মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দেশজুড়ে চালিয়েছে বীভৎস হত্যাযজ্ঞ। পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন শেরপুরের অসংখ্য নারী-পুরুষ। গণহত্যার পর কোথাও মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে, কোথাও লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে নদীতে। আবার কোথাও হত্যাযজ্ঞের পর স্থানীয় লোকজন লাশগুলোর সৎকার করেছেন। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর এইসব বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পেরিয়ে গেলেও উদ্যোগ নেয়া হয়নি যুদ্ধদিনের নিরব স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোর। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের প্রগতিশীল আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী স্থান, গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো সরকারিভাবে সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন।আহমদ নগর : মুক্তিযুদ্ধকালীন শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার আহমদ নগর উচ্চ বিদ্যালয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করে হানাদার বাহিনী। এটি ছিল পাক হানাদার বাহিনীর আঞ্চলিক হেডকোয়ার্টার। পাকবাহিনী এবং তাদের দোসররা আহমদ নগর উচ্চ বিদ্যালয়কে নির্যাতন কেন্দ্র ও বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করে। একাত্তুরে ৯ মাসই এখানে চলে তাদের নৃশংসতা। পাকিস্তানি পশুরা নারী-পুরুষের ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালানোর পর তাদের বগাডুবি ব্রিজে নিয়ে অথবা কোয়ারি রোড, জুলগাঁওয়ে হত্যার পর এসব লাশ মাটিচাপা দিয়ে অথবা নদীতে ভাসিয়ে দিত। স্বাধীনতার পর আহমদ নগর স্কুল ও তার আশপাশ এলাকায় অসংখ্য কঙ্কাল পাওয়া যায়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঘাগড়া কোনাপাড়া বধ্যভূমির পাশে এলজিইডির অর্থায়নে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও তা অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা এখন গো-চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। আহমদ নগর বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণ ছাড়া এখানে আর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। জগৎপুর : ঝিনাইগাতী উপজেলার জগৎপুর গ্রামে ১৯৭১ সনের ৩০ এপ্রিল গণহত্যা চালানো হয়। এদিন এই গ্রামের ৪২ জন হিন্দু পরিবারের সদস্যসহ মোট ৫৮ জন নারী-পুরুষকে হত্যা করা হয়। পুড়ে ছারখার করে দেয়া হয় বাড়িঘর। গণহত্যার এ স্থানটিতে স্মৃতিস্তম্ভ বা শহীদদের স্বীকৃতি প্রদানের কোনো উদ্যোগ আজও নেয়া হয়নি।নাকুগাঁও : ১৯৭১ সালের ২৫ মে নালিতাবাড়ী উপজেলার নাকুগাঁও সীমান্তের ভোগাই নদী পার হয়ে পাকহানাদার বাহিনী ভারতের বারাঙ্গাপাড়া থানার ডালুতে গণহত্যা চালায়। এ সময় বাংলাদেশ থেকে ডালুতে আশ্রয় নেয়া মুক্তিকামী মানুষ ও ভারতীয় নাগরিকসহ দুই শতাধিক নারী-পুরুষ নিহত হয়। পাক হানাদারদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে ৯জন বিএসএফ সদস্য। ভারতের কাটাতার ঘেঁষা এই নাকুগাঁওয়ে গণহত্যার শিকার বাংলাদেশি মুসলমানদের লাশ দাফন করা হয়। এছাড়াও ৯ মাসে এ স্থানে বিভিন্ন যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর দেয়া হয়। স্বাধীনতার পর ভারত সরকার তাদের বিএসএফ সদস্যদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করে। গত বছর এটি আরও বৃহৎ আকারে সংস্কার করে স্মৃতিস্তম্ভটি পুনর্নির্মাণ করে ভারত সরকার। কিন্তু নালিতাবাড়ীর নাকুগাঁওয়ের গণকবরটি এখনও অবহেলায় পড়ে আছে। ১৯৯৭ সালে এলজিইডির তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী নাকুগাঁও গণকবরটি এলজিইডির মাধ্যমে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন। কিন্ত আজ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। তন্তর : নালিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া-মন্ডালিয়াপাড়া ইউনিয়নের তন্তর গ্রামটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ঘাঁটি। ১৯৭১ সালের ৩০ জুন পাকহানাদার বাহিনী আলবদর-রাজাকারদের নিয়ে ওই গ্রামে হামলা চালায়। এসময় তিনজন বীর মুক্তিযোদ্ধা সহ মোট ৭ জন শহীদ হন। কিন্তু গ্রামবাসীদের অপরিসীম ত্যাগ ও শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ-আয়োজন নেই। কাঁটাখালি ব্রিজ এবং রাঙ্গামাটি খাটুয়ামাড়ি গ্রাম : শেরপুর-ঝিনাইগাতী-নালিতাবাড়ী সড়কের কাঁটাখালি ব্রিজ। এ ব্রিজটিই ছিল তখন সীমান্ত যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। তাই পাকহানাদারদের সীমান্ত এলাকায় অবাধ যাতায়াত বন্ধ করতে এ ব্রিজটি ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু পর পর দু’বার অপারেশন করেও সফল না হওয়ার পর এ ব্রিজ অপারেশনে আসেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি প্রকৌশল