব্দুল হক।জেইউ/এসএইচএস/পিআর
Advertisement