মতামত

চাই ঘুষের প্রতি সামাজিক ঘৃণা

যথাযথভাবে শুরু করার বহুমাস পেরিয়ে যাওয়া স্বত্ত্বেও একটি নামকরা সরকারি অফিসে আমার একটি জরুরি কাজ যেন শেষ হচ্ছিল না। নিজে বার বার যেতে লজ্জা হতো। তাই ফোনে কাজটার অগ্রগতি জেনে নিতাম। কিন্তু সেদিন সকালের গল্পটা এরকম: ফোন করতেই ওপারের কণ্ঠে বলা হলো কাজটা হয়েছে এবং ওটা তো স্যার ডেলিভারি হয়ে গেছে। বললাম- ‘কবে, কে ডেলিভারি নিয়েছে? ক’ দিন আগেই তো আরো কয়েক মাস লাগবে বলে নতুন ডেলিভারি তারিখ বসিয়ে সিল মেরে দিলেন!’ কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর ওপারের কণ্ঠ বলল, ”আমি নিজে কার্ডটা তুলে পকেটে রেখেছি- কাউকে পাঠিয়ে দিন, একটু পরে এসে আমার নিকট থেকে নিয়ে যাবে।” অবাক করা কথা- যা গত প্রায় এক বছরেও করা সম্ভব হয়নি, আজ কাজটা শেষ করে নিজের কাছে তুলে রেখেছেন? ব্যাপারটা কি? সেদিন আমার নিজ অফিসে অনেক ব্যস্ততা ছিল। সবুজ চায়ের কাপটা হাতে নিতেই টেবিলে রাখা একটি পত্রিকার শিরোনাম চোখে পড়লো। লেখা আছে-‘অফিসে টেবিল পেতে ঘুষ নিচ্ছে, ওরা কারা’? আগ্রহ সহকারে সংবাদটি পড়লাম। মনে হলো- এই সংবাদটি আজ ‘ওরা’ পড়েছে। তাই পুরাতন ফেলে রাখা কাজ, যা অবৈধ আয়ের উৎস হিসেবে ফাইলে আটকে রেখেছিল তা নিজেরা ডেলিভারি দেখিয়ে ক্লিয়ার করে রেখেছে! আমার কাজটা তাই বিনা ঘুষে হয়ে গেল!

Advertisement

মনে পড়লো, যেদিন প্রথম ঐ অফিসে গিয়েছিলাম, দু’ তিনজন লোক দৌড়ে এসে জানতে চেয়েছিল আমার কি প্রয়োজন। তারা বলেছিল তারা কাজটি দ্রুত করে দেবে, তার জন্য কিছু বকশিশ্ দিতে হবে। ‘সাহায্য লাগবে না’- আমার অনড় অবস্থা দেখে তারা হয়তো ভেবেছিল- ‘দেখি ঘুষ না দিয়ে কিভাবে কাজ করায়!’ আমিও ওনাদের কাজ পর্যবেক্ষণ করছিলাম। তাই সেদিন বলেছিলাম নতুন ডেলিভারি তারিখ বসিয়ে দিন। আমার কৌতুহল ছিল- দেখি একটি ছোট কাজ তারা কত মাসে শেষ করে। ঘুষ না দিলে একটি ডেলিভারি স্লিপে কতবার নতুন তারিখ বসিয়ে সিল মেরে দেয়ার অন্যায় নজির সৃষ্টি করে! ইচ্ছে করে সেখানে আমি নিজে গেলেও আমার পরিচয় দিইনি। সরকারি জরুরি কাজের দায়িত্বে থাকা একশ্রেণির লোকজনের স্বভাব-চরিত্র কতটা নিচে নেমে গেছে আজ তা ওপেন সিক্রেট।

