জাফর ওয়াজেদ
Advertisement
সেই বিশ শতকের ষাটের দশকেও বাংলা বাগধারা ‘মগের মুল্লুক’র বেশ প্রচলন ছিল। পাকিস্তানি জান্তা শাসক আইয়ুব খানের শাসনকেও ইঙ্গিত করা হতো, ‘মগের মুল্লুক পেয়েছে’ বলে। মগের মুল্লুক মানে অরাজকতা, অস্থিরতা, অব্যবস্থা, কুশাসন, নৃশংসতায় পূর্ণ রাজ্য। নৌপথে মগেরা চলাচল করত। নৃশংস, একরোখা এই জলদস্যুরা ডাঙায়ও লুটপাট চালাত। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অপহরণ করে নিয়ে ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী হিসেবে বিক্রি করত। মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালোবাসা নামক শব্দগুলো এদের জীবনাচরণে কখনই প্রতিফলিত হয়নি। আরাকান ছিল এদের নিবাস। পর্তুগিজ জলদস্যুদের সঙ্গে একত্র হয়ে এরা নদীপথে ঘুরে বেড়াত আর দস্যুবৃত্তি চালাত। মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যার মধ্যে তাদের পুলক জাগত। রক্তের স্বাদ নিতে তাদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠত না। মগেরা আরাকানের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও আরাকানের পুরো অধিবাসী জলদস্যু ছিল না এবং তারা মগও নয়।
এদের নিয়ে বাংলায় অনেক ছড়া আছে। শিশুদের ভয় জাগাতে এদের নাম নেওয়া হতো। এরা বাংলার প্রায় সব উপকূলীয় অঞ্চলে হানা দিত। লুটপাট ছাড়াও মানুষকে অপহরণ করা, গ্রামীণ ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগও করত। এদের দৌরাত্ম্য মোগল আমলের বাংলার রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। নৌযানে চড়ে বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী ঘরবাড়ি, দোকানপাটে লুটতরাজ চালানো তাদের প্রায় নিত্যকর্মে পরিণত হয়েছিল। এদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সেই মোগল আমলেই ঢাকায় নানা নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হলে দস্যুবৃত্তি কিছুটা হ্রাস পায়। শাঁখারিবাজারের শাঁখারিদের বাড়িঘর এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল, যার সিঁড়িগুলো ছিল অপ্রশস্ত। একসঙ্গে দুজন মানুষ ওঠানামা করা যায় না। মগ জলদস্যুরা যাতে শাঁখারিদের ধরে নিয়ে যেতে না পারে, সেজন্য সিঁড়িগুলো প্রশস্ত করা হতো না। বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী অন্যান্য ভবনও অনুরূপ ছিল।
১৬৬৬ সালে ঢাকার মোগল সুবেদার শায়েস্তা খানের নৌবাহিনী ষষ্ঠদশ শতক থেকে আরাকানরাজের দখলে থাকা চট্টগ্রাম উদ্ধার করেন। সেখানে মোগল আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হলেও আরাকানি মগদের বিচ্ছিন্ন আক্রমণে চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জনজীবন হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। ইউরোপীয় বণিকরাও মগদের আক্রমণ থেকে অব্যাহতি পায়নি। ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাদেশের নবাব মীর কাশেমের কাছ থেকে চট্টগ্রাম, মেদিনীপুর ও বর্ধমান জেলাগুলোর রাজস্ব আদায়ের অধিকার পায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানি চট্টগ্রামের রাজস্ব, উৎপাদন প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাদের প্রভাববিস্তারে সচেষ্ট হয়। কিন্তু অব্যাহত মগ আক্রমণে তাদের প্রচেষ্টা ব্যাহত হতে থাকে। তখন আরাকানরাজের সঙ্গে সমঝোতার তৎপরতা চালায়। একই সঙ্গে কোম্পানি চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে আরাকানিদের বসতিদানের পদ্ধতি অবলম্বন করে। অবশ্য এই বসতিদানের নেপথ্যে মগদের বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধক গড়ে তোলা ছাড়াও দক্ষিণ চট্টগ্রামের অনাবাদি এলাকা আবাদযোগ্য করে তোলাও ছিল তাদের উদ্দেশ্য। মোগল যুগেই চট্টগ্রামে ছিল আরাকানি উদ্বাস্তুদের বসবাস। তখন তাদের মাথাপিছু বার্ষিক কর ‘মগজমা’ প্রদান করতে হতো। কোম্পানি এই মগজমা প্রথা বাতিল করে দিয়ে আরাকানিদের বসতি বাড়াতে সচেষ্ট হয়। পাশাপাশি আরাকানরাজের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালায়। কিন্তু আরাকানজুড়ে ক্রমাগত অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার জন্য কেবল পত্র-যোগাযোগ ছাড়া কোনো বাস্তব সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনি। ১৭৮৫ সালে বর্মিরাজ বোধপায়া আরাকান দখল করে আরাকানকে বার্মার একটি প্রদেশে পরিণত করেন। ফলে সীমান্ত সমস্যা স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতকের প্রথম চার দশক থেকে আরাকানে বিদ্রোহ, হত্যা ও ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ফলে জনজীবন হয়ে পড়ে বিপন্ন ও অনিশ্চিত।
Advertisement
দীর্ঘকাল অশান্তি ও অনিশ্চয়তার বিপরীতে আরাকানিদের মনে শান্তি ও স্থায়িত্বের বোধ জেগে ওঠে। আরাকানের রাজা থামাদাকে অপসারণ করে বার্মার আলাক্সপায়া বংশের সাম্রাজ্যবাদী রাজা বোধপায়া রাজ্য দখল করেন। বিশ্বাস ছিল যে, আরাকানে ক্রমাগত রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ইংরেজ ও ফরাসি শক্তিকে হস্তক্ষেপে উৎসাহী করতে পারে, যা বার্মার নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করবে। বোধপায়া আরাকানকে বার্মার সঙ্গে সংযুক্ত করেন। আর বর্মি সেনারা আরাকান দখলের পরপরই নৃশংস অত্যাচার চালাতে থাকে।
পলাতক রাজা থামাদাকে নৌকাসহ আটক করে সপরিবারে হত্যা করা হয়। আর অধিকাংশ আরাকানিকে গ্রেফতার করে। পুরুষদের হত্যা করে। আর নারীদের বার্মা পাঠিয়ে দেয়। যেমন একালে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো হচ্ছে। বর্মি বাহিনীর দমননীতির কারণে হাজার হাজার আরাকানি উদ্বাস্তু সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রামে আশ্রয় নেয়। ১৭৮৬ সালের দিকে থাইল্যান্ড দখলের জন্য বোধপায়া আরাকান থেকে প্রচুর পরিমাণে লোকবল, অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ চায়। এই চাহিদাপূরণের জন্য বর্মি সেনারা আরাকানিদের ওপর অত্যাচার চালাত। আরাকানিদের একত্র করে মরিচের ধোঁয়া দেওয়া এবং বিভিন্ন দৈহিক নির্যাতন চালিয়ে তাদের বাধ্য করা হতো বার্মায় যেতে।
