সম্প্রতি আমরা লক্ষ্য করেছি তালেবানদের হাত থেকে রক্ষা পেতে আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে পালানোর প্রাণপণ চেষ্টার দৃশ্য। তালেবানদের হাত থেকে বাঁচার জন্য জীবন বাজি রেখে প্লেনে উঠার দৃশ্যই সবাইকে বুঝিয়ে দেয় মানুষ কতটা ভীত। বিমানের ভিতরে প্রবেশ করতে না পেরে বিমানের চাকার সঙ্গে নিজেকে বেঁধে নেন কেউ কেউ। বিমানের দৌড় শুরু হতেই রানওয়ে ধরে ছুটতে শুরুও করেছেন অনেকে।
Advertisement
মনে হচ্ছে এ যেন আমাদের দেশের সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ঈদ যাত্রীদের লঞ্চে উঠার শক্তির লড়াই। বিমান আকাশে উঠতেই চাকা থেকে ঝুলছিলেন যাঁরা, টুপটাপ করে খসে পড়লেন। কয়েকশো ফুট উপর থেকে পড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল দেহ। একটু ভেবে দেখুন, তালেবানদের কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ কতটাই না ভীতসন্ত্রস্ত হলে বিমানের চাকায় অবস্থান নিয়ে হলেও দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে।
অথচ প্রেম-প্রীতি, সৌহার্দ্য আর শান্তি ও সম্প্রীতির এক পরিমণ্ডল বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত করাই ইসলামের মূল লক্ষ্য। এই শান্তিপ্রিয় ইসলামের ভয়েই আজ শঙ্কিত। ইসলামের নাম নিলে অবশ্য এযুগে স্বাভাবিক ভাবেই ভয়ভীতিকর এক চিত্র ফুটে ওঠে। ভীত শঙ্কিত হয়ে পড়ে যারা, এ দোষ আসলে তাদের নয়। দুর্ভাগ্যক্রমে তথাকথিত কিছু ইসলামি দল এবং তাদের সহযোগী অন্যান্যরা ইসলামকে এমনভাবে কালিমাযুক্ত করেছে, যেন এটা এক বর্বর ও চরমপন্থী, মারমুখী ধর্ম, নাউযুবিল্লাহ। ইসলামের নাম শুনলেই তরবারীর ঝন ঝনানী, বোমাবাজি আর আত্মঘাতি হামলার এক ছাপ মানুষের হৃদয়পটে ভেসে ওঠে।
অথচ ইসলামের এই আকর্ষণীয় শিক্ষার প্রচার ও প্রসার জোর-জবরদস্তি এবং বল প্রয়োগে নয় বরং সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির দ্বারা মানুষের হৃদয় জয় করার মাধ্যমে। বল প্রয়োগ করলে অন্যের অধিকার যেমন দেয়া যায় না, তেমনি আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভও এর দ্বারা সম্ভব নয়। কোনক্রমেই এ ধারণার উদ্রেক করা ঠিক হবে না যে, ইসলাম প্রচারে তরবারী প্রয়োগের নির্দেশ রয়েছে। ধর্ম বিশ্বাসের বিস্তার ঘটাতে নিশ্চিত ভাবেই তরবারী ব্যবহৃত হয়নি। শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য এটি ব্যবহৃত হয়েছিল, এটাই সত্য ঈমানের বিষয়ে বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে অবশ্যই এটি অর্থাৎ তরবারী কখনও ব্যবহৃত হয়নি। কারণ, ঈমানী বিষয়গুলো তো মানব হৃদয়ের সাথে সম্পর্কিত। ধর্মের টানে নিজেকে উৎসর্গ করতে হয়। মক্কার প্রথম তের বছর মুসলমানদের জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। এমনকি, মদিনায় হিজরত করার পরও শত্রুরা তাদের ওপর চড়াও হলে সম্পূর্ণ অসজ্জিত অবস্থায় থেকেও তাদেরকে ফিরতি যুদ্ধ করতে হয়েছে। চাপ প্রয়োগে মুসলমান হলে কেউ কী এমন কোরবানি করতে পারে?
