বিশেষ প্রতিবেদন

‘সোয়ালোজ’ যুদ্ধে স্বজন হারানো নারীর বেঁচে থাকার সাঁকো

রাজশাহী শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে চারঘাট উপজেলার সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি। একাডেমির পাশেই থানাপাড়া। মুক্তিযুদ্ধে সারাদেশ যখন জ্বলছে থানাপাড়ার মানুষেরা তখন বাড়তি আতংকে কাঁপছে। একাডেমিতে বাঙালি আর পাকাস্তানি পুলিশের মধ্যে বিভাজন তখন তীব্র। যুদ্ধের শুরুতেই একাডেমির নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানিদের হাতে। বাঙালি সিপাহীরা চাকরি ছেড়ে পলায়ন করছে। তাদের কেউ কেউ আবার মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিচ্ছেন। দিনটি ’৭১-এর ১৭ এপ্রিল। এর আগে মুক্তিযোদ্ধারা একাডেমির নিয়ন্ত্রণ নিতে কয়েকবার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়। পাক সেনারা পালিয়ে যাওয়া পুলিশদের ওপর বদলা নিতে গিয়ে গভীর রাতে থানা পাড়ার সাধারণ মানুষের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। পাড়ার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে শতাধিক পুরুষকে আটক করে। এরপর নির্মম বর্বরতা। আটককৃতদের পদ্মার পাড়ে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হায়েনারা। লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। ইতিহাসের বর্বরোচিত এ হত্যাকাণ্ডে থানাপাড়া গ্রামটি প্রায় পুরুষ শূন্য হয়ে যায়। স্বাধীনতার ৪৪ বছর গড়িয়েছে। পদ্মাও তার ভাঙন খেলা অব্যাহত রেখেছে। ভাঙনের কবলে গণহত্যার জায়গাটি এখন গহীন পদ্মায় মিলিয়ে গেছে। তবে স্বজন হারানোর বেদনাকে শক্তিতে রূপ দিয়ে গ্রামটির নারীরা জীবনযুদ্ধে আজ জয়ী। ‘সোয়ালোজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি’ নামের একটি বেসরকারি সংগঠন যুদ্ধবিধস্ত গ্রামটির ভাগ্য বদলে দিয়েছে স্বাধীনতার পরপরই। ’৭১ -এ স্বজন হারানো এ গ্রামের নারীরা এখন অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ।‘সোয়ালোজ’ সুইডেনের একটি পাখির নাম। সুইডেন ভাষায় একে সুখের পায়রা বলা হয়। প্রচার রয়েছে চরম সংকটকালে সোয়ালাজ উড়ে এসে সুখের পথ দেখায়। সুখের নাগাল পাইয়ে দিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়। বিষয়টি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হলেও সারদায় সোয়ালোজ শব্দটি বাস্তবতার স্বাক্ষর রেখেছে।১৯৭২ সালেই সুইডেনের ‘সোয়ালোজ’ নামের সংস্থাটি দেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোতে রিলিফ প্রদানের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করে। সারদার থানাপাড়া এমনই একটি গ্রাম। ’৭২-এর মাঝামাঝিতে সোয়ালোজ ত্রাণ সহায়তা নিয়ে থানাপাড়ায় আসলে গ্রামের নারীরা ত্রাণের পরিবর্তে কাজ চায়। স্বামী, ভাই বা সন্তান হারা এরকম ১৭ জন নারীকে হস্তশিল্পে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে পুনর্বাসন কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়। গঠন করা হয় ‘দি সোয়ালোজ থানাপাড়া প্রজেক্ট’। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত প্রজেক্টটি সুইডেন থেকে সরাসরি পরিচালিত হতো। পরে ঢাকা থেকে এবং বর্তমানে স্থানীয় জনবল তৈরি করে তাদের মাধ্যমেই এর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তবে সুইডেনের সোয়ালোজ নেপথ্যে থেকে ভূমিকা পালন করছে। ১৯৯৮ সালে প্রজেক্টের পরিবর্তিত নামকরণ করা হয় ‘থানাপাড়া সোয়ালোজ ডেভেলমেন্ট সোসাইটি’। পর্যায়ক্রমে ক্ষতিগ্রস্তরা প্রায় সকলেই এই সোসাইটির অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে। বর্তমানে তিন শতাধিক নারী