অনুষদের শেষ বর্ষের ছাত্র নাজমুল আহসান। ১৯৭১ সালের ৫ জুলাই রাতে তিনি তার ৫৩জন সহযোদ্ধাদের নিয়ে কাঁটাখালি ব্রিজ এবং তিনানি ফেরি ধ্বংসের সফল অপারেশন শেষে ঝিনাইগাতীর রাঙামাটি-খাটুয়ামারি গ্রামে আশ্রয় নেন। পরদিন ৬ জুলাই এ গ্রামের দালাল জালাল মিস্ত্রির সহযোগিতায় পাকসেনারা তিনদিক পানিবেষ্টিত গ্রামটিতে হামলা চালায়। এ সময় সন্মুখ যুদ্ধে কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল আহসান, তার চাচাতো ভাই মোফাজ্জল হোসেন, ভাইপো আলী হোসেন শহীদ হন। আহত হন বেশ ক’জন। এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ার অপরাধে ৯ জন গ্রামবাসীকে নৃশংসভাবে হত্যা ও ৬ জন নারীকে ধর্ষণ করা হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে অপরিমেয় ত্যাগ স্বীকার করা এ গ্রামটির কথা কেউ মনে রাখেনি। স্বীকৃতি মেলেনি শহীদ পরিবার এবং বীরাঙ্গনাদের। সোহাগপুর বিধবা পল্লী: নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রাম। ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা তাণ্ডব চালিয়ে ওই গ্রামের ১৮৭ জন পুরুষকে হত্যা করে। স্বাধীনতার পর গ্রামটি প্রথমে বিধবাপাড়া ও পরে ১ বিধবাপল্লী’ হিসেবে দেশ-বিদেশে পরিচিতি লাভ করে। এ গ্রামে এখনো রয়েছে ৫৯টি গণকবর। এ গণহত্যার জন্যই জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি হয়েছে। আলোচিত এই গ্রামটিকে এক নজর দেখার জন্য প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ আসে। কিন্তু এসে হতাশ হন। কারণ এখানে সেই ভয়াবহ গণহত্যার স্মৃতি মনে রাখার মতো কিছুই। অন্যের জমিতে রয়েছে একটি স্মৃতিফলক আর বসার জন্য একটি ঘর। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে এখানে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘরসহ নানা কিছু করা যেতে পারে। এজন্য শহীদ পরিবারের সদস্যরা জমি দিতেও ইচ্ছুক। কিন্তু উদ্যোগ নেই। তাই হারাতে বসেছে সোহাগপুর বিধবা পল্লীর সেই রক্তস্নাত ইতিহাস। সূর্যদি গ্রাম :চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মাত্র ২১ দিন আগে শেরপুর সদর উপজেলার সূর্যদি গ্রামে ঘটে এক নারকীয় গণহত্যা। ১৯৭১ সনের ২৪ নভেম্বর এই গ্রামে পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের নারকীয়তার শিকার হন এক মুক্তিযোদ্ধাসহ ৬২ জন গ্রামবাসী। স্বাধীনতার পর পর গ্রামবাসীরা নিজ উদ্যোগে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করলেও সেটির এখন খুবই হতশ্রী অবস্থা। সেটি সংস্কার কিংবা সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। রামচন্দ্রকুড়া ফরেস্ট ক্যাম্প : নালিতাবাড়ী উপজেলার এই ফরেস্ট ক্যাম্পটি ছিল পাকসেনাদের ঘাঁটি। যুদ্ধের ৯ মাস এখানে বহু মানুষকে নির্য়াতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। ধর্ষণ করা হয় নারীদের। স্বাধীনতার পর এখানকার কূপ থেকে উদ্ধার করা হয় অসংখ্য কঙ্কাল। কালের সাক্ষী এ ক্যাম্পটির স্মৃতি আজ বিস্মৃত হতে চলেছে। এছাড়াও জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার নকশী, নকলার নারায়ণখোলা, শ্রীবরদীর কাকিলাকুড়া গ্রামে বীরবিক্রম শাহ মুতাসীন বিল্লাহ খুররমের সমাধিস্থল। শেরপুর শহরের শেরিব্রিজ, সুরেন্দ্র সাহার বাড়ির আলবদরদের টর্চার সেল, সদর থানার সামনে অ্যাডভোকেট এম এ সামাদ সাহেবের বাড়ির বধ্যভূমি, জেলা প্রশাসকের বাংলোর পাশে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির কার্যালয়সহ নানা জায়গা মহান মুক্তিযুদ্ধের নিরব স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী এসব স্থান সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। ঝিনাইগাতী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার ফকির আব্দুল মান্নান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ভবিষৎ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত করতে হলে এসব বধ্যভূমি ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী স্থানগুলো দ্রুত সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। সরকারিভাবে এসব গণকবর, বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের দাবি জানাচ্ছি। সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের শেরপুর জেলা কমিটির সভাপতি মো. আমজাদ হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত অনেক স্থাপনা আজ অযত্নে-অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে। অথচ সরকার একটু দৃষ্টি দিলেই এসব স্থান ও স্থাপনা সংরক্ষণ করা সম্ভব। আমাদের অস্তিত্বের স্বার্থেই এটা করা উচিত। তাছাড়া বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির আওতায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী স্থান ও স্থাপনাগুলো সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে পারে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নজর দেবেন বলে আশা করি।এসএস/পিআর
Advertisement