ফিচার

ক্লিওপেট্রা সত্যিই কি কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন?

ক্লিওপেট্রা নামটি মনে পড়লেই অনিন্দ্য সুন্দর এক নারীর ছবি ভেসে ওঠে চোখের সামনে! মিশরের এই রানির সৌন্দর্য বর্ণনায় রোমান ঐতিহাসিক ক্যাসিয়াস ডিও লিখেছেন, ‘সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো, সেরা রূপের অধিকারী এক নারী।’

Advertisement

ক্লিওপেট্রা দেখতে কেমন ছিলেন? এ নিয়ে বিশ্ববাসীর মনে কৌতূহলের শেষ নেই। তবে ক্লিওপেট্রার আসল চেহারা আজও রহস্যেই মোড়ানো। আজ অব্দি ঐতিহাসিকরা যে যার মতো করেই বর্ণনা করেছেন ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্যের।

১৯৬৩ সালের ‘ক্লিওপেট্রা’ সিনেমার অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেইলরের মতোই কি হৃদয় কাঁপানো নারী ছিলেন ক্লিওপেট্রা, না কি তার চেয়েও সুন্দরী ছিলেন? ক্লিওপেট্রার কল্পনাতীত সুন্দর চেহারা ছাড়াও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্লিওপেট্রার জাতি নিয়েও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।

প্রাচীন এই রানির গায়ের রং না কি ফর্সা ছিল, এমনই মত পশ্চিমা দেশগুলোর। তবে কেউ কেউ অনুমান করেছেন, তিনি আসলে কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন! ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর ২০০০ বছর পর ইতিহাসবিদরা কিছু প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন। যার মাধ্যমে জানা গেছে তার আসল চেহারা কেমন ছিল!

Advertisement

ক্লিওপেট্রা কি সত্যিই কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন?

বিভিন্ন নথিপত্র থেকে জানা যায়, ক্লিওপেট্রার বাবার আদি নিবাস ছিল গ্রিসে। যদিও তার মায়ের পরিচয় আজও অনিশ্চিত। এদিকে সব গ্রিকরা আবার ফর্সাও ছিলেন না। সম্ভবত ক্লিওপেট্রাও কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন!

ক্লিওপেট্রার জাতি বিতর্ক বিগত কয়েক দশক ধরেই চলছে। কারণ অনেকেই এই শক্তিশালী রানির অনিশ্চিত জাতিগত পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ ক্লিওপেট্রা তার জীবনের বেশিরভাগ সময়ই উত্তর আফ্রিকায় কাটিয়েছেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার চেহারা নিয়ে বিতর্কটা আরও নতুনভাবে সামনে এসেছে। কারণ এলিজাবেথ টেইলরের বিখ্যাত ১৯৬৩ সালের ‘ক্লিওপেট্রা’ সিনেমার পর এবার আসছে ‘ক্লিওপেট্রা বায়োপিক’।

Advertisement

এই সিনেমায় জনপ্রিয় ইসরায়েলি অভিনেত্রী ‘ওয়ান্ডার ওমেন’ খ্যাত গাল গ্যাডট ক্লিওপেট্রার চরিত্রে অভিনয় নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে কাস্টিং সমালোচনা চলছে।

ক্লিওপেট্রা কি সুন্দরী ছিলেন?

অনেকেই দাবি করেন, ক্লিওপেট্রা অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন। এ কারণেই তো, তখনকার শক্তিশালী দুই রোমান জুলিয়াস সিজার এবং মার্ক অ্যান্টনির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন তিনি।

৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ক্লিওপেট্রা তার ভাইয়ের সঙ্গে ক্ষমতার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন। তখন জুলিয়াস সিজার মিশরে আসেন। রানি ক্লিওপেট্রা রাজনৈতিক বিষয়ে সিজারের সাহায্য পেতে তার সঙ্গে দেখা করেন। সিজারও ক্লিওপেট্রার প্রস্তাবে সম্মতি জানান।

ক্লিওপেট্রা কেবল তার ভাইকেই পরাজিত করেননি বরং তিনি সিজারের পুত্র সিজারিয়ানের জন্মও দিয়েছিলেন। ৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিজার হত্যার পর ক্লিওপেট্রা মার্ক অ্যান্টনির সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।

প্রাচীন গ্রিক ও রোমান ঐতিহাসিকদের মতে ক্লিওপেট্রা কেমন দেখতে ছিলেন?

বেশিরভাগ রোমান ঐতিহাসিকরা ক্লিওপেট্রাকে সুন্দরী বলে বর্ণনা করেছেন। যখন ক্যাসিয়াস ডিও ক্লিওপেট্রার সঙ্গে সিজারের সাক্ষাতের বর্ণনা দেন, তখন তিনি মিশরীয় রানিকে ‘প্রত্যেককে প্রেম ভালোবাসা দিয়ে বশীভূত করার ক্ষমতা’ দিয়ে চিত্রিত করেন।

অন্যদিকে সিজারকে দেখে ক্লিওপেট্রা ‘সম্পূর্ণরূপে মোহিত’ হিসেবে বর্ণনা করেন। ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্য নিয়ে ডিও লেখেন, ‘সৌন্দর্যকে অতিক্রম করা একজন অপরূপা।’

