৩১ আগস্ট ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। গত বছর এই দিন সন্ধ্যায় দিল্লির সেনাহাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এর আগে গত ৯ আগস্ট দিল্লিতে নিজের বাসভবনে বাথরুমে পড়ে গিয়ে তিনি মাথায় আঘাত পান। পরের দিনই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁর মাথায় রক্তজমাট বাধায় অপারেশন করতে হয়।
Advertisement
চিকিৎসাধীন থাকার সময়ই তার কোভিড পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে চিকিৎসায় সামান্য সাড়া দিলেও তিনি ধীরে ধীরে কোমায় চলে যান। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে তিনি ৩১ আগস্ট সন্ধ্যায় জীবনযুদ্ধে পরাজয় বরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতির এক বিশেষ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে। তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
প্রণব মুখার্জিকে বাংলাদেশের জামাই বলা হয়। তাঁর স্ত্রী শুভ্র (ঘোষ) মুখার্জি ১৯৪৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বর্তমান নড়াইল জেলার সদর উপজেলার ভদ্রবিলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম অমরেন্দ্র ঘোষ। ১৯৫৫ সালে ৪ পুত্র ও ৪ কন্যা সন্তানের মধ্য কানাইলাল ঘোষ নামের এক পুত্রকে নড়াইলে রেখে অমরেন্দ্র ঘোষ সপরিবারে ভারতে চলে যান। ১৯৫৭ সালের ১৩ জুলাই ১৪ নছর বয়সে শুভ্রা দেবীর বিয়ে হয় ২২ বছর বয়সী প্রণব মুখার্জির সঙ্গে। ২০১৩ সালের ৫ মার্চ ভারতের রাষ্ট্রপতি থাকাকালে শুভ্রা দেবীকে সঙ্গে নিয়ে নড়াইলে শ্বশুরের গ্রামে এসেছিলেন প্রণব মুখার্জি। তখন তাঁকে নড়াইলবাসী জামাই আদরে বরণ করে নিয়েছিলেন। ১৯৯৫ সালে কন্যা শর্মিষ্ঠাকে সঙ্গে নিয়েও একবার নড়াইল এসেছিলেন শুভ্রা দেবী। ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট শুভ্রা মুখার্জি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
প্রণব মুখার্জি তাঁর পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনে তিনি প্রায় পুরোটা সময় ভারতের সর্বপ্রাচীন রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন। তবে অন্য সব দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ও ব্যক্তিগত হৃদ্যতা ছিল। দলমতের উর্ধে সবার কাছে শ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠা ছিল তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম অর্জন। বলা হচ্ছে, ভারতের জাতীয় জীবনের সব খানেই তাঁর আসন পাতা ছিল। রাজনীতি থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতি, কূটনীতি থেকে চণ্ডীপাঠ সব কিছুতেই তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ ছিল।
Advertisement
মৃত্যুর পর তাঁর বোধ-বুদ্ধি-প্রজ্ঞার প্রশংসা করা হয়েছে সব মহল থেকেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছেন, ‘২০১৪ সালে আমি দিল্লিতে নতুন এসেছিলাম। প্রথম দিন থেকেই তার পরামর্শ, সাহায্য ও আশীর্বাদ পেয়েছি। তার সঙ্গে আলাপচারিতা চিরকাল মনে থাকবে। কয়েক দশকের রাজনৈতিক জীবনে প্রণব মুখোপাধ্যায় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কৌশলগত ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে গিয়েছেন। তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে ছিলেন দুর্দান্ত। সব সময় প্রস্তুতি নিয়ে রাখতেন। তিনি যেমন সুবক্তা ছিলেন, তেমনি ছিল তার রসবোধ'।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি। বঙ্গবাসী এবং বঙ্গভাষী হিসেবে আমরা সবাই গর্ববোধ করি। প্রণবদা ছিলেন রাজনীতির রত্ন। তাঁর মতো রাজনীতিঅন্তপ্রাণ মানুষের জন্য এটাই বোধহয় বড় শিরোপা'।
প্রণব মুখার্জি প্রধানমন্ত্রী ছাড়া ভারতের প্রায় সব শীর্ষ পদে কাজ করেছেন। তার সঙ্গে যারা কাজ করেছেন, তারা সবাই তার অবিশ্বাস্য স্মৃতিশক্তির যেমন প্রশংসা করেছেন, তেমনি এটাও বলেছেন যে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে তার ছিল তীঘ্ন অন্তর্দৃষ্টি। অর্থনৈতিক বিষয়, সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত বিষয়গুলো তিনি গভীরভাবে বুঝতেন।
