আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা উপস্থিতির সময়সীমা শেষ হওয়ার পথে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, তিনি ৩১ আগস্টের মধ্যেই সব সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করতে চান। গত বৃহস্পতিবার (২৬ আগস্ট) দুটি আত্মঘাতী বোমা হামলায় ১৩ মার্কিন সেনাসহ কমপক্ষে ১৭৫ জন নিহত হওয়ার পরও তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র আগের সময়সীমা মেনে চলবে।
Advertisement
তিনি বলেন, এই হামলা লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার গুরুত্বকেই প্রকাশ করছে। যত দ্রুত সম্ভব এবং যতটা সম্ভব দক্ষতার সঙ্গে এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু মিত্র দেশ যেমন ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস এবং তুরস্ক তাদের ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। মার্কিন সেনারাও চলে যেতে শুরু করেছে। যুক্তরাজ্য ইতোমধ্যেই বেসামরিকদের সরিয়ে নিয়েছে। এবার শুধু কয়েকটি ফ্লাইটে তাদের কূটনৈতিক কর্মকর্তা এবং সেনা সদস্যদের সরিয়ে নেওয়া হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের শেষ বিমানটি আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়া আগের মুহূর্ত কেমন হতে পারে? তা নিয়েই এখন জল্পনা শুরু হয়েছে। ব্রিটেনের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের বেন ব্যারি বলেন, প্রবেশ করা বেশ সহজ, বিশেষ করে আপনি যদি শত্রু পরিবেষ্টিত হন এবং শুধু আকাশপথেই সেখান থেকে সরে আসতে হয় তবে সেখান থেকে বের হয়ে আসা বেশ কঠিন।
ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতার কথা ভেবে দেখুন। ১৯৭৫ সালের ২৯ এপ্রিল যখন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড হেলিকপ্টার যোগে সাইগন থেকে চূড়ান্তভাবে অপসারণের আদেশ দেন, তখন এক হাজারেরও বেশি মার্কিন নাগরিক শহরে ছিলেন। সশস্ত্র বাহিনীর রেডিওতে বিং ক্রাজবির ‘হোয়াইট ক্রিসমাস’ গানটি বাজানো হচ্ছিলো, শহরের আশেপাশের নির্ধারিত পয়েন্টে গিয়ে বাসে ওঠার জন্য বিদেশিদের সংকেত দেওয়া হচ্ছিলো। তাদেরকে তান সোন নাট বিমানবন্দর বা নিকটবর্তী মার্কিন দূতাবাসে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা হেলিকপ্টারে অবতরণের জন্য গাড়ী পার্কিংয়ের গাছ ভেঙে ফেলেছিল। শেষ দুই দিনে ৭ হাজার ৮শ জনকে বিমান-ক্যারিয়ারে বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়। শেষদিন ভোরের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত যখন দূতাবাসের ভাঁজ করা পতাকাটি নিজের বাহুতে আটকে আকাশে উড়াল দেন, তখন প্রায় পাঁচশ ভিয়েতনামি দূতাবাসের কমপাউন্ডে ছিল। তার চলে যাওয়ার সাথে সাথে বাইরের ভিড় গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে।
Advertisement
যুক্তরাষ্ট্র এখন আফগানিস্তানে সামরিক পরিভাষায় ‘ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকা পরিসীমায়’ অবস্থান করছে। কাবুল বিমানবন্দরে হাজার হাজার মার্কিন সেনা টহল দিচ্ছে, কখনও কখনও তাদের মাত্র কয়েক মিটার দূরে টহল দিচ্ছে তালেবান যোদ্ধারা। তারা শৃঙ্খলা বজায় রাখছে। যেন ১৬ আগস্টের মতো রানওয়েতে মানুষের ঝাঁপিয়ে পড়া, বিমানের চাকায় পিষ্ট হওয়ার মতো দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়। যত বেশি সৈন্য চলে যাবে, মর্কিন সৈন্যদের পক্ষে নিজেদের পরিসীমা রক্ষা করা ততো বেশি কঠিন হয়ে পড়বে। ব্যারি বলেন, যে মুহূর্তে শেষ ৬০ জন সৈন্য শেষ ফ্লাইটে থাকবে, এটি হবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
অপসারণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর ফিল্ড ম্যানুয়ালে বলা হয়েছে, ‘এ রকম ক্ষেত্রে একটি কার্যকর কৌশল হলো একটি রাইফেলধারী সেনাদল ছাড়া সকলকে সরিয়ে নেওয়া এবং এই বাহিনীকে বের করে নেওয়ার জন্য বিমান বা জাহাজ প্রস্তুত রাখা। ওই সেনাদলকে সুরক্ষা দেওয়ার একটি উপায় হলো বিমানশক্তি। কাবুলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচুর গানশিপ ও যুদ্ধবিমান রয়েছে। পারস্য উপসাগরের ঘাঁটি বা আরব সাগরের বিমানবাহী জাহাজ থেকে আরও বিমান পাঠানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বিপুল সংখ্যক বেসামরিক লোকের বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা যায় না। কার্যত যুক্তরাষ্ট্র নিজের সামর্থ্যে আফগানিস্তান থেকে বের হতে পারবে না, তাদেরকে তালেবানদের সহযোগিতার উপর নির্ভর করতে হবে।
জোনাথন শ' একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা যিনি ২০০৭ সালে ইরাকের বসরা থেকে ব্রিটেনের সেনা প্রত্যাহার তত্ত্বাবধান করেছিলেন বলেছেন যে, এটা শান্তিপূর্ণভাবে করা সম্ভব হয়েছিল, কারণ আমরা স্থানীয় বাহিনীর সাথে সমঝোতা করে তাদের সহযোগিতা নিয়েছিলাম। আমরা চিন্তা করেছি যে তারা আরও রক্তক্ষয় ও প্রাণহানি এড়াতে চাইবে।’ সে লক্ষ্যেই আমেরিকান জেনারেলরা কাতারের দোহায় তালেবান কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। ২৩ আগস্ট সিআইএ প্রধান বিল বার্নস কাবুলে তালেবানের সহ প্রতিষ্ঠাতার সঙ্গে দেখা করেন।
যুক্তরাষ্ট্র বিশেষভাবে চেষ্টা করছে তালেবানরা যেন ইসলামিক স্টেটের স্থানীয় শাখার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় এবং আরও হামলার হুমকি রোধ করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, ‘এটা তাদের করতে হবে তাদের স্বার্থেই যেন আমরা যথাসময়ে চলে যেতে পারি। তারা বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়, আমরাও চলে যেতে চাই। সুতরাং আমাদের লক্ষ্য এক, তাই একসাথে কাজ করতে হবে।’ বাইডেনের বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে পশ্চাদপসরণ সমঝোতামূলক ও সহযোগিতার মাধ্যমে হবে। জো বাইডেন আরও বলেন ‘শেষ আমেরিকান সৈন্য যখন বিমানে চড়ে আকাশে উড়বে, তখন জনণের নিয়ন্ত্রণ তালেবানদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে। এটা খুব চমৎকার ক্ষমতা হস্তান্তর হবে।’
Advertisement
সেনা প্রত্যাহার একমাত্র সমস্যা নয়। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তালেবান বিপুল সংখ্যক মার্কিন যন্ত্রপাতি ও অস্ত্রশস্ত্র দখল করেছে ও পরিচালনা করছে। তাই পেন্টাগন সম্ভবত চাইবে বিমানবন্দরে রেখে যাওয়া মূল্যবান কিছু সরঞ্জাম ধ্বংস করে দিতে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বিমান হামলা করলে তা শুধু বেসামরিক জনগণের জন্যই ঝুঁকিই সৃষ্টি করবে না, তালেবানও তাতে ক্ষুব্ধ হবে। যুক্তরাষ্ট্রের রয়ে যাওয়া সহযোগীদের দেশ ত্যাগে বাঁধা দিয়ে তারা এর প্রতিশোধ নিতে পারে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট
ফারুক ফেরদৌস/টিটিএন/জেআইএম