এছাড়া পরাজিত আরাকানি সেনাদের অস্ত্র সমর্পণের জন্য তাদের সেনানিবাসে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হতো। মাত্রাতিরিক্ত রাজস্ব আদায় ছাড়াও শিশুদের ওপরও করারোপ করা হয়। কখনো বা শ তিনেক যুবককে একসঙ্গে করে বার্মায় পাঠানো হতো রাজস্ব হিসেবে। অর্থকড়ি নয়, একেবারেই তরতাজা যুবক হতো রাজস্ব। যারা আর কোনোদিন স্বভ‚মিতে ফিরে আসেনি। যেমন মেকটিলা হ্রদ পুনর্নির্মাণের জন্য ছয় হাজার আরাকানিকে পাঠানো হলেও তাদের খোঁজ আর পায়নি স্বজনরা। প্যাগোডা নির্মাণেও আরাকানিদের জোরপূর্বক শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হতো। নিরীহ আরাকানিরা অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সংগঠিত হতে থাকে।
১৭৯১ সালে অত্যাচারিত আরাকানিরা তাদের সাবেক রাজবংশের একজন বংশধরকে রাজা হিসেবে মনোনীত করে বর্মি রাজা ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। যুদ্ধে বহু বর্মিসেনা নিহত হলেও শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ দমন করতে সমর্থ হয় বর্মিরা। আর অত্যাচার, নিপীড়ন, নৃশংসতা বহুগুণ বেড়ে যায় আরাকানিদের ওপর। এই অত্যাচার সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী আরাকানি সরদার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কমান্ডার ইন চিফকে জানান, বর্মি সেনারা নারী, পুরুষ ও শিশু নির্বিশেষে প্রায় দুলাখ আরাকানিকে হত্যা ও সমসংখ্যককে দাস হিসেবে বার্মায় পাঠায়। যারা এই হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচার আশায় বনে-জঙ্গলে লুকিয়েছিল, তাদের অনেককে হয় বাঘের মুখে নতুবা বর্মি সেনার হাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে।
Advertisement
১৭৯৪ সালে এই কমান্ডার ইন চিফ লে. কর্নেল ইরাস্কান মন্তব্য করেন যে, বর্মিরা বিজিত ও নিরীহদের ওপর অত্যাচারের জন্য দায়ী। সন্দেহ নেই যে, হাজার হাজার নরনারী ও শিশুকে সুস্থ মস্তিষ্কে হত্যা করা হয়েছে। ১৭৯৬ সালে বিক্ষুব্ধ আরাকানিরা পুনরায় দেশব্যাপী বিদ্রোহ করে। এতে চট্টগ্রামে আশ্রিত আরাকানি সরদাররাও অংশ নেয়। জয়ের মুখ না দেখে শেষে আরাকানিরা নিজেদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রামে আশ্রয় নেয়। এভাবে ১৭৮৫ সাল থেকে অষ্টাদশ শতকের শেষ দশক পর্যন্ত আরাকানে বর্মি সেনারা নৃশংস অত্যাচার, আরাকানিদের প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ এবং বিদ্রোহে পরাজিত হয়ে চট্টগ্রামে আশ্রয় নেওয়ার এক সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু হওয়া ও অনুপ্রবেশ করার ঘটনা নতুন কিছু নয়। বর্মি সেনার অত্যাচার-নির্যাতন ও নিগৃহীত অসংখ্য আরাকানি উদ্বাস্তু নিজেদের ঘরবাড়ি ত্যাগ করে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশের চট্টগ্রামের দক্ষিণাংশে। এ আশ্রিতদের মধ্যে মগ জলদস্যুরাও ছিল। তারা মাঝেমধ্যে আরাকানের বিভিন্ন অঞ্চল এবং কোম্পানির ভূখণ্ডেও বিচ্ছিন্নভাবে আক্রমণ ও লুটতরাজ চালাত। এরা পাহাড় ও জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। শতাব্দীব্যাপী আরাকানি মগদের বাংলায় লুটতরাজ করার ইতিহাস আরাকানিদের জাতীয় চরিত্রের একটি কলঙ্কিত অধ্যায়। মগদের এ ঘৃণিত অপতৎপরতার জন্য আরাকানিদের স্বাধীনতার স্পৃহা ও