ক্যারিশমেটিক রাজনৈতিক নেতা বলতে যা বোঝায় প্রণব মুখার্জি তা ছিলেন না। তার আহ্বানে লাখো মানুষের জমায়েতও হয়তো হতো না। খুব জনভিত্তি ছিল না, ছিল না সেরকম কোনো পারিবারিক গরিমা, তবু রূপকথার চেয়ে কম ছিল না তার রাজনীতির যাত্রাপথ। তিনি অতি সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে উঠেছেন নিজের চেষ্টায়।
Advertisement
প্রণব মুখার্জির জন্ম ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর বীরভূম জেলার কীর্ণাহারের কাছে কিরিটি গ্রামে। ভারতের স্বাধীনতা লাভের এক যুগ আগে। তার বাবা স্বাধীনতা সংগ্রামী কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়। তিনি কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিষদের সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে ছাত্র জীবনে প্রণব বাবুর রাজনীতির প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল বলে শোনা যায় না। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছেন গ্রামের এমন এক স্কুলে যেখানে তাকে গামছা পরে নদী পার হয়ে যেতে হতো। সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজের পাঠ চুকিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ইতিহাসে এমএ করে তিনি এলএলবিও পাস করেন। তবে আইন পেশায় তিনি কখনো নিয়োজিত হননি। শিক্ষা শেষে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফে আপার ডিভিশন ক্লার্ক হিসেবে। তারপর শিক্ষকতা করেছেন প্রথমে হাওড়া জেলার বাঁকড়া ইসলামিয়া হাই স্কুলে ও পরে বিদ্যাসগর কলেজে।
কলেজে শিক্ষতার সময়ই তিনি রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। ১৯৬৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়ের বাংলা কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ১৯৬০ সালের ২ জানুয়ারি পু্ত্র অভিজিৎ এবং ১৯৬৫ সালের ৩০ অক্টোবর কন্যা শর্মিষ্ঠার জন্ম। তাই বলা যায়, সংসার জীবনে থিতু হয়েই তিনি রাজনীতির ময়দানে পা রাখেন।
বাংলা কংগ্রেস থেকে মূল কংগ্রেসে যেতে তাঁর বেশি সময় লাগেনি। কংগ্রেস সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নজরে আসেন তিনি ১৯৬৯ সালে। ইন্দিরা গান্ধীর ছিল প্রকৃত জহুরির চোখ। তাই রাজনীতিতে তুলনামূলক নবাগত প্রণব মুখার্জির মধ্যে তিনি ভবিষ্যতের অমিত সম্ভাবনা লক্ষ করেই তাকে কাছে টেনেছিলেন। প্রণব মুখার্জির মধ্যে বারুদ ছিল, সেজন্য জ্বলে উঠতে সমস্যা হয়নি। ১৯৬৯ সালেই তিনি কংগ্রেসের টিকিটে রাজ্য সভার সদস্য নির্বাচিত হন । তারপর ১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৯৩ এবং ১৯৯৯ সালেও রাজ্য সভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে লোক সভার সদস্য হওয়ার জন্য তাকে আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ২০০৪ সালে জঙ্গিপুর থেকে তিনি জয়লাভ করে প্রথমবারের মতো লোক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু ততদিনে তিনি ভারতীয় রাজনীতির এক অপরিহার্য চরিত্রে পরিণত হয়েছেন।
ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৩ সালে তাকে প্রথম কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন শিল্পোন্নয় প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে। পরিশ্রম, নিষ্ঠা এবং ব্যক্তিত্বের কারণে তিনি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্বস্ততা অর্জন করেছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে ইন্ধিরা গান্ধী তার ওপর নির্ভর করতেন। জরুরি অবস্থা জারির পর ইন্ধিরা গান্ধী সমালেচিত হয়েছেন, ১৯৭৭ সালে নির্বাচনে পরাজিতও হয়েছেন। তখন কংগ্রেস নেতৃত্বের কেউ কেউ সুবিধাবাদী অবস্থান নিলেও প্রণব মুখার্জি অত্যন্ত দৃঢভাবেই ইন্দিরার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৮২ সালে কংগ্রেস আবার ক্ষমতায় ফিরলে ইন্দিরা মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন প্রণব মুখার্জি। তিনি তার কর্মদক্ষতার কারণে মন্ত্রিসভায় দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন।
