লক্ষ্মীপুরের রায়পুর, রামগঞ্জ ও রামগতি পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় একক কাউন্সিলর প্রার্থী সমর্থন (মনোনয়ন) দেয়ার নামে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। তিনটি পৌরসভার ২৭ জন কাউন্সিলর প্রার্থীর একেকজনের কাছ থেকে ৪ থেকে ৮ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। রামগঞ্জে এক প্রার্থীর তিন লাখ টাকা ফেরত দেয়া নিয়ে সালিশ বৈঠকও হয়। নির্বাচনী এলাকার পৌর, উপজেলা আওয়ামী লীগের জেষ্ঠ্য নেতারা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম বলে এ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।এ নিয়ে খোঁদ ক্ষুদ্ধ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও বলছেন, ‘কাউন্সিলর সমর্থন নিয়ে লাখ-লাখ টাকা বাণিজ্য হয়েছে’। তবে দলটির জেলা সাধারণ সম্পাদকের দাবি, মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের কয়েকজন টাকা নিয়ে আসলেও কারও কাছ থেকে একটি টাকাও নেয়া হয়নি। স্থানীয় নেতারা সাংগঠনিক নিয়মানুযায়ী ত্যাগী ,পরীক্ষিত ও জনপ্রিয় প্রার্থীদেরই দলীয় সমর্থন দিয়েছেন।এদিকে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র একাধিক নেতা নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে প্রভাব বিস্তার করছেন। ইতোমধ্যে রায়পুরে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরাও প্রকাশ্যে মহড়া দিচ্ছে। রামগতিতে সোমবার জাতীয় পার্টির প্রার্থী আজাদ উদ্দিন চৌধুরীর গণসংযোগ চলাকালে যুবলীগ নেতাকর্মীরা বাঁধা দিয়েছে। এছাড়া রায়পুর, রামগঞ্জ ও রামগতিতে বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে প্রার্থীদের হুমকি দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের কয়েক নেতা। এর মধ্যে রায়পুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ, পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক গোলাম হায়দার, ১ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আহসান মালেককেও ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে বলে তাদের অভিযোগ। তারা অভিযোগ করে জানায়,‘ভোট থেকে সরে না গেলে হাত-পা ভেঙে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হবে বলে হুমকি দেয়া হচ্ছে। এতে ভোট ডাকাতির আশঙ্কার পাশাপাশি তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।দলের (আ.লীগ) বাইরে গিয়ে নির্বাচন করায় রায়পুরে ৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী কামাল হোসেন সর্দারকে শনিবার (১২ ডিসেম্বর) সকালে প্রকাশ্যে জুতাপেটা করা হয়েছে। এ নিয়ে রিটানিং অফিসার ও থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন ওই প্রার্থী। বিষয়টি জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় উপস্থাপন করেছেন বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী এবিএম জিলানী।কামাল হোসেন বলেন, ‘নেতাদের কথা মতো মনোনয়ন প্রত্যাহার না করায় আমার ওপর প্রকাশ্যে হামলা চালানো হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা ৭ লাখ টাকা নিয়ে কাউন্সিলর শহিদ উল্যা মোল্লাকে দলীয় সমর্থন দিয়েছে। প্রত্যেক প্রার্থীর কাছ থেকে দলীয় সমর্থন দিয়ে তারা এভাবে টাকা তুলেছে’।নির্বাচনী অবস্থা নিয়ে লক্ষ্মীপুর থেকে সরকারের শীর্ষ স্থানীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচনকে ঘিরে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা এলাকায় ফিরছে। এতে বিভিন্ন দলের প্রার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ ভোটাররাও আতঙ্কিত।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রামগঞ্জে ত্যাগী ও পরীক্ষিত প্রার্থীদের সমর্থন না দিয়ে বিএনপি-জামায়াত আর্দশে বিশ্বাসী কালোবাজারী ও জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী করা হয়েছে। এ নিয়ে পৌর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী রিয়াদ হোসেন দলীয় সমর্থন পুর্নর্বিবেচনার জন্য জেলা ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে চিঠি লিখেছেন।রিয়াদ হোসেন বলেন, ‘খামখেয়ালিভাবে ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতির ছেলে আরিফুল ইসলামকে আওয়ামী লীগের সমর্থন দেয়া হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের ৭ জন প্রার্থীর মধ্যে ৫ জন আমাকে সমর্থন দিয়েছিল। এটি মেনে নেয়া যায় না’।৯ নম্বর ওয়ার্ডে তিন লাখ টাকা নিয়ে প্রার্থী করা হয় ছাত্রলীগ নেতা মো. এমরান হোসেনকে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ ক ম রুহুল আমিন এ টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তীতে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এক চিঠিতে ওই ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী করেন স্বেচ্ছাসেবকলীগের নেতা কাজী রাশেদকে। পরে এমরানের টাকা লেনদেনের বিষয়ে এক সালিশী বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন তিন লাখ টাকা ফেরত দেয়ার অঙ্গীকার করেন। এ সময় ওই ওয়ার্ডে যুবলীগ নেতা আনোয়ার হোসেন লিটন হাজারীকে নতুন করে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। এজন্য লিটন এমরানকে দুই লাখ টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত দেয় স্থানীয় নেতারা। এ নিয়ে কে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তা নিয়ে রয়েছে বিভ্রান্তি।নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক রামগতির মধ্যম সারির এক আওয়ামী লীগ নেতার ভাষ্য মতে, স্থানীয় এমপির অনুসারীদের কাউন্সিলর সমর্থন দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হয়নি। একক প্রার্থী করে কাউন্সিলর নির্বাচিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়েছে।এ ব্যাপারে জানতে রামগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ ক ম রুহুল আমিনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। তবে দলটির উপজেলা সভাপতি মো. শাহজাহান বলেন, ‘দালালরা কিছু বাণিজ্য করতে পারে। আমি রাজনীতি করতে গিয়ে কারও কাছ থেকে জীবনেও ১০ টাকাও নেইনি। দলের বখাটে কিছু ছেলে অপ-প্রচার চালাচ্ছে’।রায়পুরে বিএনপির প্রার্থী ও পৌরসভার মেয়র এ বি এম জিলানী বলেন, ‘সাধারণ ভোটাররা চরম আতঙ্কে রয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় আমার কর্মী -সমর্থকদের হামলা-মামলায় জড়িয়ে বাড়ি ছাড়া করার হুমকি এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে ভোট করতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাদের (আ.লীগ) দলের বিদ্রোহী প্রার্থীকে যখন জুতাপেটা করা হয়, তখন নির্বাচনী কি অবস্থা তা বোঝা যায়’।জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূর উদ্দিন চৌধুরী নয়নের দাবি, মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের কয়েকজন টাকা নিয়ে আসলেও কোনো প্রার্থীর কাছ থেকে একটি টাকাও নেয়া হয়নি। স্থানীয় নেতারা সাংগঠনিক নিয়মানুযায়ী ত্যাগী ,পরীক্ষিত ও জনপ্রিয় প্রার্থীদেরই দলীয় সমর্থন দিয়েছেন।জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু বলেন,‘কাউন্সিলর সমর্থন নিয়ে লাখ-লাখ টাকা বাণিজ্য হয়েছে বলে শুনেছি। এ বিষয়ে লিখিতভাবে কেউ আমাকে জানায়নি। দলীয় কোনো প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে অন্য প্রার্থীদের হুমকি-ধামকি দেয়ার জন্য দল থেকে কাউকে বলা হয়নি। এসব বিষয়ে প্রশাসনকে কঠোর থাকার আহ্বান জানান তিনি।কাজল কায়েস/এসএস/এমএস
Advertisement