তথ্যপ্রযুক্তি

তরুণদের সচ্ছল করার পরিকল্পনায় জুবায়ের

বর্তমানে ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে নানা দক্ষতা অর্জন করা যাচ্ছে বিভিন্ন ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মে। সম্ভাবনাময় এ সেক্টরে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ‘বঙ্গ একাডেমি’। অনলাইনভিত্তিক এ প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা দক্ষিণ এশিয়ার সেরা উদ্যোক্তা খেতাবজয়ী জুবায়ের হোসেন। সম্প্রতি জাগো নিউজকে জানিয়েছেন তার নানা উদ্যোগের গল্প। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বেনজির আবরার—

Advertisement

জাগো নিউজ: আপনার ছোটবেলা নিয়ে কিছু বলুন—জুবায়ের হোসেন: আমার ছোটবেলা কেটেছে গোপালগঞ্জের ছোট্ট একটি গ্রামে। এরপর এক সময় খুলনায় স্কুলজীবন শেষ করি। ছোটবেলা থেকেই আমার একটি স্বপ্ন, আমি হ্যাকার হবো। হ্যাকিং নিয়ে বিভিন্ন ট্রিকস শিখতাম তখন। ছোট বয়সেই বুঝে ফেললাম হ্যাকিংয়ের জন্য আগে প্রোগ্রামিং শিখতে হবে। অনলাইনে বা সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে যতটুকু সুযোগ পেতাম, চেষ্টা করতাম। এসএসসি শেষ করে ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হই। তখনই আমার প্রোগ্রামিং নিয়ে আগ্রহ দেখে আর জানার পরিধি দেখে আজিমপুরে আমার মামার একটি ট্রেনিং সেন্টার জাতীয় যুব উন্নয়ন কেন্দ্রে ট্রেইনার হিসেবে যুক্ত হই। সেখানে আমি সি প্রোগ্রামিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ওয়েব ডেভেলপমেন্টের ওপরে ক্লাস নেই। এভাবেই ছোটবেলা থেকে এ সেক্টর নিয়ে একধরনের ক্ষুধা জন্ম নেয়।

জাগো নিউজ: অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কীভাবে যাত্রা শুরু করলেন?জুবায়ের হোসেন: আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি; তখনই নিজস্ব বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে নিজের কোম্পানি শুরু করি। এরপর আমার ঝোঁক আসে মোবাইল অ্যাপ নিয়ে। বিভিন্ন প্রোগ্রামিং কন্টেস্টে জয়েন করতাম। তারপর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাজ করার সুযোগ হয়েছে, ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউয়ের জন্য কাজ করেছি। আইসিটি ডিভিশন থেকে পরপর দুবার ফান্ড পেয়েছি। দেশে-বিদেশে অনেক ক্লায়েন্ট যুক্ত হয়ে যায়। ভ্যাট চেকার অ্যাপ, যা বাংলাদেশ সরকারের প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। সিএনজি ভাড়া জালিয়াতি ঠেকাতে সিএনজি মিটার অ্যাপ থেকে শুরু করে কয়েকটি উদ্যোগ নেই। প্রত্যেকটিই মানুষের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়। এরপর আসলে আর আমার পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

জাগো নিউজ: ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম বঙ্গ একাডেমির শুরু এবং এর কার্যক্রম নিয়ে কিছু বলুন—জুবায়ের হোসেন: জুবায়ের অ্যাপ একাডেমি নামে আমার একটি ট্রেনিং সেন্টার ছিল। কিন্তু করোনার সময় যখন সব কিছু বন্ধ; তখন চিন্তা করছিলাম কী করা যায়? যেহেতু আমি ছোটবেলা থেকেই একজন ট্রেইনার। আমার তো শেখাতে ভালো লাগে। এজন্য লকডাউনের সময় অনলাইনে ‘বঙ্গ একাডেমি’ নামে ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি করি। মাত্র ৩ মাস আগে শুরু হওয়া এ অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এখন ২৫০০-এর বেশি মানুষ যুক্ত। মজার ব্যাপার হলো, স্টুডেন্টরা আমাকে ম্যাজিশিয়ান উপাধি দিয়েছে। আমি একদম নামে মাত্র কোর্স-ফি রেখেছি, যাতে নিম্ন আয়ের মানুষও এ কোর্সগুলো করে নিজের স্কিল ডেভেলপ করতে পারে। এছাড়া ফেসবুক গ্রুপের মধ্য দিয়ে সার্বক্ষণিক মনিটর করা হয়। আমার স্বপ্ন বঙ্গ একাডেমি থেকে মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়াবে, কারো মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের যোগ্যতায় কিছু করবে। এ স্বপ্ন নিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

