রাসুলে পাকের ভালোবাসাই প্রকৃত ঈমানদার হওয়ার পূর্বশর্ত। যা বাস্তবে প্রমাণ দিয়েছিলেন সাহাবায়ে কেরাম। তাদের দেখানো ভালোবাসাই মুসলিম উম্মাহর অনুপ্রেরণা। বিশ্বনবির প্রতি ভালোবাসা সম্পর্কে কোরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট দিকনির্দেশাও রয়েছে। হাদিসে পাকে এসেছে-
Advertisement
‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার বাবা-মা, সন্তান-সন্ততি ও সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় না হবো।’ (বুখারি)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি গভীর ভালোবাসা না থাকলে কোনোভাবেই তার প্রতি পরিপূর্ণ ও খাঁটি আনুগত্য, তাঁর আদব-আখলাকের অনুসরণ, শরিয়তের নীতি ও বিধানকে প্রবৃত্তির চাহিদা ও সামাজিক রুসম-রেওয়াজের উপর প্রাধান্য দেওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ তাআলা কোরআনে পাকে ঘোষণা করেন-
قُلْ اِنْ كَانَ اٰبَآؤُكُمْ وَ اَبْنَآؤُكُمْ وَ اِخْوَانُكُمْ وَ اَزْوَاجُكُمْ وَ عَشِیْرَتُكُمْ وَ اَمْوَالُ ِ۟اقْتَرَفْتُمُوْهَا وَ تِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَ مَسٰكِنُ تَرْضَوْنَهَاۤ اَحَبَّ اِلَیْكُمْ مِّنَ اللّٰهِ وَ رَسُوْلِهٖ وَ جِهَادٍ فِیْ سَبِیْلِهٖ فَتَرَبَّصُوْا حَتّٰی یَاْتِیَ اللّٰهُ بِاَمْرِهٖ ؕ وَ اللّٰهُ لَا یَهْدِی الْقَوْمَ الْفٰسِقِیْنَ.
Advertisement
বল, তোমাদের কাছে যদি আল্লাহ, তাঁর রাসুল এবং তাঁর পথে জিহাদ করা অপেক্ষা বেশি প্রিয় হয় তোমাদের বাবা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের খান্দান, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের সেই ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশঙ্কা কর এবং তোমাদের বাসস্থান, যা তোমরা ভালবাস; তবে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আল্লাহ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না।’ (সুরা তাওবাহ : আয়াত ২৪)
কোরআন-সুন্নাহর এ ঘোষণায় বিজয়ী হয়েছেন সাহাবায়ে কেরাম। তাদের মধ্যে অন্যতম যারা, তাদের প্রথম হলেন-
১. হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন তাঁর কাছে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয়। তিনি নিজের জীবন ও সুস্থতার চেয়েও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন ও সুস্থতাকে অগ্রগণ্য মনে করতেন। নিষ্ঠুর উতবা ইবনে রবিয়ার কর্তৃক মারাত্মক যখমের সময় এর প্রমাণ মেলে।
Advertisement
একবার নিষ্ঠুর উতবা ইবনে রবিয়া হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু মুখমন্ডল আঘাতে আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করে দেয়। তাঁর বুকের উপর ওঠে বসে নিদারুণ নির্যাতন করেছিল। যখন তাঁর গোত্রের লোকেরা তাকে উদ্ধার করে, তখন সবার আশংকা ছিল সে মারা যাবে। সুস্থ হয়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না।
অজ্ঞান অবস্থায় দিনশেষ তার হুঁশ ফিরে পায়। জ্ঞান ফিরে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার আগে তার মুখ থেকে যে জিজ্ঞাসা বের হয়েছিল, তাহলো- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিরাপদ আছেন তো?
তাঁর গোত্রের লোকেরা তাকে আশ্বস্ত করার পরও তিনি নিশ্চিত হতে পারলেন না, তিনি কসম করে বললেন-
فَإِنّ لِلهِ عَلَيّ أَنْ لَا أَذُوقَ طَعَامًا وَلَا أَشْرَبَ شَرَابًا أَوْ أَتَى رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ.
‘আল্লাহর কসম! আমি ততক্ষণ পর্যন্ত দানাপানি স্পর্শ করবো না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাঁর সান্নিধ্য ও দর্শন পাবো!’ (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া)
২. আনসারি নারী সাহাবির ভালোবাসা
ওহুদের যুদ্ধে দিনার গোত্রের এক নারী সাহাবির স্বামী, ভাই ও বাবা এ তিনজনই শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেছিলেন। বিশ্বনবির জন্য নিজের বাবা, ভাই ও স্বামীর মৃত্যুতে এ নারী সাহাবি দুঃখিত হননি। তাঁকে এদের শাহাদাতের সংবাদ দেওয়া হলে তিনি বলে ওঠেন- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খবর কী?
