মো. শরিফুল ইসলাম গ্রামীণ ইউনিক্লোর মার্কেটিং ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত। তরুণ এ পেশাজীবীর জীবনের গল্প, পড়াশোনা, ক্যারিয়ার ও তরুণদের জন্য পরামর্শ সম্পর্কে জানিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বেনজির আবরার—
Advertisement
জাগো নিউজ: আপনার ছোটবেলা ও পড়াশোনার কথা বলুন—মো. শরিফুল ইসলাম: ছোটবেলা কেটেছে আমার জন্মস্থান রাজশাহী জেলার বাগমারা থানার ছোট একটি গ্রামে। বাবা-মায়ের দুই সন্তানের মধ্যে আমি বড়। স্কুল ছিল গ্রামের পাশেই। মচমইল প্রাইমারি স্কুল ও মচমইল হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পড়াশোনা শেষ করি। হাইস্কুলে থাকাকালীন সায়েন্স, বিজনেস স্টাডিজ ও আর্টসের মধ্যে যে কোনো বিভাগে ভর্তি হতে হতো। তবে অন্যদের মতো আমার ওপর কোনো চাপ ছিল না। আমি নিজে থেকে যে বিভাগে পড়তে চাই, সেখানে পড়ার স্বাধীনতা ছিল। তাই নিজের ইচ্ছায় বিজনেস স্টাডিজে পড়া শুরু করি। বিজনেস স্টাডিজ থেকে ভালো ফলাফলে এসএসসি শেষ করি। এরপর সবাই যখন গ্রামের কলেজে ভর্তি হতে শুরু করে; ঠিক তখন আমার স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। তাই সিদ্ধান্ত নেই শহরের কলেজে ভর্তির। ভর্তি হই নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ রাজশাহীতে। মূলত কলেজ লাইফটাই আমার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।
আমি প্রথম স্বপ্ন দেখতে শুরু করি বড় হওয়ার ও জীবনে ভালো কিছু করার। যে মানুষটি আমার প্রেরণা ও স্বপ্ন দেখতে কাণ্ডারীর ভূমিকা নিয়েছিলেন, তিনি হচ্ছেন আমার শিক্ষক প্রয়াত আব্দুস সামাদ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন এবং সব সময় উৎসাহ দিতেন ব্যবসায় শিক্ষায় পড়লে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়তে হবে। তাই স্বপ্ন পূরণে কঠোর পরিশ্রমের ফলাফল হিসেবে সুযোগ পাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে। ঠিক একই সময়ে নির্বাচিত হই আমেরিকার ডিভি লটারিতে। কিন্তু লটারির ভাগ্যের চেয়ে বিশ্বাসী ছিলাম পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত ফলাফলে। তাই আমেরিকার স্বপ্ন বাদ দিয়ে ভর্তি হই স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিভিন্ন এক্সট্রা কারিকুলাম কাজে সম্পৃক্ত ছিলাম। বিশেষত আমি বিতর্কের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমি মুহসীন হল ডিবেটিং ক্লাবের ইংলিশ ডিবেটের কনভেনর ছিলাম এবং ক্লাবের সিনিয়ির ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলাম। পরে মার্কেটিং ডিবেটিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলাম। এছাড়া আরও বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত ছিলাম। প্রতিদিনের পড়াশোনা, টিউশনি, বিতর্ক ও বিভিন্ন কাজে যুক্ত থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ছিল বৈচিত্র্যে ভরপুর। আমি সব সময় বিশ্বাস করি, শেখার শেষ নেই। তাই পরে আইবিএ থেকে আবার এমবিএ শেষ করি।
Advertisement
জাগো নিউজ: ক্যারিয়ারের নানা সময়ে যেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন—মো. শরিফুল ইসলাম: বিবিএ ফাইনাল পরীক্ষার আগেই চাকরির ভাইভার অভিজ্ঞতা নিতে আবেদন করি বসুন্ধরা গ্রুপে। তখন তাদের বিশেষ ডিপার্টমেন্টের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। জীবনে প্রথম চাকরির ভাইভায় সফল হই এবং চাকরি নিশ্চিত হয়। বিবিএ ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে পরদিন জয়েন করি। ছয় মাস চাকরি করার পর এক বছরের ছুটি নেই এমবিএ শেষ করার জন্য। এমবিএ শেষ করার পর আবার জয়েন করি সেখানে। এরপর থেকে শুরু হয় মার্কেটিংয়ে ক্যারিয়ার। গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান চেয়েছিলেন আমি মার্কেটিংয়ে দক্ষ হই। তাই তিনি আমাকে চিফ মার্কেটিং অফিসার সাইফুল ইসলাম হেলালীর অধীনে কাজ করার জন্য দিয়েছিলেন।