প্রচেষ্টা স্বীকৃতি পায়নি। কোম্পানিও তাদের স্বাধীনতার প্রতি মনোযোগী হয়নি। চট্টগ্রামে বিপুল পরিমাণে আরাকানি উদ্বাস্তুর আগমন ও কোম্পানি সরকারের তাদের আশ্রয়দান ও আশ্রিত আরাকানি সরদারদের আরাকান আক্রমণ বাংলা ও বার্মা সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিক্ততার সৃষ্টি করে। আরাকান আক্রমণে কোম্পানি কোনো সহযোগিতা না করলেও বর্মিরা সন্দেহ করে যে, এতে কোম্পানির প্ররোচনা ও ইঙ্গিত রয়েছে।
বর্মি সেনারা সীমান্ত অতিক্রম করে চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে এসে বিদ্রোহীদের সন্ধান করত। এমনকি তালুকদার ও রায়তদের অপহরণ করে নিয়ে যেত। ১৭৯১ সালে আরাকানে বিদ্রোহ দেখা দেয়। পরাজিত হয়ে বিদ্রোহের নেতা ও আরাকানি রাজা ওয়েমো চট্টগ্রামে আশ্রয় নেন। কোম্পানি তাকে নিষ্কর ভূমি প্রদান করে। আরাকানি বিদ্রোহীদের তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য বর্মি সেনারা সীমান্তে সেনা সমাবেশ শুধু নয়, চট্টগ্রামের অভ্যন্তরেও প্রবেশ করত। ভয়ে উদ্বাস্তুসহ স্থানীয় জনগণ বন-জঙ্গলে পালিয়ে যেত। অষ্টাদশ শতকের সাত দশক থেকে চট্টগ্রামে আরাকানি উদ্বাস্তুদের আগমনের সংখ্যা এত বেশি বেড়ে যায় যে, তাদের পুনর্বাসনের জন্য কোম্পানিকে ব্যাপক ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হয়। কেবল ১৭৯৮ সাল থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে আগত উদ্বাস্তুর সংখ্যা ছিল প্রায় চল্লিশ হাজার।
বর্মি সেনাদের অত্যাচার ও নৃশংসতার মাত্রাতিরিক্তে অতিষ্ঠ উদ্বাস্তুরা ঘোষণা করে যে, ‘আমরা আর আরাকানে ফিরে যাব না। কোম্পানি যদি এখানে আমাদের বধ করে, আমরা বধ্য হতে রাজি। যদি বিতাড়িত করে, আমরা বন্যপশুর বাসস্থান বিশাল পাহাড়গুলোর বন-জঙ্গলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হব।’ যদিও আরাকান কখনই জনবহুল ছিল না। কিন্তু কোম্পানির ভূখণ্ডে দলে দলে আরাকানিদের আগমনের ফলে প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে আরাকান। ক্ষুধা, রোগ ও জীর্ণদশায় বহু মানুষ মারা যায়। ১৭৯৯ সালে কোম্পানির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উদ্বাস্তুদের মধ্যে মৃত্যুর ভয়াবহতা অবিরাম রয়েছে। প্রতিদিন বিশ থেকে ত্রিশ শিশুর প্রাণহানি ঘটছে। দরিদ্র উদ্বাস্তুদের অবস্থা খুবই সংকটজনক। কোম্পানি অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানসহ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে। তাদের চট্টগ্রামের উত্তরে না দক্ষিণে পুনর্বাসন করা হবে, তা নিয়ে কোম্পানিতে মতভেদও ছিল। অনেক কর্মকর্তা মনে করতেন, আরাকানি উদ্বাস্তুরা ততটা শান্তিপ্রিয় নয়, যতটা তাদের ভাবা হয়।