১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর রাজীব গান্ধীর মন্ত্রিসভায় প্রণব মুখার্জির ঠাঁই না হওয়ায় তিনি কংগ্রেস ছেড়ে রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে একটি দল গঠন করলেও খুব সুবিধা করতে পারেননি। ১৯৮৯ সালে আবার কংগ্রেসে ফিরে আসেন। ১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর রাজনীতিতে প্রণব মুখার্জির পুনরুত্থান ঘটে।
নরসিংহ রাওয়ের মন্ত্রিসভায়ও তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৮ সালে সীতারাম কেশরীকে সরিয়ে সোনিয়া গান্ধীকে কংগ্রেসের সভানেত্রী করার ক্ষেত্রে প্রণব বাবু মুখ্য কারিগরের ভূমিকা পালন করেন। ২০০৪ সালে ইউপিএ সরকার গঠনের পর থেকে পরবর্তী মনমোহন সিংহের সরকারে প্রণব মুখার্জি কখনো প্রতিরক্ষামন্ত্রী, কখনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কখনোবা অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
মনোমোহন সিংহের মন্ত্রিসভায়ও তিনি কার্যত দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতেই পরিণত হয়েছিলেন। তবে তার মতো নির্ভরযোগ্য একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে প্রধানমন্ত্রী না করে রাজনীতিতে কম অভিজ্ঞ মনোমোহন সিংহকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসিয়ে কংগ্রেস হাই কমান্ড ঠিক কাজ করেছিল কিনা সে প্রশ্ন আছে। অনেকে এটা মনে করেন যে, প্রণব মুখার্জিকে প্রধানমন্ত্রী করা হলে কংগ্রেসের জন্যই সেটা ভালো হতো।
২০১২ সালে তাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে সম্মানিত করা হলেও এতে প্রণব মুখার্জি খুব খুশি হয়েছিলেন বলে মনে হয় না। তিনি সরাসরি সক্রিয় রাজনীতির মানুষ। কর্মক্ষম থাকা অবস্থায় তাকে রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে হয়। এতে রাষ্ট্রপতি পদের মর্যাদা বাড়লেও কংগ্রেসের রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর হয়েছে বলেই মনে করা হয়।
২০১৭ সালের ২৫ জুলাই তিনি রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ২০১৯ সালে তিনি ভারত রত্ন উপাধিতে ভূষিত হন। এর আগে পদ্মবিভূষণ উপাধিও পেয়েছিলেন।
প্রণব মুখার্জিকে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু মনে করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বিশেষ সম্মাননা দিয়েছে।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার পর তার দুই কন্যা দিল্লিতে আশ্রয় নিলে প্রণব মুখার্জির সঙ্গে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার হার্দিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শেখ হাসিনা তাকে অভিভাবকের মতোই মনে করতেন। প্রণব মুখার্জি প্রথমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এবং পরে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেন। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নে তার ছিল আন্তরিক প্রয়াস। বাংলাদেশের অনেক মানুষের সঙ্গেই তার ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল।
প্রণব মুখার্জি ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধে মানুষ। ভারতের মতো বিশাল দেশের সর্বোচ্চ পদাধিকারী হওয়ার পরও তিনি অতি সাধারণ জীবন যাপন করতেন। তিনি মনেপ্রাণে ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি। পোশাকআশাকেও তিনি ছিলেন সাধারণ। তিনি সব সময় বিতর্ক-বিসংবাদের ঊর্ধ্বে থাকার চেষ্টা করতেন। সব ক্ষেত্রেই একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলতেন। ছোটখাট চেহারার প্রণব মুখার্জি ছিলেন কার্যত অনেক বড় মাপের একজন অসাধারণ মানুষ। রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য তিনি শুধু বাঙালি নয়, সমগ্র ভারতবাসীর কাছেই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।
এইচআর/জেআইএম