Advertisement
অনেকে এই প্রশ্নও করে থাকে যে, ইসলাম অর্থ যদি শান্তিই হয়ে থাকে, তবে মুসলমানরা যুদ্ধ করেছে কেন? মুসলমানরা যুদ্ধ করার প্রথম উদ্দেশ্য ছিল আত্মরক্ষা করা। শত্রুরা সর্বদা উত্ত্যক্ত করেছে, করেছে আগ্রাসী আক্রমণ, আর মুসলমানরা আত্মরক্ষা করতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল-নিরস্ত্র মুসলমানদেরকে যখন অবলীলায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন অহেতুক এই রক্তপাত ঠেকাতে এবং নির্মম নিষ্ঠুরতার শাস্তি দিতে যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
আরবদের রীতি ছিল এটা, আর শান্তি বজায় রাখতে এর অবশ্য প্রয়োজনও ছিল এবং সে ধারা আজও সর্বত্র স্বীকৃত। তৃতীয়ত, যুদ্ধ করা হলে তা করা হবে বিরোধীদের দুর্বল করতে, কেননা তারা একত্রিত হচ্ছে মুসলমানদেরকে নির্মূল করতে, শুধু এ কারণে যে, তারা এক আল্লাহর ইবাদত করে। এ অবস্থায় যুদ্ধ করা না হলে কাফিররা একজন মুসলমানকেও বাঁচতে দিত না। আল্লাহতায়ালা যথার্থই বলেছেন, ‘ঠেকানো না হলে তারা মঠ, মন্দির, গির্জা, সিনেগগ এবং মসজিদগুলোকে ধূলিস্যাৎ করবে আর নির্মম নিষ্ঠুরতা ক্রমেই বেড়ে চলবে।’
তবে এটা ঠিক যে, মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে যুদ্ধের প্রয়োজন কখনও ছিল না। ইতিহাস এই সাক্ষ্যই বহন করছে যে, মুসলমানরা কোন যুদ্ধে জড়িয়ে গেলেও কোন একজনকেও মুসলমান হতে কখনও বাধ্য করা হয়নি। প্রত্যেক ব্যক্তিরই ইবাদতের স্বাধীনতা আছে। যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে মহানবী (সা.) সুনির্দিষ্ট করে বলে দিতেন যে, ‘বয়োবৃদ্ধদের, নারীদের এবং শিশুদের অনিষ্ট করবে না, আর উপসনালয়ের ক্ষতি সাধন করবে না।’ এমনকি বৃক্ষরাজি পর্যন্ত তিনি কর্তন করতে নিষেধ করেছেন।
মুসলমান দেশগুলোতে খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা যাতে তাদের অধিকার সঠিকভাবে ভোগ করতে পারে, সেজন্য অমুসলমানদের থেকে ‘জিজিয়া’ অর্থাৎ ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি কর’ নেয়া হতো। আর কারও যদি তা দেয়ার সামর্থ্য না থাকতো, তবে তা আদায় করা থেকে তাকে অব্যাহতিও দেয়া হতো।
Advertisement
ইসলামে মুসলমান ও অমুসলমানের সম-অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ইসলাম শত্রুদের সাথেও দয়ার্দ্র আচরণ করে, তা শান্তিকালীন সময়েই হোক বা যুদ্ধাবস্থায়ই হোক। সর্বাবস্থায় ইসলাম অমুসলমানদের অধিকার মর্যাদার সাথে সংরক্ষণ করে। ইসলাম একটি যুদ্ধংদেহী ধর্ম-এটি অপবাদ ও সর্বৈব-মিথ্যা। বাস্তবতা হলো, কী পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছিল, যখন সর্বশক্তিমান আল্লাহ মুসলমানদেরকে যুদ্ধের অনুমতি দিলেন? মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে তোমরা আল্লাহর পথে তাদের সাথে যুদ্ধ কর এবং সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯০)। বিদ্বেষ ছড়ানো ও আক্রমণের অধিকার ইসলামে নেই। চড়াও হওয়া বা আক্রমণ করার অধিকার ইসলামে নেই। ইসলামের বাস্তব শিক্ষা হলো, কেবল আক্রান্ত হলেই তুমি যুদ্ধ করতে পার। অধিকন্তু, এখানে এ নির্দেশও রয়েছে যে, আক্রমণকারী বা আগ্রাসী হয়ো না, চুক্তি ভঙ্গকারী হয়ো না।
আগ্রাসন বলতে কী বুঝায়? সে যুগে ইসলাম বিরোধীরা পরাজিত-সৈন্যদের দেহ ছিন্ন-ভিন্ন করে বিকৃত করতো, এটা সমর-নীতির পরিপন্থী, জিঘাংসা মূলক অত্যন্ত গর্হিত এক কর্ম। ইসলামে এটি নিষিদ্ধ। শিশু ও নারীদের হত্যা করাও নিষিদ্ধ। ধর্মীয় নেতাদের পাদ্রী-পুরোহিত, রাব্বী, প্রমুখদেরকে তাদের উপসনালয়ে হত্যা করা সম্পূর্ণ অবৈধ। অন্য কথায়, যুদ্ধ কেবলমাত্র সমরক্ষেত্রেই সংঘটিত হতে পারে। অথবা অন্য কোন বিকল্প খুঁজে না পেয়ে যদি শহর বা নগরে যুদ্ধ করতে বাধ্যও হতে হয়, তবুও কেবল তাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করা যেতে পারে, যারা বিরোধিতায় আগ বাড়িয়ে অস্ত্র ধারণ করে আক্রমণ চালিয়েছে।
