ফিচার

গ্রাম নয় যেন মৃৎশিল্পের শহর

প্রত্যেক দেশের নিজস্ব প্রাচীন বা ঐতিহ্যময় পেশা থাকে। বাংলাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যের পেশা মৃৎশিল্প। সারা দেশব্যাপী আছে এর কদর। দেশের বাইরেও এখন রপ্তানি হচ্ছে মৃৎশিল্প।

Advertisement

বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারাতে বসেছে এই শিল্প। শুধু পহেলা বৈশাখ আর বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদার উপরেই টিকে আছে মৃৎশিল্পীদের ভাগ্য।

আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম, মেলামাইন ও স্টিলের জিনিসপত্র তৈরি হওয়ায় বর্তমানে মাটির হাঁড়ি, কলসি ও বাসনের উপযোগিতা হারাতে শুরু করছে।

বাংলাদেশের আনাচে কানাচে আছে মৃৎশিল্পীদের বসবাস। বগুড়ার গাবতলী উপজেলার সোনারায় ইউনিয়নের বামুনিয়া পালপাড়া তেমনই একটি গ্রাম। সেখানে গেলেই নাকে ভেসে আসে সোদা মাটির গন্ধ। চোখে পড়ে সারি সারি মাটির টপ, দইয়ের পাত্র, হাঁড়ি-পাতিল।

Advertisement

মনে হয় গ্রামটি যেনো মৃৎশিল্পের শহর। এখানে প্রায় ৫০০ পরিবার মৃৎশিল্প পেশার সঙ্গে জড়িত। গ্রাম ঘুরে মৃৎশিল্পের অতীত ও বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়, বছরজুড়ে টুকটাক বেচাকেনা হলেও মূল ব্যবসা হয় বৈশাখী মেলা ও বিভিন্ন গ্রাম্য মেলাগুলোতে।

তবে করোনার প্রকোপে মেলা না হওয়াতে এবার ব্যবসার মুখও দেখেননি তারা। এখন শুধু দই আর নার্সারির টপের উপরই নির্ভর করছে তাদের ব্যবসা। অনেকেই বাপ দাদার বংশ পরম্পরায় এই পেশা ছেড়ে বেছে নিচ্ছেন অন্য পেশা।

বামুনিয়া গ্রামের মৃৎকারিগর পুস্প রানী (৬০) বলেন, ‘হামরা (আমরা) প্রায় ছোট থেকেই এই কাজ করি। বংশের ধারা হিসেবে এখনও এই কাজ করে যাচ্ছি। সোমী (স্বামী) মরার পর থেকে মাটির জিনিস বেচেই সংসার চালাচ্ছি। তবে হামার ছোলকে হামী পড়াশোনা করাচ্ছি, যেন ভালো একটা চাকরি পায়। মাটির জিনিস পাত আর আজ্ঞার (আগের) লাহ্যান (মত) বেচা হয় না। তাই হামি চাই হামার ছোল অন্য কাজ করুক’।

অন্যদিকে আরেক মৃৎকারিগর সূর্য রানী (৭০) বলেন, ‘আজ্ঞের লাহান ব্যবসা আর নাই। দুই বছর হলো মেলা হয় না। ব্যবসাপাতি কমে গেছে। মাটির জিনিসপাতি এখন মানুষ আর লিবের (নিতে) চায় না। কোনো মতো জীবন পার করছি’।

Advertisement

গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখা যায়, মৃৎকারিগররা সবচেয়ে বেশি তৈরি করেন নার্সারির টপ ও দইয়ের হাড়া। এগুলো প্রতি পিছ ৩ টাকা করে বিক্রি হয়।

পাশাপাশি তারা তৈরি করেন হাঁড়ি-পাতিল, বাসন-কোসন, চাড়ি, কলসি, বদনা, খানদা, ফুলের টব, ফুলদানি, জীবজন্তু, পাখির অবয়ব, সাজসজ্জা, অলংকারসহ নানা রকম মাটির জিনিস। এসব জিনিসের দাম প্রকারভেদে ৩-১০০০ টাকা পর্যন্ত।

আরেক কারিগর খোকন কুমার পাল বলেন, ‘বাপ-দাদার রেখে যাওয়া এই পেশা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। তবুও আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি পেশাটি টিকিয়ে রাখতে’।

বগুড়ার গাবতলী উপজেলার সোনারায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: মফিদুল ইসলাম জানান, ‘এ গ্রামে প্রায় ৫০০ পরিবার মাটির জিনিস পাতি তৈরি করেন। তারা সবাই প্রায় নিম্ন-বিত্ত। তাদের জীবন মান উন্নয়নের জন্য আমরা নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি।’

‘যাদের একেবারেই জমি নেই তাদের আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ঘর প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও তাদের বয়স্ক ভাতা সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। করোনার সময় যারা খাবার পায়নি তাদের সরকারি খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে।’

মো: মফিদুল ইসলাম আরও বলেন, ‘এই পালপাড়া আমাদের বগুড়া জেলার একটা ঐতিহ্য। আমরা নানাভাবে চেষ্টা করছি তাদের পেশা ও তাদের টিকিয়ে রাখতে।’

মৃৎশিল্প আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। এই পেশাকে টিকিয়ে রাখা ও এসব মাটির তৈরি জিনিস ব্যবহার করা আমাদের দায়িত্ব। তাহলেই টিকবে বিলুপ্তের পথে যাওয়া এই মৃৎশিল্প।

তবে আশার কথা হলো, বর্তমানে মৃৎশিল্পের নানা নকশার পণ্যসামগ্রীর কদর বেড়েছে আগের তুলনায়। সনাতন পদ্ধতিতে হাত বা চাকার পরিবর্তে এখন অনেকেই ব্যবহার করছেন আধুনিক প্রযুক্তি।

লেখক: ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী

জেএমএস/এমএস