এ কথাগুলো আজ আমার লেখার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু ‘মারুজান প্লাজা (ছদ্মনাম) গুলশান লেকের জন্য বিষফোঁড়া’- সেদিন টিভিতে এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার মুখে একথা শুনে এ লেখাটি লিখতে শুরু করলাম। পান্থপথের অবৈধ র্যাংগস ভবন সরানো হয়েছে। বিজিএমই ভবন অবৈধ হিসেবে আইনের নজরে এসেছে সরানোর। কিন্তু কূটনৈতিক পাড়ার এতবড় একটা বিষয়- এটা এতদিন পরে নজরে এলো কেন? মারুজান প্লাজা নামক বিষফোঁড়াটি কিভাবে জন্মলাভের সুযোগ পেল? কে লালন করলো? কোন কোন বড় বড় মহারথী-রাঘব বোয়ালরা সরকারি জমিতে এ গগণচুম্বি অট্টালিকা তৈরি করার সুযোগ পেল? তা এখন দেখার বিষয়। রা

জউকের অনেক পিওন ও কর্মচারীদের ঢাকায় চার-পাঁচটি বড় বড় ভবনের মালিক হবার নজির আছে যদিও সেখানকার বড় কর্তাদের মাঝে কে কয়টির মালিক হয়েছেন তার পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই। তা না হলে সরকারি লেকের জমিতে (?) বিষফোঁড়া নির্মাণের কে অনুমতি দিল আর কে ই বা প্লান পাস করলো? জনগণের জানার কৌতুহল কে মেটাবে?

Advertisement

একজন ডাকসাইটে নেতা সদর্পে জনসমক্ষে ঘোষণা দিলেন- এদেশে ঘুষ ছাড়া কোন চাকুরি নেই। কেউ ঘুষ ছাড়া চাকুরি পেয়ে থাকলে তাকে সংবর্ধনা দেয়া হবে। তিনি চাকুরি পেতে গিয়ে হেনস্তা হবার চরম বাস্তবতার কথাই বলেছেন। বহু বছর আগে থেকেই চাকুরি পেতে নির্দিষ্ট তদবিরের মাধ্যমে তৈরিকৃত তালিকার মধ্যে আগে ঢুকতে না পারলে তার চাকুরি পাবার সম্ভাবনা নেই। শুধু সংবাদের শিরোনামে বলা বলেই নয়। বাস্তবতা হলো, “ঘুষ দিলেই চাকুরি”।(প্রথম আলো সেপ্টেম্বর ০৪,২০১৩)।

চাকুরির বাজারে অদ্যাবধি এই অবস্থার তেমন কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না।“আয়ার চাকুরি পাবার জন্য ছয় লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন”। তাও আবার এক স্কুলের প্রধান শিক্ষককে।(আজকের পত্রিকা ০১.০৯.২০২১)। কথাটি নিছক ছেলেখেলা নয়। এটা শুনে তো ক্ষমতাসীনদের ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার কথা। কেউ কি নেই প্রতিবাদ করার? আসলে কথাটা আমাদের বর্তমান সামাজিক অস্থিরতার বাস্তবতায় বহুলাংশে সত্যি। তাই কারো হুঁশ নেই- নেই শক্তি কিছু বলার। সবাই যেন এ ধরনের লজ্জাকর অবস্থা লালন করছি। আজ আমরা চরম সত্যি কথা বলার নৈতিক শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। উন্নত বিশ্ব হলে নেতা মন্ত্রীরা এহেন মন্দ প্রশাসনিক অবস্থার দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করতেন। আর আমরা চুপ করে শুনছি। এ অসভ্য নিয়োগ ব্যবস্থা নীরবে মাথা পেতে মেনে নিতে কুণ্ঠিত হচ্ছি না। এতে সাধারণ মানুষের অধিকার তথা বৈধ হক নষ্ট হচ্ছে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে যদি ঘুষ বন্ধ করা না যায় তাহলে সে যুদ্ধে পরাজয় অনিবার্য। কারণ, দুর্নীতির প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে ঘুষ। বুকে-মনে যথাযোগ্য সাহস ও দেহে যথেষ্ঠ শক্তি নিয়ে এ যুদ্ধে নামতে হবে। ঘুষ পাপের বস্তু। কোন মাদকসেবী যদি স্পিড মানি ও ঘুষের অপব্যাখ্যা দেন তাকেও সাহস নিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। কারণ স্পিড মানি ও ঘুষের সঙ্গা ও প্রেক্ষিত এক নয়। অর্থনীতির ভাষায় স্পিড মানি বলতে অর্থের সার্কুলেশন গতি বা ভেলোসিটি বোঝায়। যেটাকে ভারতীয় সমাজে কিছু নেশাগ্রস্ত মানুষ ভ্রান্তভাবে করাপশন বা দুর্নীতির আবহে টেনে এনে অপব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। তাই স্পিড মানির কথা বলে ঘুষাপরাধের দায় কখনও এড়ানো সম্ভব নয়।

