স্বামীর সঙ্গে মাঠে দিনরাত পরিশ্রম করতেন তিনি। ৪ সন্তানের মা হওয়া স্বত্বেও তাদের মুখে ভালো-মন্দ খাবার তুলে দিতে পারেননি। তার মেয়ে এক জোড়া নতুন স্কুলের জুতার আবদার করেছিল। সেটিও কিনে দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না তার।
Advertisement
তবে মেয়ের নতুন জুতা কিনে দিতে পারলেও তা অভিনব উপায়ে তৈরি করে দিয়েছিলেন। কুশিকাটা দিয়ে উলের নতুন ঘরানার জুতা তৈরি করে সবাইকে চমকে দেন এই নারী। বলছি মৌরঙ্গথেম মুক্তমণি দেবীর কথা।
মেয়ের জন্য তিনি তৈরি করেছিলেন উলের সুন্দর এক জোড়া জুতা। তার মেয়ে ভেবেছিল এমন জুতা দেখলে হয়তো শিক্ষক তাকে বকা দেবেন। তবে এই জুতা জোড়া তাক লাগিয়ে দিয়েছিল সবাইকে। শিক্ষক তাকে বলেই বসে, ‘তোমার এই জুতার মতো একটি জুতা আমার মেয়ের জন্যও এনে দিও’।
১৯৮৯ সালের ঘটনা এটি। এই ছোট্ট ঘটনাটিই মুক্তমণি দেবীর জীবনের মোড় পাল্টে দেয়। একের পর এক জুতার অর্ডার পেতে থাকেন তিনি। সেই থেকে শুরু উদ্যোক্তা হিসেবে তার পথচলা। আজ সে ভারতের নামকরা উদ্যোক্তাদের একজন। তার ঝুলিতে আছে অনেক পুরস্কার।
Advertisement
জীবনের কঠিন সময়
মুক্তামণি ১৯৫৮ সালের ডিসেম্বরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মণিপুরের কাকচিং মৈরঙ্গথেমের বাসিন্দা। জন্মের পরপরই বাবাকে হারান মুক্তামণি। তার মা অনেক কষ্টে তাকে বড় করেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই সহপাঠী ক্ষেত্রময়ুম নারান সিংকে তিনি বিয়ে করেন।
তাদের ঘরে জন্ম নেয় চার সন্তান। এতো বড় পরিবারের ভরন-পোষণের দায়িত্ব স্বামীর পাশাপাশি নিজেও বহন করেন মুক্তমণি। স্বামীর সঙ্গে ফসলের ক্ষেতে সারাদিন কাজ করতেন। বাড়তি আয়ের জন্য তিনি সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে খাবার তৈরি করে তা বিক্রি করতেন। রাতে আবার উল দিয়ে বুনতেন ব্যাগ ও হেয়ার ব্যান্ড। উদ্যোক্তা হিসেবে জন্ম মেয়ের জন্য উলের জুতা বুনে রীতিমতো প্রশংসার জোয়ারে ভাসেন মুক্তামণি। মেয়ের স্কুলের শিক্ষকের কাছ থেকে প্রথম জুতার অর্ডারটি পেয়েছিলেন তিনি। এরপরে আর থামতে হয়নি তাকে। ১৯৯০ সালে তিনি নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘মুক্তা নিটেড সু’ চালু করেন।
কিছু সময়ের মধ্যেই তার এই অভিনব উদ্যোগ প্রশংসা কুড়ায়। এরপর থৌবলের জেলা শিল্প কেন্দ্রের অধীনে উল ও বুনন সূচিকর্ম বিভাগের আওতায় আসে মুক্তামণির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি। তার প্রতিষ্ঠান সরকারি নিবন্ধন পায়। মুক্তামণি তখন তার পণ্যের প্রচার শুরু করেন।
Advertisement
ডিআইসি আয়োজিত ১৫ দিনের মেলায় তার শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়। তৎকালীন শিল্প মন্ত্রী হৌখুমং হাওকিপও তার কাজের প্রশংসা করেন। উল ও বুনন সূচিকর্ম বিভাগের চেয়ারম্যান কেএইচ বিনয় তার ব্যবসা সম্প্রসারণে সরকারি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। এরপর থেকে মুক্তামণিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
মুক্তামণি এখন পর্যন্ত ১০০০ জনেরও বেশি মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তার কারখানায় সব বয়সী নারী ও পুরুষ হস্তশিল্পীরা কাজ করেন। তারা অভিনব উলের জুতা ও স্যান্ডেল তৈরি করেন। যার দাম ২০০-৮০০ টাকা পর্যন্ত। তার কোম্পানি বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, মেক্সিকো ও আফ্রিকার কিছু দেশে পণ্য রপ্তানি করে।
মুক্তামণি নিজেই নিজের ভাগ্য বদলেছেন। মাঠে কাজ করা এই নারী আজ বিশিষ্ট শিল্পপতি হিসেবে নাম কুড়িয়েছেন। আজ তার ব্যবসা শুধু নিজ দেশেই সীমাবদ্ধ নয় বরং বিদেশেও পৌঁছাচ্ছে তার তৈরি উলের বাহারি জুতা ও স্যান্ডেল।
আয়রন লেডির স্বীকৃতি দ্য টেলিগ্রাফের সহযোগিতায় ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কর্তৃক আয়োজিত ‘ট্রু লিজেন্ডস অ্যাওয়ার্ডস ২০১৮’ অনুষ্ঠানে ১১ জন ব্যক্তিকে বাছাই করা হয়। যারা তাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন। মুক্তামণি এই পুরস্কার জেতেন।
এ বিষয়ে মুক্তামণি বলেন, ‘আমি এই পুরস্কারটি ওই নারীদেরকে উৎসর্গ করব, যারা আমার সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করছেন। শুরুতে আমি ভাবতাম নিজের পরিবারের মুখে কীভাবে অন্ন জোটাবো। আজ আমার মতো অন্য নারী ও তাদের পরিবারের কথাও আমাকে ভাবতে হয়।’
২০১৬ সালে মুক্তামণি সিটি গ্রুপ মাইক্রো এন্টারপ্রেনারশিপ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন। ২০১০ সালে তিনি হস্তশিল্পের জন্য রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পান। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং নয়াদিল্লির বিজ্ঞান ভবনে তাকে এমএসএমই পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেন।
২০০৮-২০০৯ সালে মাস্টার কারিগর হিসেবে মণিপুর স্টেট অ্যাওয়ার্ড জিতেন। এছাড়াও মুক্তামণি ২০১৩-২০১৪ সালের বসুন্ধরা- এনই নারী উদ্যোক্তা হওয়ার সম্মাননা অর্জন করেন। ১৯৯৩ সালে তিনি ইন্দিরা পার্কে অনুষ্ঠিত অল মণিপুর শিল্প মেলায় বিজয়ীর পুরস্কার পান।
একইসঙ্গে তিনি উত্তর-পূর্ব বিভাগে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে ১৬তম হিসেবেও পুরস্কার জিতেন। ২০০৬ সালে মুক্তামণি দিল্লির জয়রাম রমেশের কাছ থেকে এমএসএমই পুরস্কারে ভূষিত হন।
সূত্র: বুক অব অ্যাচিভার
জেএমএস/এএসএম