নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায় গত ৮ জুলাই অগ্নিকাণ্ড ও হতাহতের ঘটনাকে ‘কাঠামোগত হত্যা’ দাবি করে ১০টি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ দিয়েছে নাগরিক তদন্ত কমিটি।
Advertisement
মঙ্গলবার (৩১ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে এ সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদন তুলে ধরে কমিটির আহ্বায়ক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘গত ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস লিমিটেডের একটি কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। বছরের পর বছর কাঠামোগত অবহেলা ও গাফিলতির কারণে বিভিন্ন কারখানায় বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশের নাগরিকদের অধিকার আছে তার জীবন, জীবিকা ও সম্পদের ওপর হুমকি কারা তৈরি করছে এবং এর সমাধানের পথ কী সে বিষয়ে বিশদভাবে অবহিত হওয়া। গত ১৩ জুলাই আগ্রহী নাগরিকদের অংশগ্রহণে এক সভায় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কর্ণগোপ এলাকার হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ও হতাহতের ঘটনায় ১৯ সদস্যের সমন্বয়ে একটি নাগরিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।’
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত ১৭ জুলাই নাগরিক তদন্ত কমিটির সদস্যরা কারখানা স্থল পরিদর্শন করেন। সেদিন এবং পরবর্তী ছয় সপ্তাহে বিভিন্ন দফায় বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে নিহত শ্রমিকদের পরিবার, আহত শ্রমিক, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি এমন জীবিত শ্রমিক, কারখানার কর্মকর্তা, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি এবং প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করি। এছাড়া এ সময় প্রকাশিত সংবাদপত্রের প্রতিবেদন ও ইলেক্ট্রনিক প্রচার মাধ্যমের বিভিন্ন ভাষ্যও আমরা পর্যালোচনা করেছি।
Advertisement
ঘটনা তদন্ত ও পর্যালোচনা করে ১০টি সুপারিশ দেন তারা। এর মধ্যে আছে-
১. বিভিন্ন বিবেচনায় দেখা যায়, কারখানাটি রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে আর্থিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী। এই শিল্প গ্রুপের অধীনে আরও ১০টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কাজেই কোনো যুক্তিতেই কারখানায় ন্যূনতম নিরাপত্তা না থাকা, নিম্ন মজুরি, অনিরাপদ কর্মপরিবেশ তাদের অক্ষমতার ফলাফল নয়, বরং অনিচ্ছা, অবহেলা, জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে মুনাফা বৃদ্ধির তাড়না থেকে এই ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। সেজন্য এটিকে আমরা দুর্ঘটনা না বলে কাঠামোগত হত্যা বলে চিহ্নিত করছি এবং সেভাবেই দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করা আবশ্যক বলে মনে করছি। কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা এবং শ্রমিকদের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করার কারণে যে দুর্ঘটনা ঘটছে তা কার্যত হত্যাকাণ্ড।
২. কারখানা ভবনের নকশা অনুমোদন, অগ্নিনির্বাপণ ও শ্রম আইনের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেনি বলে দায়িত্ব অবহেলাকারী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।
৩. বিদ্যমান আইনের বহুরকম দুর্বলতা ও ঘাটতির অন্যতম দৃষ্টান্ত ক্ষতিপূরণ বিষয়ক আইন। আমরা মনে করি, কর্মস্থলে একজন শ্রমিক যদি নিহত হন তাহলে ক্ষতিপূরণ এমন হতে হবে যা তার বেঁচে থাকলে সারাজীবনের সম্ভাব্য আয়ের বেশি হয় এবং যা কর্তৃপক্ষের জন্য আর্থিক শাস্তিস্বরূপ হয়। শ্রম আইনের বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে নিহত, আহত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিবার প্রতি যথাপোযুক্ত ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে। আহতদের পূর্ণসুস্থতা পর্যন্ত সমস্ত চিকিৎসা ব্যায়, চিকিৎসাকালীন সময়কে সবেতন ছুটি হিসেবে গণ্য করা এবং যথাপোযুক্ত ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে। উক্ত কারখানায় চাকরি করতেন এমন সকল শ্রমিকের বিকল্প কর্মসংস্থান ও কাজ হারানোর ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
Advertisement
৪. কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানে সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে লোকবল বাড়াতে হবে। পরিদর্শকের সংখ্যা ও দক্ষতা বাড়ানো এবং যেখানে আইনের ব্যত্যয় ঘটছে, সেখানে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার মতো সক্ষম করে তোলা প্রয়োজন। অগ্নিনির্বাপণে ফায়ার সার্ভিস এর প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে হবে।
৫. সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মপরিবেশ ও শ্রমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অগ্নি নির্বাপণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখার পাশাপাশি সকল শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৬. কর্মস্থল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়লে বা সেখানে আইনানুগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না হলে, শ্রমিকেরা যেন পরিদর্শন অধিদপ্তরকে যেকোনো সময় অবহিত করতে পারে এবং পরিদর্শন অধিদপ্তর যেন খবর পাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কর্মস্থলে হাজির হয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে, সেজন্য আইনি বিধান রাখা জরুরি।
৭. শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার নিশ্চিত করা এবং অবাধে ইউনিয়ন করার সুযোগ নিশ্চিতে সংগঠকদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা (পেশাগত, আইনি ও সামাজিক) প্রদান করতে হবে।
৮. কর্মস্থলে চিকিৎসা ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে। কারখানা কর্তৃপক্ষকে নিজ খরচে ও দায়িত্বে চিকিৎসা করতে হবে।
৯. শিশুশ্রম নিরসনে প্রধানত দরকার শিশুদের অভিভাবকদের আয় বৃদ্ধি করা। সেজন্য জাতীয় ন্যূনতম মজুরি এমন পর্যায়ে নির্ধারণ করতে হবে, যা দিয়ে তারা শিশুর শিক্ষার পুরো ব্যয় এবং তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও পুষ্টি আংশিক হলেও নিশ্চিত করতে পারেন।
১০. সমগ্র শিল্পখাতে তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত কারখানাসমূহের ভবন নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশ ও শ্রমিক অধিকার, বিদ্যমান আইনের ঘাটতি ও আইন প্রয়োগের দুর্বলতা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যসহ সরকারের পক্ষ থেকে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। বর্তমান বিপজ্জনক, প্রাণঘাতী পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য করণীয় নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করতে হবে।
টিটি/এমএইচআর/এমএস