সোয়ালোজ সোসাাইটিতে হস্তশিল্পের ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন করছে। নারীদের পাশাপাশি অর্ধশত পুরুষও কাজ করছে এখানে। গ্রামের ভিতরে অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে কারখানাটি অবস্থিত। বাইরে থেকে কারখানা বলে বোঝার উপায় নেই। মনে হবে কোনো জমিদারের বাগানবাড়ি। ভিতরে সবাই সৃষ্টির নেশায় ব্যস্ত। কেউ চরকা ঘুরিয়ে সুতা কাটছেন, কেউ কাপড় বুনছেন, কেউ কাপড়ে মাড় দিচ্ছেন অথবা কেউ মনের মাধুরী মিশিয়ে বুনানো কাপড়ে নকশী করছেন। কারখানায় শুধু সুতাটাই বাইরে থেকে ক্রয় করা হয়। বাদ বাকি সবই শ্রমিকেরা করে থাকেন। সকল প্রকার গার্মেন্টেসের পাশাপাশি নকশী কাঁথাও তৈরী করা হয় এখানে। এখানকার তৈরীকৃত হস্তজাত পণ্য উন্নত দেশগুলোতে রফতানি করা হয়। বিদেশের যেসব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থানাপাড়ার হস্ত শিল্প ক্রয় করে থাকে সেগুলো হলো কেয়ার ট্রেড কোম্পানি (জাপান), পিপল ট্রি (ইংল্যান্ড), দি সোয়ালোজ ইন ফিনল্যান্ড (ফিনল্যন্ড), ফেয়ার কো-অপারেশন (ইটালি), মাদার মাদার (ডেনমার্ক), ফেয়ার ট্রেড (কোরিয়া), মেলেনিয়া (সুইডেন) এবং ভাল (অস্ট্রেলিয়া)। এছাড়া দেশীয় উন্নত শপিংমলগুলোতেও এই হস্তশিল্প জায়গা করে নিয়েছে।সমবণ্টন নীতিতে পণ্যের মূল্য নির্ধারণে শ্রমিকেরা সরাসরি অংশগ্রহণ করে থাকে। এতে করে ফড়িয়া শ্রেণি বা মধ্যস্থতাকারীদের কোনো হাত থাকে না। সোসাইটির আয়-ব্যয় নির্ধারণেও শ্রমিকদের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। ফলে কোন দাতা সংস্থার তরফ থেকে পাওয়া অনুদানের পুরোটাই শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যবহার করা হয়। নারীদের আর্থিক বিষয়টি নিশ্চিত করার পাশাপাশি নানা রকম উন্নয়নমুলক কর্মসূচিও রয়ছে এখানে। এর মধ্যে হস্তশিল্প প্রকল্প, গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্প, প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্প, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ডে-কেয়ার এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র উল্লেখযোগ্য। এছাড়া এসব কর্মসূচির আওতায় যেসব প্রকল্প রয়েছে তা হলো স্থায়িত্বশীল কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প, আইন শিক্ষা, আর্সেনিক পরীক্ষা ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার, দক্ষতা উন্নয়ন, উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা এবং পারিবারিক সহিংসতা রোধ প্রকল্প। প্রকল্পের আওয়তায় আশেপাশের দশটি গ্রামে ঝড়ে পড়া শিশুদের নিয়ে একটি করে স্কুল তৈরি করা হয়েছে।সোসাইটির সুবিধাভোগী জাহানারা বেগম নামের একজন প্রায় ২৩ বছর ধরে কারখানায় কাজ করছেন। জাহানারার বাবা জালাল উদ্দিন ১৭ এপ্রিল ওই হত্যাকাণ্ডের শিকার। বাবা নিহত হওয়ার দু’বছর পর জাহানারার মা কারখানায় যোগদান করেন। বয়স হলে মায়ের সঙ্গে তিনিও চাকরি নেন। চাকরি নেয়ার দু’বছর পর বিয়ে হয় জাহানারার। জমানো টাকা দিয়ে সারদা বাজারে স্বামীকে দোকান করে দিয়েছে জাহানারা।তিনি বলেন, সোয়ালোজ সোসাইটি এখানকার নারীদের চোখ খুলে দিয়েছে। স্বজন হারিয়ে গ্রামের নারীরা দিশেহারা ছিল। সেই শোক শক্তিতে রূপ দিয়েছে সোয়ালজ সোসাইটি।’সোসাইটির পরিচালক রায়হান আলী বলেন, ‘যুদ্ধের পর গ্রামের নারীরা অনেকটাই অহসায় ছিল। সোয়ালোজ এখানকার নারীদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছে। এই সোসাইটির নারীরা হস্তশিল্পের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে বাঙালি সংস্কৃতিকে বিশেষ পরিচিতিও দিচ্ছেন। এএসএস/এআরএস/এমএস

Advertisement