ঘুষ আসলেই একটি বিষবৃক্ষ। আমরা জানি সামাজিক ভাঙ্গন ও আর্থ-পারিবেশিক জঞ্জাল সৃষ্টিতে ঘুষ দায়ী। ঘুষ হকদারদের বঞ্চিত ও হতাশ করে সামাজিক ন্যায়বিচার ধ্বংস করে। তাই পৃথিবীর সকল ধর্মে ঘুষ লেনদেন করা নিষিদ্ধ। আমাদের মত ৯০ ভাগ মুসলমানদের দেশে ঘুষ-দুর্নীতি ধর্মীয় দৃষ্টিতে হারাম, সামাজিক দৃষ্টিতে লজ্জা ও ঘৃণার বিষয় হওয়া স্বত্ত্বেও কীভাবে মানুষের মস্তিষ্কে ঠাঁই নেয় সেটা বড় উৎকণ্ঠার বিষয়। অতিমারির কঠিন মুসিবতের এই সময় সেই শয়তানির মূলোৎপাটন জরুরি হয়ে পড়েছে।

Advertisement

আমাদের দেশে ধর্মীয় ও নৈতিকভাবে সবাই ঘুষখোরদের মনে মনে ঘৃণা করি। সামাজিক ও পারিপার্শ্বিকভাবে আমরা অনেকেই ঘুষখোরদের চিনি ও জানি। এদেরকে আড়ালে সমালোচনা করা হলেও বাস্তবে তা ততটা জোরদার নয়। তাই সময় এসেছে সামাজিকভাবে ঘুষখোরদের মুখোমুখি ঘৃণা করার। ঘুষখোরদের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, এরা বৈধ আয়ের তুলনায় বেশি চাকচিক্যময় জীবন-যাপন করে। দামী প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের পাঠায়, চাকুরি কিনে দেয়, দামী যৌতুক দিয়ে সন্তানদের বিয়ে দেয়। এরা প্রতিবেশিদের এড়িয়ে চলে, সন্দেহ করে, ঘৃণা ও উপহাস করে।

করোনাকালে ঘরবন্দী জীবনে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নব্য ডিজিটাল প্রতারকদের উন্মেষ ঘটেছে। তারা ম্যানুয়েল ও টাচ উভয় ডিভাইসে নিজেদের অঙ্গুলি চালনায় প্রযুক্তিতে পিছিয়ে পড়া অজ্ঞ, নিরীহ, অসহায় মানুষকে বাগে পেলে চরম ক্ষতি সাধন করে। মাদক ব্যবসা, তথ্য হ্যাকিং, ব্যাংক চুরি, পর্নগ্রাফি ব্যবসাসহ সব ধরনের সাইবার অপরাধের সাথে যুক্ত হয়ে অন্ধকার জগতের সাথে নিজেদেরকে মিশিয়ে পাপ-পূণ্যের পার্থক্য ভুলে গিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে তুলছে।

তাই বৈধ আয়ের সাথে ব্যায়ের সামঞ্জস্যহীন এ ধরনের পরিবারে মেলমেশা, বন্ধুত্ব, বিয়ে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অচেনা-অসৎ মানুষদের সঙ্গে গ্রুপ সদস্য হবার অফার বা দাওয়াত গ্রহণ বয়কট করুন। মন্দকে মন্দ বলতে শুরু করুন ও অপরকে বলাতে উৎসাহিত করুন। আজ থেকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দ্রুত সবার মধ্যে ঘুষের প্রতি সামাজিক ঘৃণা ঘণীভূত হোক- এই প্রত্যাশায়।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/জিকেএস