মানুষের একটি মারাত্মক ব্যাধি ‘অহংকার’। অহংকার করে জেনেও কোনো ব্যক্তিই অহংকারী হিসেবে চিহ্নিত হতে চায় না। এটি এমন এক মারাত্মক মানসিক ও চারিত্রিক রোগ; যার পরিণাম খুবই ভয়াবহ। অহংকারী ব্যক্তি চরম ঘৃণিত ও লাঞ্ছিত। যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতেও যেতে পারবে না। কিন্তু কেন?
Advertisement
অহংকার কী?
অহংকার আরবি ‘কিবরু’র প্রতিশব্দ। হাদিসের পরিভাষায় অহংকার হলো- ‘সত্যকে অস্বীকার করা; মানুষকে হেয় করা।’ নিজেকে অন্যের তুলনায় বড় জানা এবং অন্যকে তুচ্ছ-নিকৃষ্ট মনে করাই অহংকার।
ইমাম যুবাইদি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘অহংকার হলো নিজেকে বড় মনে করা, নিজের ভালো গুণে প্রীত হওয়া, অন্য মানুষকে নীচ ও ছোট মনে করা, যাদের প্রতি বিনয়ী হওয়া দরকার তাদের চেয়ে নিজকে উঁচু মনে করাই অহংকার।
Advertisement
অহংকারীর কিছু ধরন
নিজেকে নিরহংকার ভেবে অনেকে মনের অজান্তেও অহংকারী হয়ে ওঠে। আবার অনেক সময় কিছু কথা ও ভাব এভাবে ফুটে ওঠে-
১. সে কিছুই জানে না এমনভাবে চলাফেরা করলেও মনে মনে ভাবে- সে বেশি বা অনেক জানে।
২. যে কোনো বিষয়ে নিজেকে অভিজ্ঞ বা বিশেষজ্ঞ জানা।
Advertisement
৩. অন্যকে তুচ্ছ বা চুনোপুঁটি ভাবা।
৪. কাউকে ছোট লোক বা ছোট লোকের বাচ্চা মনে করা।
৫. এখানকার সবার কাছে পরিচিত বলে ভাব নেওয়া।
৬. আমিত্ব ভাব প্রকাশ করা যেমন- আমি না হলে...; আমি না থাকলে...।
৭. এমন বলে ভাব নেওয়া- যা করেছি তা শুধু তোদের জন্য....।
৮. অন্যকে বোকা বা মূর্খ আখ্যায়িত করে বলা- আরে, তার কথা বলেন না! আমি না থাকলে ওর কোনো কিছুই হতো না বা ভাতও জুটতো না... ইত্যাদি।
দুনিয়ায় প্রথম অহংকারী কে?
পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ব প্রথম অহংকারী ও দাম্ভিকতা প্রদর্শনকারী হলো- শয়তান। অহংকার করে হজরত আদম আলাইহিস সালামকে সিজদা করতে আল্লাহর নির্দেশের অমান্য করে এবং তার শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি ঘোষণা করে। আল্লাহ তাআলা বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেন-
قَالَ مَا مَنَعَکَ اَلَّا تَسۡجُدَ اِذۡ اَمَرۡتُکَ ؕ قَالَ اَنَا خَیۡرٌ مِّنۡهُ ۚ خَلَقۡتَنِیۡ مِنۡ نَّارٍ وَّ خَلَقۡتَهٗ مِنۡ طِیۡنٍ
তিনি বললেন, ‘কিসে তোমাকে বাধা দিয়েছে যে, (আদমকে) সিজদা করছ না; যখন আমি তোমাকে নির্দেশ দিয়েছি’? সে বলল, ‘আমি তার চেয়ে উত্তম। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন, আর তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদামাটি থেকে।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ১২)
মানুষ কেন অহংকার করে?
১. যখন শয়তান তাকে কৌশলে গ্রাস করে ফেলে। তখন তার নিজের কথা, কাজ ও কৌশলকে নিখুঁত, নির্ভেজাল ও সর্বোত্তম ভাবতে শুরু করে। অন্যের বিশ্বাস, কথা ও কাজকে সন্দেহ করতে থাকে এবং অন্যের ভুলকে বড় করে ধরে নিজের গৌরবকে ফুটিয়ে তোলে।
২. নিজের বোকামি থাকলে অন্যকেও বোকা মনে করে; যা প্রকান্তরে অহংকার।
৩. নিজের বড় বড় ত্রুটি ঢাকতে অন্যের ত্রুটি নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
৪. আল্লাহর ভয় কম থাকলে বা না থাকলে অহংকার ঢুকে যায়।
৫. নিজের আশ-পাশে চাটুকার ও অযোগ্য লোক থাকলেও লোকেরা অহংকারী হয়ে যায়।
৬. নিজে যা পাবার যোগ্য তার চেয়ে বেশি পেয়ে গেলেও মানুষে অহংকারী হয়ে যায়।
৭. নিজের প্রশংসা অন্যের মুখে বেশী করে শুনতে থাকলেও মানুষ অহংকারী হয়ে যায়।
৮. নিজের আত্মসমালোচনা যত কম হয়, অহংকার ততবেশি পেয়ে যায়।
৯. অন্যের মুখে নিজের সমালোচনা শোনার ধৈর্য্য কমে গেলেও আস্তে আস্তে মনে অহংকার ঢুকে পড়ে।
১০. কথা-কাজ-আচরণে বিনয় কমে গেলে অহংকার জায়গা করে নিতে থাকে।
অহংকারের ক্ষতি বা কুফল কী?
অহংকারের ক্ষতি বা কুফল অনেক বেশি। অহংকারী ব্যক্তি যেহেতু নিজেকে অন্যের তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করে; তাই সে সাধারণত সবার সঙ্গে ওঠা-বসা, খাওয়া-দাওয়া, চলা-ফেরা, কথা-বার্তা বলাকে নিজের মর্যাদাহানি মনে করে। যখন মানুষের সামনে যায় বা মেশে; তখন এমনটি কামনা করে যে, মানুষ তাকে সম্মান করুক; মর্যাদা দেওয়া হোক। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা অহংকারীকে পছন্দ করেন না মর্মে কোরআনে ঘোষণা এসেছে-
وَلَا تُصَعِّرۡ خَدَّکَ لِلنَّاسِ وَ لَا تَمۡشِ فِی الۡاَرۡضِ مَرَحًا اِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ کُلَّ مُخۡتَالٍ فَخُوۡرٍ
‘আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নেবে না। আর জমিনে দম্ভভরে চলাফেরা করবে না; নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক; অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৮)
কিন্তু অহংকারীর পরিণতি জাহান্নাম কেন?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন, যার অন্তরে অহংকার আছে সে জান্নাতে যেতে পারবে না। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় এর কারণ ওঠে এসেছে-
১. হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
বড়ত্ব আমার চাদর আর মহানত্ব আমার ইজার (লুঙ্গি)। কেউ যদি এ দুইটির কোনো একটির ব্যাপারে আমার সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হয় তবে আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো।’ (মুসলিম, মিশকাত)
২. অহংকারী ব্যক্তির জন্য জান্নাত হারাম। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যার অন্তরে এক যাররা (অনু) পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (মুসলিম, মিশকাত)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, কোনোভাবেই অহংকার না করা। দাম্ভিকতা বা বড়ত্ব পরিহার করা। হাদিসের ওপর আমল করা। উল্লেখিত কারণগুলো পরিহার করা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে দুনিয়া ও পরকালে অহংকারের ক্ষতি ও ভয়াবহতা থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জিকেএস