নড়াইলে চলমান খরিপ-২ মৌসুমে ইউরিয়াসহ টিসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) ও এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) সারের সংকট দেখা দিয়েছে। খুচরা বাজারে দোকানে এসব সার পাওয়া যাচ্ছে না বললেই চলে। কোথাও পাওয়া গেলেও তা কেজিতে পাঁচ থেকে ১০ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। ফলে রোপা আমন, চলমান সবজিসহ আগাম শীতকালীন শাক-সবজি ও মৎস চাষ ব্যহত হচ্ছে বলে দাবি কৃষকদের।
Advertisement
রোপা আমন চাষিরা বলছেন, এখন তাদের ইউরিয়া সারের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এই মুহূর্তে সার না পাওয়া গেলে আমন ফসলে মার খেতে হবে।
তবে নড়াইল কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের দাবি, জেলায় ইউরিয়া ছাড়া অন্য কোনো সারের ঘাটতি নেই। আর দু-এক দিনের মধ্যে ইউরিয়া সার নড়াইলে ঢুকলে সেই সংকটও থাকবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জেলার ৩৯টি ইউনিয়ন ও তিনটি পৌরসভায় মোট ৪২ জন বিসিআইসির (বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন) সার ডিলার এবং প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে সাব-ডিলার রয়েছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বছরে তিনটি মৌসুমে কৃষকের চাহিদা বিবেচনা করে জেলায় সারের চাহিদা দিয়ে থাকেন এবং সে অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া হয়। বিসিআইসির ডিলাররা যশোর বাফার গুদাম (বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার) থেকে ইউরিয়া এবং বিএডিসির (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন) নড়াইলের গুদাম থেকে নন ইউরিয়া (টিএসপি, এমওপি ইত্যাদি) সার উত্তোলনের মাধ্যমে বিক্রি করে থাকেন। নড়াইলে বিএডিসির সার ডিলার রয়েছেন ১৮ জন।
Advertisement
জানা গেছে, এবার জেলায় ৪২ হাজার ২৫ হেক্টর জমিতে রোপা আমনের চাষ হয়েছে। রোপা আমনের বীজতলা তৈরি, চারা রোপনসহ ধান চাষের কয়েকটি পর্যায়ে, শাক-সবজি ও মৎস চাষে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে আগস্টের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ জুড়ে আমন ধান রোপন করার সময় ইউরিয়া সারের খুব দরকার হয়। কিন্তু নড়াইল সদর, কালিয়া ও লোহাগড়া উপজেলার সব জায়গায় ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সারের সংকট দেখা দিয়েছে। খুচরা বাজারে ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা টিএসপি ১ হাজার ১০০, এমওপি ৭৫০ এবং ইউরিয়া ৮০০ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা।
সদরের বাহিরডাঙ্গা গ্রামের বিমল সিংহ জানান, নড়াইল শহরের খুচরা সারের দোকানগুলোতে ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সার পাওয়া যাচ্ছে না। আর কোথাও কোথাও পাওয়া গেলেও কেজিতে ৫ টাকা বেশি দিয়ে সার কিনতে হয়েছে।
কালিয়া উপজেলার পুরুলিয়া গ্রামের কৃষক মশিয়ার রহমান জানান, চাঁচুড়ি ও পুরুলিয়া ইউনিয়নের কোথাও ইউরিয়া ও নন ইউরিয়া সার পাওয়া যাচ্ছে না।
লোহাগড়া উপজেলার মিঠাপুর বাজারের সারের সাব ডিলার সফিয়ার রহমান জানান, ডিলাররা আমাদের ১৫ দিন কোনো সার দিচ্ছে না। শুনেছি তারা রাতের আঁধারে সার বেশি দামে অন্যত্র বিক্রি করে দিচ্ছে।
Advertisement
শহরের রূপগঞ্জ বাজারের সাব ডিলার ইব্রাহীম বিশ্বাস বলেন, দোকানে কোনো সার নেই। ডিলাররা সার দিচ্ছেন না।
অন্য এক খুচরা সার ব্যবসায়ী জানান, ১৫ দিন ধরে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সারের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। খুচরা এসব সার বাজারে কেজিপ্রতি গড়ে ৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। ভিন্ন জায়গা থেকে খুচরা সার ব্যবসায়ীরা সার এনে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করছে বলে তিনি জানান।
নড়াইলে কর্মরত এক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বাজারে খরিপ-১ মৌসুমের চেয়ে খরিপ-২ মৌসুমে সার কম বিক্রি হয়। এ কারণে অধিকাংশ ডিলার বাফার গুদাম থেকে সার উত্তোলন করে ওখান থেকেই সার বিক্রি করে দিয়ে আসেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন নড়াইল জেলা কমিটির আহ্বায়ক খন্দকার শওকত বলেন, সদরের ভদ্রবিলা বাজারে আমি নিজেই ইউরিয়া সার কিনতে গিয়ে পাইনি। এই সার সংকটের পেছনে ডিলারদের কোনো কারসাজি আছে কি-না তা প্রশাসনের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
জানতে চাইলে বিসিআইসির সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব খান বুলু বলেন, কার্গো সমস্যার কারণে নদী পথে নওয়াপাড়া বাফার গুদামে সার আসতে দেরি হচ্ছে। সমস্ত ডিলার তাদের বরাদ্দের অর্থ জমা দিয়ে বসে রয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে সার নড়াইলে ঢুকলে আর কোনো সমস্যা হবে না। এছাড়া নন ইউরিয়া সারের কোনো সংকট নেই বলে দাবি করেন তিনি।
নড়াইল বিএডিসির উপ-সহকারী পরিচালক (সার) সুভাস চন্দ্র সরকার জানান, গত জুলাই ও আগস্ট মাসে টিএসপি ৯১৭, এমওপি ৫৬৩ এবং ডিএপির ১ হাজার ৪৪২ মেট্রিক টন চাহিদা ছিল, যার সবই বরাদ্দ পাওয়া গেছে এবং ৪২ জন ডিলার মাল উত্তোলন করেছেন। নন ইউরিয়া সারের কোনো সংকট নেই বলেও তিনি দাবি করেন।
এ বিষয়ে জেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব নড়াইল কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক দীপক কুমার রায় বলেন, আগস্ট মাসে জেলায় ইউরিয়া সারের ৩ হাজার ১০১ মেট্রিক টন চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দ পাওয়া গেছে ১ হাজার ৮৮৩ মেট্রিক টন। এ পর্যন্ত উত্তোলন করা হয়েছে ১ হাজার ৩৫০ মেট্রিক টন। বাকি সার উত্তোলনের জন্য ডিলাররা চাহিদাপত্র ও টাকা জমা দিয়েছেন। আগামী আট দিনের মধ্যে জেলার চাহিদার সব সার ঢুকবে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, ইউরিয়া বা নন ইউরিয়া কোনো সারের সংকট কথা এ পর্যন্ত কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। তবে কার্গো সংকটে মংলা বন্দর থেকে নওয়াপাড়া এবং সেখান থেকে যশোর বাফার গুদামে সার এসে পৌঁছাতে একটু দেরি হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, সার মজুত বা অন্য জেলায় সার বিক্রির কোনো সুযোগ নেই।
হাফিজুল নিলু/এমআরআর/এএসএম