বিশেষ প্রতিবেদন

বাংলাদেশ তার কাঙ্ক্ষিত জায়গায় যেতে পারেনি

আ ক ম মোজাম্মেল হক। বীর মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমান সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। বিজয়ের মাস ডিসেম্বর,  মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার মতো বিষয় নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর সঙ্গে। স্বাধীনতার ৪৪ বছরের সবচেয়ে বড় অর্জন যুদ্ধাপরাধের বিচার উল্লেখ করলেও বাংলাদেশ এখনো মুক্তিযুদ্ধের কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছতে পারেনি বলে মত দেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।জাগো নিউজ : বিজয়ের ৪৪ বছর পার করছে বাংলাদেশ। কোথায় যেতে পারলাম আমরা? আ ক ম মোজাম্মেল হক : অর্থনৈতিক মুক্তি আর মানবিক সমাজ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে এ অঞ্চলের আপামর জনসাধারণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। লাখো শহীদের বিনিময়ে লাল-সবুজের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার আপন মহিমায় যখন সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই বাংলাদেশ বিরোধী শক্তি তার গতি রোধ করে দেয়। ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের থমকে দাঁড়ানোর দিন। যে কারণে দীর্ঘ ৪৪ বছরেও মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। বাংলাদেশ তার কাঙ্ক্ষিত জায়গায় এখনো যেতে পারেনি। জাগো নিউজ : আপনি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। জীবনের এই সময় এসে আজকের বাংলাদেশ কতটুকু ভাবায়? আ ক ম মোজাম্মেল হক :  যে বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম, তা এখনও অদূরে রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের যে স্বপ্ন, তা বাস্তবায়ন হয়নি। এই ভাবনা সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায়। তবে বাংলাদেশ তার পথ হারায়নি। বিভ্রান্তি হয়েছে, ভুল পথে চলার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু সঠিক পথে আবার ফিরে আসার চেষ্টাও হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তাবায়নে শেখ হাসিনার সরকার বদ্ধপরিকর।জাগো নিউজ : মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে, যা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জও বটে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা নিয়ে কী বলবেন?আ ক ম মোজাম্মেল হক : বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার হবে এটি কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। যুদ্ধাপরাধীরা দম্ভের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করত এবং একটি অংশ এখনও করে। সেই জায়গা থেকে এই বিচার বড় চ্যালেঞ্জের ছিল। বঙ্গবন্ধুর কন্যা জীবন বাজি রেখে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে চলছেন। বিচার চলছে। কার্যকরও হচ্ছে। এটি হচ্ছে আদর্শের লড়াই। এমন লড়াইয়ে টিকতে হলে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতেই হয়।জাগো নিউজ : কয়েকজন শীর্ষ মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচার চলছে। অন্যদের ব্যাপারে কী বলবেন?আ ক ম মোজাম্মেল হক : সরকার এ ব্যাপারে শতভাগ আন্তরিক। এই বিচার একটি চলমান প্রক্রিয়া। একজন অপরাধীও যদি থাকেন এবং তার বিরুদ্ধে যদি যথাযথভাবে সাক্ষী প্রমাণ মেলে তবে সেও এই বিচারের হাত থেকে রেহাই পাবে না।জাগো নিউজ : এই বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকে প্রশ্নও তুলছেন। বিশেষ করে বিশ্ব সংস্থাসহ পশ্চিমাদের অনেকেই এই বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে নানা অভিযোগ করে আসছেন। এই অভিযোগ কিভাবে মোকাবেলা করছে সরকার? আ ক ম মোজাম্মেল হক : দেখুন, আজ এই বিচারের বিরোধীতা করছে কারা? যারা বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধীতা করেছে, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি হত্যার জন্য সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল এবং স্বাধীনতার পর কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ তৈরিতে ষড়যন্ত্র করেছিল। এই বিচারের প্রশ্ন তারা তুলবে এটাই স্বাভাবিক।আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক এবং স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে এই বিচার পরিচলনা করছি। সুতরাং পশ্চিমা বিশ্ব যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে কী বলল আর বলল না, তা আমলে নেয়ার প্রয়োজন আছে বলি মনে করি না।জাগো নিউজ : জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নও বিচার নিয়ে আপত্তি করছে?আ ক ম মোজাম্মেল হক :  বিন লাদেনের কর্মকাণ্ড আমরা সমর্থন করি না। কিন্তু তাকে হত্যার পর লাশটি পর্যন্ত দেখানো হলো না, সাগরে ভাসিয়ে দেয়া হলো। এটি কোন ধরনের মানবতা। এই বিষয়ে জাতিসংঘ কখনও প্রশ্ন তুলেছে? তারা আমাদের মানবতা শেখাতে এসেছে।জাগো নিউজ : এই বিচারের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কী না?আ ক ম মোজাম্মেল হক : এই বিচার বাঙালির আবেগের। কে কিভাবে দেখল, তা গুরুত্ব দেয়ার সময় নেই। আমরা আমাদের আইনে বিচার করছি। স্বচ্ছতার কোনো অভাব নেই। সুতরাং এই বিচারের মধ্যে দিয়ে সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি হতে পারে আমি তা মনে করি না।