সাহাবিরা উত্তর দেন, ‘হে উম্মে ফুলান, তুমি যেমন চাচ্ছ তিনি তেমনই আছেন অর্থাৎ তিনি বেঁচে আছেন। নারি (সাহাবি) বললেন, আমি তাঁকে এক নজর দেখতে চাই। তাঁকে এক নজর দেখার ব্যবস্থা আমাকে করে দিন। সাহাবিরা ইঙ্গিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখিয়ে দিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখে নিজের বাবা, ভাই ও স্বামী মৃত্যুতেও তিনি বলে ওঠলেন-
كُلّ مُصِيبَةٍ بَعْدَكَ جَلَلٌ!
(আল্লাহর রাসূল!) আপনি যখন নিরাপদ আছেন তো সব মুসিবত আমার কাছে তুচ্ছ অর্থাৎ ‘আপনাকে পেলে সব বিপদই নগণ্য।’ (দালাইলুন নুবুয়াহ, বাইহাকি, সীরাতে ইবনে হিশাম)
৩. হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই
বাবার চেয়ে বিশ্বনবিকে ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছেন মুনাফিক সরদার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই-এর ছেলে আব্দুল্লাহ। তিনি তাঁর বাবাকে বিশ্বনবির ওপর কোনোভাবে মর্যাদা দেয়নি। বিশ্বনবির প্রতি সাহাবায়ে কেরামের অকৃত্রিম ও অগাধ ভালোবাসা প্রকাশের একটি অনন্য ঘটনা এটি-
মুনাফিক সরদার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইর ছেলে হজরত আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু তার বাবাকে বলতে শুনেছিলেন যে, ‘আমরা মদিনায় ফেরার পর সম্মানিত লোকেরা তুচ্ছ লোকদেরকে বের করে দেব।’ এ কথা শুনেই সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ তার বাবা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে প্রতিরোধে তরবারি হাতে নিয়ে মদীনার দরজায় দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন- ‘তোমরাই এমন কথা বলেছিলে যে- ‘মদিনা থেকে সম্মানিত লোকেরা তুচ্ছ লোকদের বের করে দেবে’?
তবে এখনই তা প্রমাণ হয়ে যাবে যে- ‘সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত কি তোমরা, না রাসুলুল্লাহ!’
তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত মদিনার ছায়ায় প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ না রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাদের মদিনায় প্রবেশের অনুমতি দেন। এরপর সত্যি সত্যিই তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুমতির আগ পর্যন্ত হজরত আব্দুল্লাহ তার মুনাফিক বাবাকে মদিনায় প্রবেশ করতে দেয়নি।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি সাহাবায়ে কেরামের এই অকৃত্রিম ও অগাধ ভালোবাসা থাকার কারণেই তারা ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে সক্ষম হয়েছেন। স্বজন, সহায়-সম্ভব ও ভিটেবাড়ি ছেড়ে হিজরত করতে পেরেছিলেন। ইসলামের যুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করতে পেরেছিলেন। যে ভালোবাসার কারণে সাহাবায়ে কেরাম বদরের যুদ্ধের সময় বলতে পেরেছিলেন-
إن أمرنا تبع لأمرك، فو الله لئن سرت حتى تبلغ البرك من غمدان لنسيرنّ معك، والله لو استعرضت بنا هذا البحر لخضناه معك.
‘(হে রাসুল!) আমাদের সব বিষয় আপনার হুকুমের অধীন। আল্লাহর কসম! আপনি যদি সুদূর বারক গামদান পর্যন্তও ভ্রমণ করেন আমরা আপনার সঙ্গেই থাকবো। আল্লাহর কসম! আপনি যদি আদেশ করেন তাহলে এই সমুদ্রেও আমরা আপনার সঙ্গে ঝাঁপ দেবো।’
এই সবকিছুর মূলেই ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মর্যাদা, মহাত্ম ও ভালোবাসার উপলব্ধি। যে নির্দেশনা এসেছে কোরআন-হাদিসের দিকনির্দেশনায়।
মনে রাখতে হবে
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লামের ভালোবাসাই হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর প্রাণসঞ্জিবনী প্রেরণা; যা আশ্চর্য শক্তি ও উদ্যমের উৎস হিসেবে এবং ইতিহাসের বিস্ময়কর কীর্তি ও ঘটনাবলির জন্য অতীতেও প্রসিদ্ধ ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে ইনশা আল্লাহ।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশ্বনবির আদর্শ অনুসরণ ও অনুকরণের তাওফিক দান করুন। সাহাবায়ে কেরামের দেখানো পথে কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা পালনে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার প্রমাণ দেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জিকেএস