ক্লিওপেট্রা দেখতে কেমন ছিলেন? এ বিষয়ে প্লুটার্ক কিছুটা জটিল দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন। মার্ক অ্যান্টনির সঙ্গে ক্লিওপেট্রার সাক্ষাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে গ্রিক লেখক উল্লেখ করেছেন, ‘ক্লিওপেট্রা যখন মার্ক অ্যান্টনির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন তখন তিনি সৌন্দর্য এবং বুদ্ধিবৃত্তিতে সর্বোচ্চ চূড়ায় ছিলেন। তার কণ্ঠে ছিল মিষ্টতা। ’

তবে তাদের বর্ণনা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের আঙ্গিকে বিবেচনা করা উচিত। রোমানরা ক্লিওপেট্রাকে একটি বিদেশি সত্তা, একজন শক্তিশালী নারী হিসেবে অপছন্দ করে এবং তাকে অবিশ্বাস করে।

প্রথম শতাব্দীর কবি হোরাস তাকে ‘পাগল রানি, যে কি না রাজধানী ধ্বংসকারী এবং সাম্রাজ্যের পতনের ষড়যন্ত্রকারী’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। গ্রিক ঐতিহাসিকরা রানির আরও বাস্তব চিত্র আঁকতে চাইলেন। তারা ক্লিওপেট্রার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়েও কটুক্তি করেন।

ক্লিওপেট্রার সময়ে অনেক নেতারা তাকে ‘পতিতা’ অপবাদ দিতেও ছাড়েননি। তারা মনে করতেন, সতর্ক না হলে শক্তিশালী পুরুষদেরকে ক্লিওপেট্রা তা রূপে বশ করে কাজে লাগাতে পারেন। এসব রটনা ক্লিওপেট্রার গুণ ও পারদর্শিতায় প্রভাব ফেলেছে।

আধুনিক যুগে অনেকেই বিশ্বাস করেন, ক্লিওপেট্রা ছিলেন চূড়ান্ত পর্যায়ের সম্মোহিনী। তবে এটি মূলত রোমান সম্রাট অক্টাভিয়ান দ্বারা প্রচারিত মিথ্যা প্রচারণা ছাড়া আর কিছুই নয়! যিনি ছিলেন অ্যান্টনির প্রতিদ্বন্দ্বী।

ক্লিওপেট্রার আসল চেহারা

ক্লিওপেট্রা তার শারীরিক গঠন সম্পর্কে কিছু আলামত রেখে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে ক্লিওপেট্রার ছবি সংবলিত কিছু মুদ্রা পাওয়া গেছে। যেখানে দেখা গেছে, তার কোঁকড়ানো চুল, উঁচু ও বাঁকা নাক ও বড় চিবুক। ক্লিওপেট্রার বেশিরভাগ মুদ্রায় একই ধরনের চিত্র দেখা গেছে।

হাথোর মন্দিরের বাইরের দেওয়ালগুলো ক্লিওপেট্রার সময়ে খোদাই করা। সেখানকার দেওয়ালের ছবিতে সিজারিয়ানের সঙ্গে তাকে দেখানো হয়েছে। দেওয়ালচিত্রে তাকে একজন দেবীর মতো চিত্রিত করা হয়েছে। কারণ ক্লিওপেট্রাকে তখন মিশরবাসীরা দেবী আইসিসের মতো মনে করত।

বহু শতাব্দী ধরেই ঐতিহাসিকরা ক্লিওপেট্রার আসল সৌন্দর্য খুঁজতে ব্যস্ত। তিনি কি সত্যিই গল্পের মতো সুন্দরী ছিলেন এটা নিয়েও আছে বিতর্ক।

মিশরীয় পুরাতাত্ত্বিক স্যালি অ্যান অ্যাশটন জানান, ‘২০০০ বছর আগে ক্লিওপেট্রা একটি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী শাসক ছিলেন, এটি জানাই কি যথেষ্ট নয়। তিনি দেখতে কেমন ছিলেন, তা নিয়ে এতো আলোচনা ও বিতর্কের কী আছে?’

ক্লিওপেট্রার সময়কার পুরুষরা রানির সাফল্য ও বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করার পরিবর্তে তার চেহারা বিশ্লেষণে মগ্ন ছিলেন। তাদের অধিকাংশই ক্লিওপেট্রার রাজনৈতিক দক্ষতা ও বিভিন্ন ভাষায় দক্ষতার কথা উল্লেখ করেননি।

প্লুটার্ক ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্যকে স্বীকার করেছেন। তবে অন্যরা যেমন- নাট্যকার, শিল্পী মূলত ক্লিওপেট্রার চেহারার দিকেই বেশি মনোনিবেশ করেছেন।

বেশ রহস্যজনকভাবে ক্লিওপেট্রার মৃত্যু হয়েছিল। কেউ বলেন, সাপের কামড়ে মারা যান রানি আবার কারও মতে, বিষাক্ত আপেল খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন তিনি!

এমনকি মৃত্যুর পর তার দেহাবশেষও খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। আজও রানির মরদেহ বা সমাধির খোঁজ মেলেনি। ক্লিওপেট্রার চেহারার মতো তার মৃত্যুও রহস্য ঘেরা।

সূত্র: অল দ্যাট ইন্টারেস্টিং

জেএমএস/এমকেএইচ