আমি মার্কেটিংয়ে সব কাজ শিখেছি হেলালী স্যারের প্রত্যক্ষ দিকনির্দেশনায়। আমি বসুন্ধরা সিমেন্ট ও পেপার সেক্টরে কাজ করেছি। ব্র্যান্ডিং, সেলস, গবেষণা, ইভেন্টস অ্যান্ড অ্যাক্টিভেশন, সিএসআর, পিআর, টিভিসি, প্রেস অ্যাডভারটাইজমেন্ট, এজেন্সি ম্যানেজমেন্ট ও ইন-হাউস ক্রিয়েটিভ ম্যানেজমেন্টের সব কাজ হাতেকলমে শিখতে পারি। মার্কেট বুঝতে সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি। আমি সাধারণত আফিস শুরু করতাম সবাই অফিসে আসার এক ঘণ্টা আগে এবং শেষ করতাম সবাই যাওয়ার পরে। বিশ্বাস করতাম, অফিসে সবাই কাজ করে। কিন্তু সফল হতে সবাই যা করে, আমাকে তার চেয়ে বেশি ও ভিন্ন কিছু করতে হবে। তাই অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতাম কাজ শেখার জন্য। এর জন্য খুব দ্রুতই প্রমোশন পাই।
বসুন্ধরা গ্রুপের পর জয়েন করি আনোয়ার গ্রুপে অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্র্যান্ড ম্যানেজার হিসেবে। দেখতাম আনোয়ার ইস্পাত ও সিমেন্ট। এখানে খুব বেশিদিন থাকিনি। ছয় মাসের মধ্যে চলে আসি আমার বর্তমান কর্মস্থল গ্রামীণ ইউনিক্লোতে। গ্রামীণ ইউনিক্লোর স্টোর উদ্বোধনের শুরুর দিকে সম্পৃক্ত হই এ ব্র্যান্ডের সঙ্গে। ব্র্যান্ডটি দাঁড় করাতে শুরু থেকেই চেষ্টা করেছি অনেক কিছু করতে। জাপান হেডকোয়ার্টারের ব্র্যান্ড গাইডলাইন ও বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হকের তত্ত্বাবধানে ব্র্যান্ডকে দাঁড় করাতে এ প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। এখানে শিখেছি মার্কেটিং, ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা ও জাপানিজ ম্যানেজম্যান্টের নিয়ম-কানুন; যা আমার প্রফেশনাল লাইফে নয় ব্যক্তিগত জীবনের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। গ্রামীণ ইউনিক্লো আমার চাকরির স্থান না, এটি একটি পরিবার। নিজের মতো করে ব্র্যান্ডটিকে ভালোবাসি।
জাগো নিউজ: আপনার বর্তমান প্রতিষ্ঠান একটি আলোচিত ব্র্যান্ড। প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে বলুন—মো. শরিফুল ইসলাম: ইউনিক্লো সোশ্যাল বিজনেস বাংলাদেশ লিমিটেড বাংলাদেশে ‘গ্রামীণ ইউনিক্লো’ ব্র্যান্ড নামে ব্যবসা করছে। এটি জাপানের নাম্বার ওয়ান, বিশ্বের ৩য় বৃহত্তম পোশাক ব্যবসা। এটি ২০১০ সালে যাত্রা শুরু করে গ্রামে গ্রামে নারীদের মাধ্যমে পোশাক বিক্রির মাধ্যমে। পরে ২০১৩ সালে প্রথম শো-রুম উদ্বোধন করে বনশ্রী ও কাঁটাবনে। বর্তমানে আমাদের ১৬টি স্টোর আছে এবং ই-কমার্সের মাধ্যমে সারাদেশে পণ্য ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে। এটি যেহেতু সোশ্যাল বিজনেস সুতরাং জাপান এখান থেকে কোনো মুনাফা ফেরত নিয়ে যাবে না। ব্যবসা থেকে অর্জিত মুনাফা পুরোপুরি ব্যবসায় সম্প্রসারণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সামাজিক উন্নয়নে ব্যয় করছি। আমাদের মূলনীতি আরামদায়ক। তাই আমরা নিশ্চিত করতে চেষ্টা করছি আরামদায়ক পোশাক, আরামদায়ক কেনাকাটা ও আরামদায়ক লাইফস্টাইল।
Advertisement
গ্রামীণ ইউনিক্লো ভবিষ্যতে তিনটি উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করবে:১. প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মানবসম্পদকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ববাজারের উপযোগী মানবসম্পদে পরিণত করা ও সর্বোচ্চ মানের কর্মপরিবেশের মাধ্যমে আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া।২. দেশীয় পোশাক শিল্পের প্রযুক্তি, উৎকর্ষতা ও কমপ্লায়েন্স উন্নয়নের জন্য একসঙ্গে কাজ করা ও গার্মেন্টস শিল্পে নিয়োজিত মানবসম্পদকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া, যা সুস্থ ও সঠিক জীবনযাপনে সহায়তা করবে।৩. অসহায় ও দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করা এবং এর মাধ্যমে তাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে সহযোগিতা করা।
