ইতিহাস বলে, কাবুল বেতাল হতে মৌসুম লাগে না। তেমন কারণও লাগে না। আজতক সেই বেতাল-উতালের ফয়সালা হয়নি। হয়ও না। ঘটনার পর আফগানরা সবাই সবাইকে দোষে। নানা জাতে-উপজাতে বাগড়া করে। তদ্দিনে আবার ডান-বামে বেতাল হয়। রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান, তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্য যার-যার হিসাব কষে নেয়। উদ্ভট-উৎকটে সময় চলে যায় আফগানদের। আগেরটা তেমন মনে রাখে না। তাল খুঁজে পায় না তারা। এবারও তেমন ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ তালহীন নয়। এখানে তাল বড় পরিচিত শব্দ। তালের নানা অর্থ। গান-সুর- লয়ের সঙ্গে তাল বেশ পরিচিত বাংলায়। ফল হিসেবে তো আছেই।
Advertisement
দলের এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকিতে একটি ব্যতিক্রম সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বজ্রপাত রুখতে দেশের চার জেলায় ৭ হাজার ২০০ তালের চারা রোপণের সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত এরইমধ্যে কার্যকর শুরু হয়েছে ঢাকার কেরানীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, পাবনা ও সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়। দলীয়ভাবে সিদ্ধান্তটি নতুন হলেও প্রধানমন্ত্রীর এ সংক্রান্ত নির্দেশ আরো ৩-৪ বছর আগের। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় তিনি গ্রামীণ রাস্তার দুই পাশে তালগাছের চারা রোপণের নির্দেশ দিয়েছেন ২০১৭ সালে।
সেই নির্দেশ মতো ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় কাজ শুরুও করেছিল। কিন্তু ফলো আপ? ফলো আপ বড় করুণ-নির্মম। দেখভালের অভাবে ‘নাই’ হয়ে গেছে লাগানো চারাগুলো। কোথাও কোথাও চিহ্নও নেই। ‘নাই’ হয়ে কোথায় গেছে এগুলো?- জবাব মিলছে না। বিভিন্ন জায়গায় বিচিসহ তালের চারা চলে গরু-ছাগলের পেটে। কার গরু-কার ছাগলের পেটে গেছে সেই তথ্যও নেই। কাবিখা-টিআর প্রকল্পের আওতায় লাখ দশেক তালগাছের চারা-আঁটি লাগানোর পেছনে প্রায় শতকোটি টাকার হিসাব অজানাই থাকছে। আবহমানকাল ধরে বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত হয়ে আসছে। এসব ভয়াবহ দুর্যোগের মধ্যে রয়েছে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, কালবৈশাখী ঝড়, টর্নোডো, নদীভাঙন, উপকূলভাঙন, খরা, শৈত্যপ্রবাহ প্রভৃতি।
এছাড়া সিসমিক জোন অর্থাৎ ইউরেশিয়ান প্লেট, ইন্ডিয়ান প্লেট ও বার্মা প্লেটের মাঝামাঝি অবস্থানে থাকার কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। রয়েছে, পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন একটি বাস্তবতা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ও তীব্রতা দিন দিন শুধু বাড়ছে। এবার গত ক’দিনের বজ্রপাত ও মৃত্যুসংখ্যা বাজে শঙ্কা দিচ্ছে। আবহাওয়া ও পরিবেশ বিপর্যয়ের জেরে দেশে বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়বে, এমন আভাস দেয়া হচ্ছিল অনেক দিন থেকেই। সেটা ফলেছে গত এপ্রিল থেকে।
Advertisement
দক্ষিণ এশিয়ার বজ্রপাতের বেশি প্রবণতার দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ১৬৪ জনের। এই হিসাবে দেশে গড়ে প্রতি বছর মৃত্যুসংখ্যা ২১৬। এতো বজ্রপাতের মূল কারণ আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান। বাংলাদেশের একদিকে বঙ্গোপসাগর, এরপরই ভারত মহাসাগর। সেখান থেকে গরম আর আর্দ্র বাতাস আসছে। আবার উত্তরে পাহাড়ি এলাকা। কিছু দূরেই হিমালয়। সেখথান থেকে ঢুকছে ঠান্ডা বাতাস। এই দুই বাতাসের যোগফলে বজ্রপাত। বজ্রপাত নিয়ে কাজ করা গবেষকরা বলছেন, এর পেছনেও রয়েছে প্রকৃতির গতিতে বাধা দেয়ার জের। আবহাওয়াবিদ বা বিশেষজ্ঞদের কাছে বজ্রপাত ঠেকানোর দাওয়াই নেই। আছে সতর্কতার নির্দেশনা। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- বজ্রঝড়ের সময় ঘরের বাইরে না যাওয়া, জরুরি দরকারে বের হলে পায়ে রাবারের জুতা পরা, বজ্রপাতের সময় ধানক্ষেত বা খোলামাঠে থাকলে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙুল দিয়ে নিচু হয়ে বসে পড়া, বজ্রপাতের শঙ্কা দেখা দিলে দ্রুত ভবন বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নেয়া, ভবনের ছাদ বা উঁচু ভূমিতে না যাওয়া, গাড়ির ভেতর থাকলে গাড়ির ধাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ না রাখা ইত্যাদি।
রডের কাজ বাঁশে সারানো গেলেও বজ্রপাত রুখতে তালগাছই লাগবে। বজ্রনিরোধক ফ্রাঙ্কলিন্স লাইটনিং রডের কথা ভাবা হলৈও ফল ভালো আসেনি। তালগাছে পরিশ্রম ও ঐক্যের প্রতীক বাবুই পাখির ঝুলন্ত মনোরম বাসা রাজনীতি, অর্থনীতি, গণতন্ত্রসহ কতো কিছুর উপমা। অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য তালগাছের মাথায় বাস করা কানাবগির ছায়ের তুলনাও আমাদের যাপিত জীবনে কম নয়। তালগাছের ওই বগীটা পানতা ভাত চায় না। পুঁটি মাছও খায় না। ফল হিসেবে তাল এখন অন্তঃসারশূন্য ইতিহাস হলেও বজ্র ও ঝড় মোকাবেলায় গাছটির আবেদন সর্বকালেই। বাঙালি দর্শন ও সংস্কৃতিতে তালগাছের মতো ব্যবহার আর কোনো গাছের নেই। অথচ তালগাছ সচরাচর কেউ লাগাতে চান না। লাগালেও যত্ন-আত্তির কেউ থাকে না। তবে, ডাঙর হওয়ার পর গাছটা হয়ে যায় এজমালি সম্পদ। তখন তালের হকদার আশপাশের সবাই। মওকা মতো নিজের মনে করে চুপচাপে তালটা নিয়ে সোজা ঘরে চলে যায়। উল্টা বাস্তবতাও আছে। পজিশনঅলা গিরস্থের তালগাছের আশপাশেও ঘেঁষার মুরদ হয় না কারো। এমনকি তার বাড়ির পাশে তাল পড়লে তা কুড়িয়ে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আস্থা হাছিলের প্রতিযোগিতায় নামে অপজিশনের বহু খাদেমও। গুচ্ছমূলী বৃহৎ অশাখা এই বৃক্ষটি হায়াত পায় দেড়শ বছর পর্যন্ত। রোগ-বালাইও কম। বাড়েও বুঝে-শুনে, ধীরে, শিনা টান করে। তালগাছের চরিত্র-বৈশিষ্টে কোনো গোলমাল নেই। কারো পক্ষে-বিপক্ষে যায় না। সাইকাস প্রজাতির শক্ত মেরুদণ্ডী এ উদ্ভিদটি হয় পুরুষ, নইলে স্ত্রী। মোটেই উভলিঙ্গ হয় না।
তালের চারা পাওয়া কঠিন। নার্সারি বা বন বিভাগ এই চারা করে না। তাদের কাছে তালের আঁটি রয়েছে। এ অবস্থার মধ্যেও ক্ষমতাসীন দল ছয় হাজারের মতো তালের চারা সংগ্রহ করেছে বলে জানা গেছে। বজ্রপাতের এই রাঙা চাহনির মধ্যে ভালো খবর দিয়েছে ঢাকাঘেঁষা গাজীপুরের ইকবাল সিদ্দিকী কলেজ। কলেজটির শিক্ষার্থীরা গত সপ্তায় ৪৫০টি তাল বীজ লাগিয়েছে ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের নয়নপুর-বহেরাতলী-পিঙ্গাইল সড়কের পাশে। তাদের টার্গেট ২০২১টি তাল গাছ লাগানোর। তালকে কিলিয়ে পাকানো যায় না। যথানিয়মে পাকার পর আপনি ঝরে পড়ে যথাসময়েই। তালের আঁশ এবং ছালবাকলার ইউটিলিটিও অনেক। কষ্টসহিষ্ণু ও শাখা-প্রশাখা না থাকায় আশপাশের জমির ফসলের ক্ষতি করে না। শক্ত মজবুত গভীরমূলী বলে ঝড়-তুফান, টর্নেডো, বাতাস প্রতিরোধ ও মাটি ক্ষয় রোধে তালের গাছের ভূমিকা অতুলনীয়। তাল কাঠ পোকায় খায় না। পোকামাকড়রা তালকাঠে বসারও সাহস পায় না। তালগাছ বজ্রপাতের আক্রমণ রুখতে পারে এমন একটি বৈজ্ঞানিক তত্ব প্রচলিত আছে গাঁও গেরামে। অধিকাংশ মানুষ তালগাছ লাগিয়ে এর ফল খেয়ে যেতে পারেন না। তার ফল-সুফল নেয় পরবর্তী প্রজন্ম। আবার বেশিরভাগ মানুষ মধ্য কিংবা শেষ বয়সে এসে তালগাছ লাগাতে পছন্দ করেন। যে কারণে জীবদ্দশায় তালগাছ মারা যাওয়ার ঘটনা কেউ কোনোদিন দেখেননি।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
Advertisement
এইচআর/এএসএম