সাহিত্য

বিজয়ের পঙক্তিমালা

স্বাধীনতা তুমিশামসুর রাহমানস্বাধীনতা তুমি রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান। স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা- স্বাধীনতা তুমি শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা স্বাধীনতা তুমি পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল। স্বাধীনতা তুমি ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি। স্বাধীনতা তুমি রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার। স্বাধীনতা তুমি মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী। স্বাধীনতা তুমি অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক। স্বাধীনতা তুমি বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর শানিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ। স্বাধীনতা তুমি চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ। স্বাধীনতা তুমি কালবোশেখীর দিগন্তজোড়া মত্ত ঝাপটা। স্বাধীনতা তুমি শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন। স্বাধীনতা তুমি উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন। স্বাধীনতা তুমি বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদীর রঙ। স্বাধীনতা তুমি বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার। স্বাধীনতা তুমি গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল, হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম। স্বাধীনতা তুমি খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা, খুকীর অমন তুলতুলে গালে রৌদ্রের খেলা। স্বাধীনতা তুমি বাগানের ঘর, কোকিলের গান, বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা, যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।দুই.বাঙলাদেশের কথাহুমায়ুন আজাদযখন আমরা বসি মুখোমুখি, আমাদের দশটি আঙুল হৃৎপিণ্ডের মতো কাঁপতে থাকেদশটি আঙুলে, আমাদের ঠোঁটের গোলাপ ভিজে ওঠে আরক্ত শিশিরে,যখন আমরা আশ্চর্য আঙুলে জ্বলি, যখন আমরাই পরষ্পরের স্বাধীন স্বদেশ,তখন ভুলেও কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা জিজ্ঞেস করো না;আমি তা মূহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, -তার অনেক কারণ রয়েছে।তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না।জানতে চেয়ো না তুমি নষ্টভ্রষ্ট ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের কথা, তার রাজনীতি,অর্থনীতি, ধর্ম, পাপ, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যমণ্ডলি, জীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণ,মধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন ক’রে আমাকে পীড়ন কোরো না;আমি তা মুহূর্তেও সহ্য করতে পারি না,- তার অনেক কারণ রয়েছে।তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না।জানতে চেয়ো না তুমি নষ্ট ভ্রষ্ট ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের কথা: তার রাজনীতিঅর্থনীতি, ধর্ম, পাপ, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যমণ্ডলীজীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণমধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্নকরে আমাকে পীড়ন কোরো নাতার ধানক্ষেত এখনো সবুজ, নারীরা এখনো রমনীয়, গাভীরা এখনো দুগ্ধবতী,কিন্তু প্রিয়তমা, বাঙলাদেশের কথা তুমি কখনো আমার কাছে জানতে চেয়ো না;আমি তা মুহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, তার অনেক কারণ রয়েছে। তিন.স্বাধীনতা- এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলোনির্মলেন্দু গুণ একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়েলক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছেভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে কখন আসবে কবি?এই শিশুপার্ক সেদিন ছিল না,এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না,এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল নাতাহলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি?তাহলে কেমন ছিল শিশু পার্কে বেঞ্চে বৃক্ষে ফুলের বাগানেঢেকে দেয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি?জানি, সেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে হয়েছে উদ্যতকালো হাত। তাই দেখি- কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজকবির বিরুদ্ধে কবি,মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল,উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যানমার্চের বিরুদ্ধে মার্চ......।হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি,শিশুপার্কের রঙ্গিন দোলনায় দোল খেতে খেতে- তুমিএকদিন সব জানতে পারবে; আমি তোমাদের কথা ভেবেলিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্পসেদিন এই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর।না পার্ক না ফুলের বাগান- এসবের কিছুই ছিলনা,শুধু একখণ্ড অখণ্ড আকাশ যেরকম, সে দিগন্ত প্লাবিতধু ধু মাঠ ছিল- দূর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়।আমাদের স্বাধীনতা প্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিলএই ধু ধু মাঠের সবুজে।কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধেএই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক,লাঙ্গল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক,পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক।হাতের মুঠোয় মৃত্যূ, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত,নিম্ন মধ্যবিত্ত-করুণ কেরাণী- নারী-বৃদ্ধ- বেশ্যা- ভবঘুরেআর তোমাদের মতো শিশু-পাতা কুড়ানীরা দল বেঁধে।একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কী ব্যাকুলপ্রতীক্ষা মানুষের : কখন আসবে কবি? কখন আসবে কবি?শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটেঅতঃপর কবি এসে- জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ারসকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাহার বজ্রকন্ঠ বাণী?গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রামএবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।এইচআর/পিআর

Advertisement