জাগো নিউজ: তরুণ যারা কর্পোরেটে আসতে চান, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?মো. শরিফুল ইসলাম: এখন চাকরির ক্ষেত্রে অনেক প্রতিযোগিতা। সবাই চেষ্টা করে একটি ভালো চাকরির। এ প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে হলে নিজেকে যেমন দক্ষ হতে হবে, ঠিক তেমনই খেয়াল রাখতে হবে বিভিন্ন বিষয়ে। ১. ফোকাস ঠিক রাখতে হবে। প্রথমেই ঠিক করতে হবে আপনি কী হতে চান? ভবিষ্যতে নিজেকে কোথায় দেখতে চান? সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। ২. চাকরির বাজারে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নিজেকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।৩. চতুর্থ শিল্প বিল্পবের কারণে প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। তাই চাকরির মার্কেটে টিকে থাকতে হলে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে দক্ষ হতে হবে।৪. শেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকতে হবে এবং শেখার জন্য বড় বাধা হচ্ছে ইগো আর তাই ইগো দূর করতে হবে। একটি কোম্পানিতে শেখার অনেক জায়গা আছে। একজন জুনিয়রের কাছ থেকেও শেখা যায়। তাই শেখার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। মনের বাধা আগে দূর করতে হবে।৫. চাকরি মানে ৯টা-৬টা দায়িত্ব নয়। যেখানে চাকরি করব; সেখানে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা থাকতে হবে। কোম্পানি ভালো করলে নিজের জন্য ভালো হবে। বিশ্বাস করতে শিখতে হবে কোম্পানির সফলতা মানেই নিজের সফলতা। ৬. কাজের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আবেগের বাইরে প্রফেশনালিজম ডেভেলপ করতে হবে। ৭. নেটওয়ার্কিং বাড়াতে হবে। নেটওয়ার্কিং বাড়লে অনেক কাজ সহজ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে কমিউনিকেশন স্কিল বাড়াতে হবে।৮. পড়াশোনার পাশাপাশি এক্সট্রা কারিকুলাম কার্যক্রমে যুক্ত হতে হবে। কর্পোরেটে সফল হতে হলে এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিজ অনেক ভূমিকা রাখে। এটি আপনার পয়েন্টস অব ডিফারেন্স হিসেবে কাজ করে। ৯. ইংরেজিতে দক্ষ হতে হবে। বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করতে হলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। তাই যোগাযোগের স্কিলটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ১০. সময় ও ডেডলাইনের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। ডেডলাইন পূরণ করতে না পারলে অনেকে বিভিন্ন কারণ ও এক্সকিউজ দেখায়। এটি কখনোই ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে, আমাকে কাজ দেওয়া হয়েছে মানে এটি যে কোনোভাবেই হোক সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে আমাকে করতে হবে। কোনো কারণে না করতে পারলে আগেই জানিয়ে সময় বাড়িয়ে নিতে হবে।
জাগো নিউজ: চাকরিপ্রার্থীদের কী কী বিষয় খেয়াল রাখা উচিত?মো. শরিফুল ইসলাম: নিজেকে ব্যতিক্রমী হিসেবে তৈরি করা। চাকরিপ্রার্থী অনেক। সবারই একটি পরিচয় চাকরিপ্রার্থী। আর তাই অন্যদের মধ্যে থেকে নিজেকে ব্যতিক্রমীভাবে তৈরি করতে হবে। যাতে চাকরিদাতা সহজেই আপনাকে পছন্দ করতে পারে। চাকরিদাতা প্রথমেই অনেক প্রার্থীকে সিলেকশনে না গিয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রার্থীদের বাদ দেয়। তাই নিজেকে বাদের খাতায় রাখা যাবে না। চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় স্কিলগুলো রপ্ত করতে হবে- ডিজিটাল, আইটি, ইংরেজি, কমিউনিকেশন ও পদ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা। ইন্টারভিউয়ের সময় নিজেকে আত্মবিশ্বাসী হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনেক চাকরিপ্রার্থী অনেক নার্ভাস থাকে ভাইভা বোর্ডে। এ সমস্যা দূর করতে হবে। সবাই এমন একজনকে নিয়োগ দিতে চান, যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের কাজ সম্পন্ন হয়। আর তাই কাজের প্রতি ভালোবাসা এর বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে ইন্টারভিউ বোর্ডে।
এসইউ/জেআইএম