আমরা আজ এটাই দেখছি যে, সুন্দর-সাবলীল ও সুগঠিত এই সব ইসলামী শিক্ষার ওপর কোন দলই আমল করছে না। আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীরা শিশু, নারী, বৃদ্ধ, নির্বিশেষে সবাইকে হত্যা করছে, অপরদিকে, আগ্রাসী-বাহিনী, শহর-নগর-বন্দরে বোমা বর্ষণ করছে, গুলি চালাচ্ছে, করছে অতর্কিত- আক্রমণ। তারা নগরগুলোতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে নগর অবকাঠামো সমূলে বিনাশ করছে। এতে নাগরিক অধিকারের কিছুই আর অবশিষ্ট থাকছে না।
প্রতিটি বৃহৎ শক্তিই এখন পারমাণবিক বিপুল অস্ত্র-সম্ভারের অধিকারী, এমনকী দরিদ্র দেশগুলো পর্যন্ত অস্ত্রসম্ভার মজুত করণের এই দৌড়ে শামিল হচ্ছে। মানবজাতি একেবারে ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে গেছে, যেখানে কী-না পবিত্র কোরআন আমাদেরকে নিরপরাধ, নিরীহদের কোন ক্ষতি না করার শিক্ষা দেয়, সেখানে পারমাণবিক-বোমার বিস্ফোরণ তাৎক্ষণিকভাবে জান মালের বিপুল ক্ষতি সাধন করা ছাড়াও শারীরিক প্রতিবন্ধীতা ঘটায়, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলতেই থাকে। সুতরাং এটা তো হত্যা করার চেয়েও জঘন্যতর অপরাধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমা ব্যবহৃত হওয়ার পর মানুষ ভেবেছিল বিশ্ব এমন এক মারাত্মক মারণাস্ত্র বানানো থেকে হয়তো বিরতই থাকবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো-সেসব অস্ত্রের প্রাণ সংহারী ক্ষমতা বাড়াতে তারা আরও এগিয়ে গেছে। আর নিশ্চিতভাবেই বিশ্ব সামগ্রিক ধ্বংসলীলা সাধনকারী মারণাস্ত্রের উন্নত-সংস্করণ উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে অস্ত্র-প্রতিযোগিতার দৌড়ে ছুটেই চলছে।
আসলে ‘ইসলাম’ এর প্রকৃত চেহারা বিকৃত করছে কতিপয় সন্ত্রাসী-দল, তাদের সেসব কার্যকলাপ ইসলামের শিক্ষার সম্পূর্ণ পরিপন্থী, যদিও তারা ধর্মযুদ্ধের নামে হত্যাযজ্ঞ চালাতে পবিত্র কোরআনের সমর্থনের ধোয়া তুলে থাকে। কিন্তু তারা জিহাদের সাথে অখণ্ডরূপে একাত্ম যেসব শর্তাবলী রয়েছে, সে বিষয়টি একেবারেই ভুলে যায়। এছাড়া আত্মঘাতি-হামলা চালানো পবিত্র কোরআন সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর ফলে বেসামরিক জনগণের জানমালের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়। সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে যুদ্ধের অনুমতি থাকলেও তা নির্ধারণের দায়িত্ব দেশীয়-সরকারের।
কতিপয় সংস্থা, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি বিশেষের নয়। আফগানিস্তানে বা অন্যান্য দেশে বর্তমান ধর্মের নামে যা হচ্ছে তা মূলত জিহাদ নয় বরং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। আরেকটি বিষয় আমাদেরকে মাথায় রাখতে হবে, আমাদের অনেকের ধারণা তালেবানরা কেবল আফগানিস্তানেই জন্ম নেয়। এমনটি যারা মনে করছেন তারা সম্পূর্ণ ভুল করছেন। কেননা তালেবান কোন বিশেষ দেশের নাগরিকত্বের নাম নয়। এটি এক বীভৎস মন-মানসিকতার নাম। যে কোন দেশেই মানুষের মগজধোলাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তালেবানের জন্ম হতে পারে। তাই কোনভাবেই যেন ধর্মের নামে আমাদের দেশে কেউ নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা করতে না পারে সে বিষয়ে আমাদের সবার অনেক বেশি সচেতন থাকতে হবে।
এইচআর/এএসএম