রেঙ্গুনে কোম্পানির রেসিডেস্ট ছিলেন হিরান বক্স। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় উদ্বাস্তু নীতিমালা ও স্থান নির্বাচন এবং স্থায়ীভাবে বসবাসকারী আরাকানিদের মধ্যে জীবিকা ও জমি বণ্টনের। চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে বসতি ও চাষাবাদের সুবিধা থাকায় তা সম্প্রসারণে হিরাম বক্স উদ্বাস্তুদের কাজে লাগানোর পদক্ষেপ নেন। তিনি উদ্বাস্তুদের সংখ্যা নিরূপণ করেন তিন হাজার। পতিত জমি শর্তসাপেক্ষে উদ্বাস্তুদের মধ্যে চিরস্থায়ীভাবে পাট্টা দেওয়া হয়। উদ্বাস্তুদের মধ্যে চাষি ছাড়াও সাধারণ মানুষ, দোকানি, জেলে ছিল। রোয়াং বা রাখাইং নামে পরিচিত আরাকানি উদ্বাস্তুদের এক বিরাট অংশকে বাকখালী নদীর তীরে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়, যা পরে কক্সবাজার নাম হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া চট্টগ্রামের হারবাং, রামদিয়া, পটিয়া, রাউজান অঞ্চলেও বসতি স্থাপন করে। ১৭৯৯ সালে বর্মি সেনা অত্যাচারে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আরাকানি উদ্বাস্তু সমুদ্র ও পাহাড় ডিঙিয়ে চট্টগ্রাম চলে আসে। কোম্পানি তাদের পুশব্যাক করতে চাইলেও তারা ফেরত যায়নি। বর্মি সেনারা তাদের খোঁজে রত্নাপালং এলাকায় প্রবেশ করে। এ নিয়ে কোম্পানির সঙ্গে বাগযুদ্ধ হয়। তিন বর্মি সেনা নিহত হলে তারা পশ্চাদপসরণ করে। আবারও পাঁচ হাজার বর্মি সেনা চট্টগ্রামে প্রবেশ করে প্রায় চল্লিশজন উদ্বাস্তুকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। উদ্বাস্তুদের একটি অংশ শান্তিপূর্ণভাবে চট্টগ্রামে বাস করছিল। আরেকটি অংশ একদিকে আরাকান ও অন্যদিকে বাংলাদেশে ত্রাস সৃষ্টিকারী মগদের সঙ্গে অংশ নিত।
১৮১৮ সালে বর্মি শাসকরা কোম্পানির কাছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, মুর্শিদাবাদ ও কাশিমবাজার তাদের প্রদানের দাবি করে। এমনকি এ অঞ্চলে আদায় করা রাজস্বও বর্মি সরকারের কাছে সমর্পণের দাবি তোলে। বর্মি শাসকরা এ অঞ্চলগুলো আরাকানিদের ছিল বলে দাবি করে। আরাকান বার্মার সঙ্গে সংযোজিত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বর্মিরা এ অঞ্চলগুলোর দাবিদার। ১৭৯৭ সালে ঘোষণা করা হয় যে, বর্মিরাজ স্বীয় ক্ষমতাবলে ঢাকার মগবাজার পর্যন্ত অধিকার করবেন। তারা শাহপরী দ্বীপও তাদের দাবি করে এবং দখল করে নেয় ১৮২৩ সালে। এর আগে ১৮১১ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত বর্মিবিরোধী তৎপরতা চালায় উদ্বাস্তু আরাকানিরা। তাদের নেতা আরাকানের একদা রাজপুত্র চিন পিয়ান আরাকান উদ্ধারে তৎপর হন। বর্মিরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। চিন পিয়ান পালিয়ে চট্টগ্রামে এসে আশ্রয় নেন। ইতিহাস বলে, আরাকান যার নাম বদলে বর্তমানে রাখাইন করা হয়েছে, সেখানে মগ ও রোহিঙ্গা এ দুই সম্প্রদায়ের বাস। মগরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। দস্যুবৃত্তির কারণে এদের নাম হয়েছে মগ। তাদের দৌরাত্ম্য ঢাকা পর্যন্ত ছিল, তার প্রমাণ মগবাজার।
১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের আরাকান ছিল স্বাধীন রাজ্য। বার্মার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গেই ছিল তার যোগসূত্র। আরাকান রাজসভায় চর্চা হতো বাংলা ভাষার। বাংলা ভাষার মহাকবি আলাওল। তিনি তার পদ্মাবতী কাব্যে রোসাঙ্গ জনগোষ্ঠীর একটি বিবরণ দিয়েছেন। লিখেছেন ‘নানা দেশী নানা লোক/শুনিয়া রোসাঙ্গ ভোগ/আইসন্ত নৃপ ছায়াতলে।’ এটা বাস্তবিক যে, রোহিঙ্গারাই ইতিহাসখ্যাত রোসাঙ্গ সভ্যতার ধারক-বাহক। অবশ্য নানা জাতির সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গা জাতি। ১৪৩০ সালে আরাকানে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসন দুই শ বছরেরও বেশি স্থায়ী ছিল। ১৬৩১ থেকে ১৬৩৫ সাল পর্যন্ত ব্যাপক দুর্ভিক্ষ হয় সেখানে। ফলে মুসলিম শাসনের অবসান হয়।
