দেশে বর্তমানে ইটভাটার সংখ্যা প্রায় সাড়ে আট হাজার। এর প্রায় ৭০ শতাংশই অবৈধ। যেখানে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে কাঠ। মালিকদের সামাজিক অবস্থান এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে এসব অবৈধ ইটভাটা। যা আইনের তোয়াক্কা না করে স্থাপন করা হয়েছে লোকালয়, কৃষি জমি, পাহাড়ের ঢালে এবং বনাঞ্চলের আশেপাশে।পরিবেশবিদদের মতে, অতিসত্ত্বর এ সেক্টরে সরকারি নিয়ন্ত্রণ জোরদার না করলে ভেঙ্গে পড়বে পরিববেশের ভারসাম্য। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকার নিষিদ্ধ চিমনি ব্যবহার করে, অবৈধভাবে কৃষি জমি এবং লোকালয়ে স্থাপন করা হয়েছে ইটভাটা। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নোয়খালী, চাঁদপুর, ফেনী, লক্ষ্মীপুরসহ বিভিন্ন জেলার উপর দিয়ে যাওয়া মহাসড়কের দুই পাশে দেখা যায় ইটভাটার সারি। যেগুলোতো এখনো নিষিদ্ধ চিমনি ব্যবহার করে চলছে ইট পোড়ানো। নোয়াখালী জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, নোয়াখালীতে ১৫৭টি ব্রিক ফিল্ডের মধ্যে প্রায় ১২০টির কাগজপত্র নিয়মিত আছে। বাকিগুলো নিয়মিতকরণের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।গত বছর এসব এলাকায় বসবাসকারী লোকজন পরিবেশ দূষণসহ নানা দুর্ভোগের শিকার হয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করে স্মারকলিপি দিয়েছেন।নোয়াখালীর পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব জসিম উদ্দিন মিলন বলেন, আন্দোলনের ফলে গত বছরের দাবিগুলোর আংশিক পূরণ হয়েছে। তবে অতিরিক্ত ইট ভাটার কারণে এলাকার জনজীবন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জানা গেছে, দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলায় ইটভাটার সংখ্যা প্রায় ৫০টি। এর মধ্যে অনেক ইট ভাটারই বৈধ কাগজ ও পরিবেশ অধিদফতরের কোনো অনুমোদন নেই। এসব পুরনো চিমনি পদ্ধতিতে ইট পোড়ানোর কাজ চলে। অধিকাংশ ভাটার মালিক স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ায় অপরিকল্পিতভাবে ভাটা গড়ে উঠলেও সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না। ইটভাটায় কয়লা পোড়ানোর আইনগত নির্দেশ থাকলেও সুযোগ পেলেই ভাটায় কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরি করা হচ্ছে।উন্নত প্রযুক্তিতে রূপান্তিত না হওয়ার কারণে পরিবেশ বিধিমালা লঙ্ঘন করে পার্বতীপুরের ইট ভাটাগুলোতে অবাধে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। সরকারি বিধান অমান্য করে বসতবাড়ির আশেপাশে ও কৃষি জমিতে গড়ে ওঠা ইটভাটা গুলোতে আইন না মেনে কাঠ পুড়িয়ে ফলজ বৃক্ষ ধ্বংস ও পরিবেশ দূষণ করা হচ্ছে। ফলে এলাকার জনস্বাস্থ্য বিশেষ করে শিশু ও কিশোররা হুমকির মুখে পড়েছে।অন্যদিকে রাজশাহী অঞ্চলের আম চাষিরা প্রতিবছরই অভিযোগ করেন- ইট ভাটার কারণে আমের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হন তারা। এ বিষয়ে পরিবেশবাদি সংগঠন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বলেন, দেশের অধিকাংশ ইটভাটায় আধুনিক প্রযুক্তির পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে ১২০ ফুট উচ্চতার স্থায়ী চিমনি বা সম্পূর্ণ অবৈধ ড্রাম চিমনি। জ্বালানি হিসেবে অবাধে ব্যবহার হচ্ছে কাঠ। ফলে এসব ইটভাটা পরিবেশগত বিপর্যয়সহ জনস্বাস্থ্যের জন্যে মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ইটভাটার দূষণ বন্ধে অবিলম্বে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।তিনি আরো জানান, অবৈধ ইটভাটার মধ্যে এক হাজার ৯০০টিতে রয়েছে ড্রাম চিমনি। এসব ড্রাম চিমনিবিশিষ্ট ইটভাটাতেই মৌসুমে কাঠ পুড়ছে ২৫ লাখ ৫২ হাজার ৯৬০ মেট্রিক টন। এছাড়া অন্যান্য পদ্ধতির ভাটায় মৌসুমে গড়ে কাঠ পুড়ছে ৪৮ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন।পরিবেশবিদদের মতে, দেশে গাছ লাগনো সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হলেও নির্বিচারে ইটভাটায় কাঠ পোড়ানোর কারণে এর সুফল পাচ্ছে না মানুষ। বরং পরিবেশ দূষণের কারণে জমির উর্বরতা হ্রাসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা।২০১৩ সালের ২০ নভেম্বর বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩’ প্রকাশিত হয়। নতুন আইনের ধারা-১ এর উপধারা-২ অনুয়ায়ী ২০১৪ সালের ১ জুলাই থেকে এটি কার্যকর করার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত রয়েছে। নতুন আইন অনুযায়ী দেশের সকল পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন এলাকার ইটভাটা ৩০ জুনের মধ্যে বন্ধ অথবা অন্যত্র স্থানান্তর করার জন্য নির্দেশনা রয়েছে। ইটভাটা মালিকদের এ কাজে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)র ঋণ সহায়তা প্রদানের ঘোষণা সত্ত্বেও আধুনিক পদ্ধতিতে পরিবেশবান্ধব ইটভাটা স্থাপনে এগিয়ে আসেনি ভাটা মালিকরা।এছাড়া পুরাতন আইন অনুযায়ী বিদ্যমান ১২০ ফুট উচ্চতার স্থায়ী চিমনি বিশিষ্ট ইটভাটাসমূহকে ৩০ জুন/১৪ পর্যন্ত ২ লাখ টাকা জরিমানা সাপেক্ষে পরিচালনার যে অনুমতি ছিল ১ জুলাই থেকে নতুন আইন বাস্তবায়নের কারণে সেটি আর কার্যকর নেই। নতুন আইন বাস্তবায়ন ও কার্যকরের কারণে দেশের প্রতিটি ইটভাটা আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতেই নির্মাণ ও পরিচালনার নির্দেশ রয়েছে। এ বিষয়ে সকল জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশনাও পাঠানো হয়েছে।পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. নুরুল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ইটভাটা আইন অনুযায়ী ইতোমধ্যে ৫০ শতাংশ ভাটায় এ আইন কার্যকর করা হয়েছে। বাকিগুলোও যতদ্রুত সম্ভব কার্যকর করা হবে। তিনি বলেন, সরকার পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতার সাথেই সব ব্যবস্থা নিচ্ছে।এএম/এসএইচএস/আরআইপি
Advertisement