‘বায়রাকতার আকিনজি’ তুরস্কের নির্মিত অত্যাধুনিক অস্ত্র। এটি গোটা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সেরা ‘অ্যাটাক ড্রোন’। বিক্রির জন্য উন্মুক্ত ড্রোনটি এয়ার লঞ্চড ক্রুজ মিসাইল বহনে সক্ষম। ড্রোনের উইংস্প্যান ৬৫ ফুট ও এর এন্ডুরেন্স প্রায় ২৪ ঘণ্টা। রেঞ্জ ৩০০ মাইল এবং প্রায় ৪০ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়তে পারে। ইন্টারনাল বে’তে ৪০০ কেজি ও এক্সটার্নাল বে’তে ৯৫০ কেজি অস্ত্র বহনে সক্ষম। ইউক্রেনের নির্মিত দুইটি এআই-৪৫০ টার্বোপ্রোপ ৪৫০ হর্সপাওয়ারের ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে এই ড্রোনে।
Advertisement
গত রোববার (২৯ আগস্ট) দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ টেকিরদাগে এই বিশেষ ড্রোনের উদ্বোধন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান বলেন, আমাদের নতুন ড্রোন এরই মধ্যে বিশ্ব জয় করেছে। তুরস্ক যুদ্ধ ড্রোন প্রযুক্তিতে বিশ্বের শীর্ষ ৩-এ উঠে এসেছে।
এসময় যুদ্ধ ড্রোনটি দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বায়রাকতার আকিনসির প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা (সিটিও) সেলসুক বায়রাক্তার, ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতে, তুরস্কের স্পিকার মোস্তফা সেনটপ, শিল্প ও প্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা ভারঙ্ক, জাতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকর, চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল ইয়াসার গুলার।
এরদোয়ান বলেন, আমাদের লক্ষ্য সশস্ত্র ড্রোন তৈরি করা। বায়রাকতার আকিনজি এই অঞ্চলে বিশ্বাস, শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লড়াই শক্তিশালী করবে। তুরস্ক যুদ্ধ ড্রোনে অগ্রণী হওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশটিকে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে।
Advertisement
তুর্কি প্রেসিডেন্ট বলেন, সশস্ত্র ড্রোন মিশনে ব্যবহারের জন্য সংক্ষিপ্ত রানওয়েসহ বিমানবাহী জাহাজে অবতরণ করতে পারে। তিনি তুরস্কের হোম-সোর্স প্রতিরক্ষা পণ্যগুলোরও প্রশংসা করেন।
প্রতিরক্ষা খাতে সাফল্য উল্লেখ করে এরদোয়ান বলেন, তুরস্ক মানববিহীন আকাশযান প্রযুক্তিতে যে স্তরে পৌঁছেছে তা প্রতিরক্ষা শিল্পে তার সক্ষমতা দেখায়। তুরস্কের নীতি হলো সব প্রযুক্তিকে উপস্থাপন করা, যা মানবতার সুবিধার জন্য বিকশিত হয়।
তুরস্কের প্রতিরক্ষা কোম্পানির উত্পাদিত ড্রোনের বিশ্বব্যাপী চাহিদা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ন্যাটো সদস্য পোল্যান্ডসহ ১০টিরও বেশি দেশের সঙ্গে নতুন রপ্তানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি দেশ তুর্কি ড্রোন কেনার জন্য অপেক্ষা করছে। এটি গুরুত্বপূর্ণ যে, আমাদের জাতীয় প্রযুক্তি মিত্র দেশগুলোর নিরাপত্তায় অবদান রাখে, কিন্তু আমরা আমাদের নিজস্ব কৌশলগত অগ্রাধিকার অনুযায়ী আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
গত ৮ জুলাই বায়রাকতার আকিনসি ৩৮ হাজার ৩৯ ফুট (১১ হাজার ৫৯৪ মিটার)-এ আরোহণ করে তুর্কি জাতীয় বিমান চলাচলের ইতিহাস সৃষ্টি করেছে এবং একটি নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে। এটি ২৫ ঘণ্টা ৪৬ মিনিট উড়ে ৭ হাজার ৫০৭ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে।
Advertisement
ড্রোনটির ডিজাইন, সফটওয়্যার, এভিওনিক্স এবং মেকানিক্স সবই বায়রাকতারের। বায়রাকতার টিবি২ ইউসিএভির চেয়ে উন্নত, যা ইউক্রেন, কাতার, আজারবাইজান এবং পোল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে বিক্রি হয়েছে। গত মে মাসে পোল্যান্ড প্রথম ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্ক থেকে ড্রোন সংগ্রহ করে।
সৌদি আরবও তুর্কি ড্রোন কিনতে আগ্রহী বলে জানা যায়। লাটভিয়াও ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা তুরস্কের ইউসিএভি কেনা দ্বিতীয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্র হতে পারে। আলবেনিয়া বায়রাকতার টিবি২ কিনতে চুক্তি করতে আগ্রহী।
এরদোয়ান জানিয়েছেন, এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে রপ্তানি চুক্তি হয়েছে। অনেক দেশ আমাদের ইউসিএভিগুলোর জন্য অপেক্ষা করছে।