১৬৬০ সালে আরাকানে আশ্রিত মোগল শাহজাদা সুজাকে সপরিবারে অমানবিকভাবে হত্যা করে। এরপর শুরু হয় মুসলমানদের ওপর বর্মি রাজাদের নিপীড়ন। সাড়ে তিন শ বছর ধরে তা চলে। ১৭৮০ সালে বর্মি রাজা দখল করে নেয় আরাকান। ঢালাওভাবে আরাকানিরা নিগৃহীত হতে থাকে। ১৯২৮ সালে বার্মা ইংরেজ শাসনের অধীনে চলে যায়। ১৯৩৭ সালে স্বায়ত্তশাসন লাভের পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চালিয়ে প্রায় ত্রিশ লাখ মুসলিমকে হত্যা করে। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা পায়। কিন্তু আরাকান আর স্বাধিকার ও স্বাধীনতার মুখ দেখে না। অথচ আরাকান ছিল একটি স্বাধীন রাজ্য। চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে আরাকানিরা বসবাস করে আসছে ছয় শ বছর ধরে। তাদের মূল ভূখণ্ড আরাকান পরাধীন তাদের জন্য। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে আরাকানিদের রোসাঙ্গ বলে উল্লেখ করা হয়। আরাকানের ইতিহাস জানার উপাদান হচ্ছে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য। মহাকবি আলাওল, কোরেশি মরদন, মাগন ঠাকুর, নাসরুল্লাহ খান প্রমুখ রোসাঙ্গ রাজসভার কবি ছিলেন।
স্বাধীন আরাকান রাজ্য একসময় দক্ষিণ চট্টগ্রামেরই অংশ ছিল। কালের বিবর্তনে বা পরিক্রমায় তা এখন বার্মার নিগৃহীত, অনুন্নত এক প্রদেশ। মগের মুল্লুকজুড়ে বর্মি জল্লাদরা মানুষ হত্যা করে চলেছে। তাদের পূর্বসূরি জলদস্যু মগরা যেভাবে মানুষ খুন করত, এখন রোহিঙ্গাদের হত্যা করা হচ্ছে। ভাষাভিত্তিক জাতি রোহিঙ্গারা জাতিসংঘের ভাষায় ‘বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত সংখ্যালঘু।’ এদের জন্য কেউ মাতম করে না। অশ্রুও ফেলে না। মগের মুল্লুকের এ কালের জল্লাদরা অতীতের ধারাবাহিকতায় নিপীড়ন চালিয়েই যাচ্ছে। রুখবে তাদের সাধ্য কার!
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চার বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। চার বছর আগে এইদিনে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বেরোচিত হামলা চালিয়ে হত্যা-ধর্ষণ-লুটপাট করে মিয়ানমার থেকে বের করে দেয় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে শুরু হওয়া ওই সেনা অভিযানের পরের পাঁচ মাসে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ১৯৭৮ সাল থেকে শুরু করে সর্বশেষ আসা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে। আন্তর্জাতিক চাপ ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান জরুরি। শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গারা ফিরে যাক তাদের স্বদেশ ভূমিতে। এই পরিবেশ সৃষ্টি হোক এই প্রত্যাশা।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।
এইচআর/জেআইএম