সেখানে বসেই বেশি সময় কাটানো হতো। সেইসঙ্গে কলেজের গেটে চা-বিস্কুট নিয়ে বসা ছেলেটার হাতের চা না খেলে পুরো দিনটা যেন পূর্ণতা পেত না। তাই সব ভুলে গেলেও ওর বানানো চা খেতে ভুলতাম না। যতবারই আসতাম ততবারই খেতাম। ছেলেটির বানানো চা খেতে খেতেই তাকে নিয়ে লিখছি।
Advertisement
ছেলেটির নাম অরুণ (কাল্পনিক নাম)। তার বয়স কত হবে? ১৩ বা ১৪। বেশ হাসিখুশি সে। সব সময়ই মুখে হাসির ছাপ লেগেই থাকে। দেখলে মনে হয় সে পৃথিবীর সবচেয়ে হাসিখুশি মানুষ। ছেলেটি আমাদের কলেজ গেটে একটি টেবিলের ওপর অল্প কিছু সরঞ্জাম নিয়ে চা বিক্রি করে।
বেশ ভালোই চা বানায় সে। প্রতিদিনই বেশ কয়েকজন বন্ধুসহ ওর হাতে বানানো চা খেতাম। জিজ্ঞেস করলো, ভাইয়া চায়ে চিনি কম না বেশি? বললাম, তোমার মতো করেই দাও।
আপনি তো কখনও চিনি কম আবার কখনও বেশি খান, আমি তাইলে বুঝমু (বুঝবো) কেমনে (কীভাবে) কন (বলেন) দেহি (দেখি)? ছেলেটির কথা শুনে আবারও বললাম, ঠিক আছে আজ তাহলে তোমার মতো করেই চা বানিয়ে দাও।
Advertisement
এরপর চা খেতে খেতেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত ছোট বয়সে এই কাজ কেন করছো? লেখাপড়া করো না? উত্তরে হেসে জানালো, আমি তো লেহাপড়া (লেখাপড়া) করতেই চাই কিন্তু পেটের থেইক্যা (থেকে) তো আর লেহাপড়া বড় না।’ একটু অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বাবা কী করে? ‘আব্বা অসুস্থ অনেকদিন। ডাক্তার দেখাইছি কিন্তু ওষুধ আর কিনতে পারি নাই। আব্বা সারাদিন এখন ঘুমাইয়া কাটায়। ঘর থেইকা (থেকে) বের হইতে (হতে) পারে না। আমি দোকানে আইলে (আসলে) বাসায় খাওন চলব। আর না আইলে সবাইকে উপোস থাকা লাগব (লাগবে)।
এহন কন আমি লেহাপড়া (লেখাপড়া) করমু না কি ঘরের খাওন (খাবার) জোটামু (জোটাবো)?’ মুখের ওপর এমন প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়ায় আমি কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে যাই। এমন প্রশ্নের কি উত্তর দিব, তা কি আমার জানা আছে?
তার শখ আছে লেখাপড়া করার, তবে ভাগ্য তার বিপরীতে দাঁড় বাইছে। অন্য ৫টি ছেলের মতো সেও হয়তো স্কুলে যাওয়ার ও ক্লাসের সহপাঠীদের সঙ্গে নতুন বন্ধন গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিল।
তবে ভাগ্যের চাকা উল্টো পথে ঘোরায় ৫ টাকার চায়ের অর্ডার দেওয়া ক্রেতাদের সঙ্গে গড়ে উঠেছে তার সখ্যতা। এখন সারাদিন চায়ের কাপ আর চামচের টুংটাং শব্দেই দিন কাটে তার।
Advertisement
অরুণের বয়সী অন্য যারা আছে তারা হয়তো মগ্ন আছে লেখাপড়া আর খেলাধুলা নিয়ে। আর অরুণ এই বয়সেই পুরো সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। লেখাপড়া আর খেলাধুলায় কী আনন্দ, তা জানা নেই অরুণের। এসব ভুলে পরিবারের পেটে খাবার তুলে দিতেই সারাদিন পরিশ্রম করে যাচ্ছে অরুণ।
সবসময় দেখি সে খুব হাসিখুশি। কিছু জিজ্ঞেস করলেই এক চিলতে হাসি দিয়ে এমনভাবে উত্তর দেয় দেখে মনে হয় দুঃখ-কষ্ট কি তা সে জানে না। ছেলেটি সত্যিই বড় অদ্ভুত! আমার মনে হয় পৃথিবীর প্রকৃত সুখী মানুষ অরুণ।
যাইহোক চা খাওয়া শেষ। এখন উঠতে হবে। অরুণকে তার বিলটা দিতে দিতে বললাম, তুই চা সত্যিই খুব দারুণ বানাস। এ কথা শুনে সে হেসে বলল, ‘এই কথাতো আপনি প্রতিদিনই বলেন।’
এরপর একটু চুপ থেকে আবার বলল, ‘কয়েকদিন চা খাওয়াতে পারমুনা (পারব না)। আব্বা আবার বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আম্মা কাল থেইক্যা (থেকে) গ্রামে হাঁটতে যাইবো (যাবে) ভিক্ষার জন্য। আর আমি আব্বারে (আব্বাকে) দেইখা (দেখে) রাখমু (রাখব)।’
ওর কথা শুনে আমি আবারও চুপ হয়ে গিয়েছি। অরুণ সত্যিই অদ্ভুত। সে ছোট হয়েও পালন করছে অনেক বড় দায়িত্ব। এরপর আর কিছু না বলেই স্থান ত্যাগ করলাম। এরপর থেকে শুধু একটা কথাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, আমরা কেন অরুণ হইতে পারলাম না!
লেখক: ফ্রিল্যান্স ফিচার রাইটার
জেএমএস/জেআইএম