বায়রাকতারের চিফ টেকনোলজি অফিসার (সিটিও) সেলসুক বায়রাকতার বলেন, তারা বায়রাকতার টিবি২-র জন্য ১০টি দেশের সঙ্গে চুক্তি করেছেন। তিনি বলেন, এটি আমাদের রপ্তানি আয়ের ৭০ শতাংশ সুরক্ষিত করবে। বায়রাকতার আকিনজি টিবি২-এর চেয়ে দীর্ঘ, প্রশস্ত ও কৌশলগত কাজগুলো শেষ করবে। এটির ২০ মিটার (৬৫ ফুট) উইংসপ্যান রয়েছে। এটি সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ফ্লাইট কন্ট্রোল এবং ট্রিপল-রিডান্ডেন্ট অটোপাইলট সিস্টেমের জন্য উচ্চ ফ্লাইট নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়। এতে দুটি ৪৫০-হর্স পাওয়ার ইঞ্জিন রয়েছে তবে এটি ৭৫০-হর্স পাওয়ার ইঞ্জিন বা স্থানীয়ভাবে ২৪০-হর্স পাওয়ার ইঞ্জিন দিয়ে সজ্জিত হতে পারে।
আকিনসি বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র বহন করবে, যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ক্ষেপণাস্ত্র যেমন- স্মার্ট মাইক্রো মিউনিশন (এমএএম-এল) তুর্কি ঠিকাদার রোকেটসানের তৈরি। এটি স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সক্রিয় বৈদ্যুতিনভাবে স্ক্যান করা অ্যারে রাডার এবং বায়ু থেকে বায়ু ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সজ্জিত হবে।
এটি স্থানীয়ভাবে তৈরি আরও অনেক ধরনের যুদ্ধাস্ত্র উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম হবে, যেমন রোকেটসান-নির্মিত স্ট্যান্ড-অব মিসাইল, একটি দূরপাল্লার এয়ার-টু-সারফেস ক্রুজ মিসাইল যা ১৫০ মাইল (২৪০ কিলোমিটার) দূরে পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে।
বায়রাকতার জানায়, আকেনসি বাতাসে এবং মাটিতে লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ করতে পারে। এটি যুদ্ধবিমানের পাশাপাশি কাজ করতে পারে এবং উড়তে পারে এবং তুরস্কের বিদ্যমান ড্রোনের চেয়ে বেশি সময় ধরে বাতাসে থাকতে পারে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পশ্চিমা অস্ত্রের ওপর নির্ভরতা কমাতে আঙ্কারা দেশীয় উৎপাদনের নেতৃত্ব নেওয়ার পর থেকে তুরস্ক বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ড্রোন উৎপাদনকারী দেশ হয়ে উঠেছে।
এরদোয়ান বলেন, তুর্কি নিরাপত্তা বাহিনী মানববিহীন বিমান (ইউএভি) যুদ্ধ দেখেছে এবং নিজেদের শক্তির প্রমাণ দিচ্ছে। সিরিয়া, লিবিয়া এবং আজারবাইজানে তার স্থাপনার পর বায়রাকতার টিবি২ বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করে, যা আরও রপ্তানি চুক্তির পথ সুগম করে।
তারা ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশে সংঘর্ষের সময় বাশার আল আসাদ সরকারের স্থলবাহিনীকে ধ্বংস করেছিল। তারা লিবিয়ায় তুরস্কের মিত্রকেও সিদ্ধান্তমূলক বিমান সহায়তা দিয়েছিল এবং গত দুই বছরে পিকেকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সিনিয়র নেতাদের হত্যা করা বিমান হামলা সফলভাবে পরিচালনা করেছিল।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, যদি কেউ আমাদের অঞ্চলের একটি ছোট পাথরও সরিয়ে নিতে চায়, তাকে একবার হলেও ভাবতে হবে, তার সম্মতি নিতে হবে এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য তার পদ্ধতির মূল্যায়ন করতে হবে।
বায়রাকতার এক ঘোষণায় জানায়, টিবি৩ ২০২২ সালে প্রথম ফ্লাইট করবে। এটি একটি আপগ্রেড সংস্করণ। বর্তমানে বায়রাকতার সুবিধায় উন্নয়নের অধীনে, বায়রাকতার টিবি৩ তুরস্কের ফ্ল্যাগশিপ-টু-অ্যাম্বিবিয়াস অ্যাসল্ট জাহাজ টিসিজি আনাদোলুতে টেক অব এবং অবতরণ করতে সক্ষম হবে।
ল্যান্ডিং হেলিকপ্টার ডক (এলএইচডি) বিশ্বের মধ্যে এটির প্রথম জাহাজ বলে মনে করা হয় যা ইউসিএভিগুলোকে তার ডকে অবতরণের অনুমতি দেয়। এটি বহুমুখী কাজে ব্যবহৃত হবে এবং বছরের শেষের দিকে।
বায়রাকতার ২০২৩ সালে স্থানীয়ভাবে মানবহীন যুদ্ধবিমান তৈরি করবে। জেটটি অনেক সামরিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যেমন- কৌশলগত আক্রমণাত্মক, ক্লোজ এয়ার সাপোর্ট (সিএএস), ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ, শত্রুর বায়ু প্রতিরক্ষা দমন এবং শত্রুর বায়ু প্রতিরক্ষা ধ্বংস।
বায়কারের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা (সিটিও) সেলসুক বায়রাকতার প্রসিডেন্ট এরদোগানের জামাতা।
এমআরএম/এএসএম