Advertisement

জাগো নিউজ: আপনার কাজের অনুপ্রেরণার জায়গায় কে ছিলেন?জুবায়ের হোসেন: আমার অনুপ্রেরণা আমি নিজেই। স্টিভ জবসকে ভালো লাগে, মার্ক জাকারবার্গকে ভালো লাগে। কিন্তু এমন নয় যে, তাদের আমি অনুসরণ করেছি। আমার কাছে মনে হয়, কাউকে অনুসরণ করে সফল হওয়া যায় না। গতকালের কাজটাকে ছাঁপিয়ে যেতে পারলাম কি না, আগের প্রজেক্টের থেকে আরেকটু ভালো কিছু করতে পারলাম কি না—এটাই আমার কাছে মুখ্য। বিশেষ করে মানুষের জীবনমানের কোনো পরিবর্তনের জন্য আমি কোনো অবদান রাখলাম কি না—আমি সেটাতেই ফোকাস করি।

জাগো নিউজ: বর্তমানে বঙ্গ একাডেমির পাশাপাশি আর কী কী করছেন? জুবায়ের হোসেন: সম্প্রতি বঙ্গ একাডেমির পাশাপাশি আরও দুটো উদ্যোগ রয়েছে। একটি হলো, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের জন্য ‘মাই কোর্ট’ নামে একটি অ্যাপ। যা এরই মধ্যে দারুণ সাড়া ফেলেছে আইনজীবীদের মাঝে। আরেকটি হলো ‘বঙ্গ স্ক্যানার’। অ্যাপটি বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিশ্বের প্রায় ৯২টি ভাষা বুঝতে পারে এ বঙ্গ স্ক্যানার।

জাগো নিউজ: উদ্যোক্তা জীবনে পরিবার থেকে কেমন সহযোগিতা পেয়েছেন?জুবায়ের হোসেন: আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। বাসা থেকে টাকা নেইনি কখনো। কিন্তু বাসা থেকে আমাকে যথেষ্ঠ ছাড় দিয়েছে। কেননা প্রোগ্রামিং অ্যাপ ডেভেলপমেন্টে অনেক সময় দিতে হয়েছে; রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়েছে। এখনও আমার মনে আছে, আমি যখন অফিস নেই; বেশ কম বয়স তখন। সে সময় তারা বেশ চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু তারা আমাকে বিশ্বাস করেছেন। তারা যে আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছেন, এটাই আমার জন্য বড় সাপোর্ট।

জাগো নিউজ: বঙ্গ একাডেমি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?জুবায়ের হোসেন: আমি বঙ্গ একাডেমিকে এমনভাবে সাজাতে চাই, যাতে প্রত্যেক ছেলে-মেয়ের কাছে স্কিল ডেভেলপমেন্টের জন্য সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পৌঁছাতে পারে। আমাদের যে শিক্ষাব্যবস্থা, সেটি আসলে পর্যাপ্ত নয়। প্রতিযোগিতার বাজার এখন, বিশ্ব যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে—আমাদেরও তাল মেলাতে হবে। গ্র্যাজুয়েশন শেষে চাকরির জন্য বসে না থেকে স্কুল-কলেজ থেকেই যে শুরু করা যায়, তা আমি জানাতে চাই। বাংলাদেশের মানুষ যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে—এ লক্ষ্য নিয়ে বঙ্গ একাডেমি কাজ করবে।

Advertisement

জাগো নিউজ: বাংলাদেশি ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মগুলোকে কী পরামর্শ দেবেন?জুবায়ের হোসেন: সবার আগে সার্ভিসের প্রতি খেয়াল রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো ট্রেইনিং যাতে পর্যাপ্ত হয়, মানুষের যাতে উপকার হয়। মানুষ যাতে সার্ভিস নিয়ে দ্বিধায় না থাকে, তা নিশ্চিত করে এগিয়ে যেতে হবে। ই-লার্নিংয়ের জন্য পাইরেসি খুব মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আগামীতে বাংলাদেশে ই-লার্নিং খুব বড় ইন্ড্রাস্ট্রি হতে যাচ্ছে। কিন্তু পাইরেসির জন্য মাথাচাড়া দিয়ে ঠিকমত আগাতে পারছে না। সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি ডিভিশনকে পাইরেসি রোধ করতে এগিয়ে আসতে হবে। সম্ভাবনাময় এ সেক্টরে টিকে থাকতে হলে এর বিকল্প নেই।

জাগো নিউজ: আগামী ৫ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চান? জুবায়ের হোসেন: আমার ক্ষুধা কখনো মিটবে বলে মনে হয় না। তবুও নিজেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেখতে চাই। আমার কোনো উদ্যোগ যেন বিশ্বব্যাপী কাজে লাগতে পারে, বিশ্বের মানুষের যাতে উপকারে আসে—এটাই চাই। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।

এসইউ/এমএস