জাগো নিউজ : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে পাকিস্তানের সমালোচনা কিভাবে দেখছেন? আ ক ম মোজাম্মেল হক : পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এখনও মুক্তিযুদ্ধে হত্যা, গণহত্যার কথা অস্বীকার করা হয়। সভ্যতার এমন সময়ে এর চেয়ে বড় মিথ্যাচার আর হতে পারে না। সারা পৃথিবী জানে, ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী কী হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো।জাগো নিউজ : দাবি উঠেছে, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার। এই দাবি সরকার কিভাবে মূল্যায়ন করছে?আ ক ম মোজাম্মেল হক : পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের মূল্যায়ন করছে সরকার। আজ যে জনদাবি উঠেছে, তা সরকার বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। যারা বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে গাদ্দারি করছে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার বিশেষ কোনো কারণ আছে বলে মনি করি না। জাগো নিউজ : আপনারা বলছেন, জামায়াত লবিস্ট নিয়োগ করে যুদ্ধাপরাধের ব্যাপারে এসব অভিযোগ তুলছে। প্রচার-প্রচারণায় আপনারা পিছিয়ে কেন?আ ক ম মোজাম্মেল হক : রাষ্ট্রের টাকা খরচ করে জামায়াতের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার কোনো সুযোগ নেই। আমরা সত্যের পথে আছি। সত্যের জয় হবেই।জাগো নিউজ : অভিযোগ রয়েছে মানবতাবিরোধীদের বিচার ইস্যুতে আওয়ামী লীগ জনসমর্থন তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই অভিযোগের জবাব কী?আ ক ম মোজাম্মেল হক : আমি তা মনে করি না। এই বিচার নিয়ে জনগণ আমাদের পক্ষে ছিল এবং আছে। বিচারের সময়ক্ষেপণ নিয়ে জনমনে এক ধরণের ক্ষোভ আছে বটে, তবে সেটা আমাদের (আওয়ামী লীগ) ওপর ভরসা রেখেই। জাগো নিউজ : জামায়াতে আমীর মতিউর রহমান নিজামীর বিচারের চূড়ান্ত রায় আসন্ন। নিজামীর রায়ে কী প্রত্যাশা করছেন?আ ক ম মোজাম্মেল হক : হত্যা, গণহত্যার একমাত্র শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। এর বাইরে আর কোনো শাস্তি হতে পারে না। আমরা তার মৃত্যুদণ্ডই প্রত্যাশা করছি।জাগো নিউজ : যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের দাবি উঠছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী? আ ক ম মোজাম্মেল হক : জামায়াতের অপরাধ সম্পর্কে দেশ-বিদেশের সবাই অবহিত। ট্রাইব্যুনালও বারবার জামায়াতকে অপরাধী দল হিসেবে বিবেচনা করছে।জাগো নিউজ : তাহলে সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করছে না কেন?আ ক ম মোজাম্মেল হক : জামায়াত নিষিদ্ধ সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে সেটা আদালতের মধ্য দিয়েই হবে। আমরা চাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হোক। আদালত তাদের দোষী সাব্যস্ত করছে, আদালতই তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।জাগো নিউজ : মুক্তিযুদ্ধের তালিকা প্রণয়ন নিয়ে আবারো অনিশ্চিয়তা, কেন এমন হলো?আ ক ম মোজাম্মেল হক : মুক্তিযুদ্ধের তালিকা প্রণয়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেছিল। ঠিক তখনই একটি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র মিথ্যা তথ্য দিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেন। আদালত তালিকা প্রণয়নে স্থগিতাদেশ জারি করেন। এ কারণেই বিষয়টি আটকে যায়।জাগো নিউজ : অভিযোগ রয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল এবং মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের মধ্যকার সমন্বয়হীনতার কারণে আদালতের বিষয়টি সুরহা হচ্ছে না.. আ ক ম মোজাম্মেল হক : আমরা যথাযথ উপায়ে আদালতের জবাব দিচ্ছি। নিজেদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা আছে বলে মনে করি না। আদলত যেভাবে চাইছে, আমরা সেভাবেই এগুচ্ছি। জাগো নিউজ : আদালত মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণের তাগিদ দিয়েছেন..আ ক ম মোজাম্মেল হক : আমরা সংজ্ঞা নির্ধারণ করেই তালিকা প্রণয়নে হাত দিয়েছি। সংজ্ঞা নিয়ে কোনো জটিলতা আছে বলে মনে করি না। ওই প্রতিক্রিয়াশীল চক্রটিই এসব অসত্য কথা বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে চলছে। জাগো নিউজ : মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য বিদেশি বন্ধুদের দেয়া ক্রেস্ট জালিয়াতির বিষয়টি এখন কোন অবস্থায় আছে?আ ক ম মোজাম্মেল হক : প্রাথমিক তদন্ত শেষ হয়েছে। অধিকতর তদন্ত চলছে। আশা করছি দ্রুততম সময়ের মধ্যে এর সমাধান হবে।জাগো নিউজ : প্রাথমিক তদন্তে যারা দোষী সাব্যস্ত, তারা তো এখনও বহাল তবিয়তে। মন্ত্রণালয় তো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারত?আ ক ম মোজাম্মেল হক : সরকার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তদন্ত চলছে। এই মুহূর্তে এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ছাড়া মন্ত্রণালয় আর কোরো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না। যা করবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় করতে পারে। আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিতে অনেক আগেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি।জাগো নিউজ : সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।আ ক ম মোজাম্মেল হক : আপনাকে ও জাগো নিউজকেও ধন্যবাদ। এএসএস/আরএস/এআরএস/এমএস

Advertisement