বাংলাদেশের একটি অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ক্যান্টনমেন্টে গঠন করেছিলেন দলটি। তবে তার মৃত্যুর পর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রূপ পায় দলটি। বেগম জিয়ার নেতৃত্বে পূর্ণ দুই মেয়াদ এবং একবারের স্বল্প মেয়াদে মোট তিন দফায় ক্ষমতায় ছিল দলটি। কিন্তু ২০০৬ সালে ক্ষমতা হারানোর পর আর তা ফিরে পায়নি দলটি।
Advertisement
বিএনপি কোনো বিপ্লবী রাজনৈতিক দল নয়। ক্ষমতায় যাওয়া এবং থাকাই তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য। কিন্তু ১৫ বছর ধরে ক্ষমতা নামের সোনার হরিণের দেখা পাচ্ছে না তারা। নিজেদের নানা ভুল তো আছেই, আছে ক্ষমতাসীনদের নানা কৌশল এবং দমন-পীড়ন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতা হারানোর পর ২০১৪ সালের নির্বাচনে তারা অংশ নেয়নি। ক্ষমতামুখী রাজনৈতিক দলটি নির্বাচন বয়কট করে নিজেদের অনেকটাই পিছিয়ে দেয়। পরের পাঁচ বছরে তারা এতটাই পিছিয়েছে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিলেও তাতে জেতার মতো পরিস্থিতি তাদের ছিল না।
সরকারি দলের নানা কৌশলের মুখে তারা ছিল রীতিমতো অসহায়। ক্ষমতা তো দূরের কথা জাতীয় সংসদে মাত্র ৬ আসন নিয়ে বিএনপির অস্তিত্বই এখন প্রশ্নের মুখে। ২০১৪ এবং ২০১৮- দুটিই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন। প্রথমটি হয়েছে প্রার্থীবিহীন, পরেরটি ভোটারবিহীন। বয়কট করলেও ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রতিহত করতে পারেনি বিএনপি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের কারচুপির বিরুদ্ধেও মাঠে, রাজপথে, আদালতে, সংসদে কোথাও কোনো কার্যকর প্রতিরোধ গড়তে পারেনি দলটি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে প্রবল দাপুটে দলটিকে এখন শ্রীহীন, লক্ষ্যহীন, কৌশলহীন দল মনে হয়। এটা ঠিক বিএনপির ব্যাপারে সরকার একটু বেশিই কঠোর। আন্দোলনে নামলেই মামলা-হামলায় তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় সরকার। কিন্তু কোনো সরকারই চায় না বিরোধী দল আন্দোলন করুক। কমবেশি দমন-পীড়ন সবাই করে।
এরশাদ আমলে এর চেয়ে বেশি নিষ্ঠুরতার পরও বিএনপি তো মাঠেই ছিল। যার ফল তারা পেয়েছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচনে। কিন্তু এখন বিএনপিকে আর আগের মতো সাহসী মনে হচ্ছে না। আন্দোলন করে ক্ষমতায় যাবে, সে আশা বিএনপিও করে বলে মনে হয় না। বর্তমান সরকার নির্বাচন ব্যবস্থাকে যেমন হাস্যকর করে তুলেছে, তাতে নির্বাচনে জিতে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার আশাটাও সুদূর পরাহত। নিজেদের ওপর ভরসা হারিয়ে বিএনপি এখন অন্য কারও কাঁধে ভর করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। বিচ্ছিন্ন কোনো ইস্যুতে আন্দোলন হলেও তাতে তারা ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করে।
Advertisement
বিএনপির বেশি আশা বিদেশি শক্তির দিকে। ২০১৪ সালে ভারতে কংগ্রেসকে হারিয়ে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর উল্লাসের ঢেউ খেলে গিয়েছিল বিএনপি শিবিরে। তাদের আশা ছিল বিজেপি আওয়ামী লীগকে হটিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি পড়েছে। বিজেপি দ্বিতীয় ক্ষমতায় এলেও বিএনপির কপালে ক্ষমতার শিকে আর ছিড়েনি। এখন আবার আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা দখল দেখে বিএনপি শিবিরে একই সঙ্গে আফসোস এবং উল্লাসের ঢেউ লেগেছে।
বিএনপি শিবিরে আফসোস হলো, আফগানিস্তানে মোল্লারা বিনা যুদ্ধে ক্ষমতা দখল করে ফেললো আর বাংলাদেশের মোল্লারা সরকারের ভয়ে কাবু হয়ে আছে। ২০১৩ সালেও বিএনপি হেফাজতে ইসলামের ঘাড়ে ভর করে ক্ষমতায় আসার খোয়াব দেখেছিল। হেফাজত ঢাকা দখল করার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু সরকার কৌশলে রাতের মধ্যেই তাদের স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন বানিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ইস্যুতে মামুনুল হকের নেতৃত্বে হেফাজত আবার মাঠ গরম করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মামুনুল হকের গ্রেপ্তারেই তার অবসান ঘটেছে। এখানেই বিএনপি শিবিরে আফসোস। আফগান মোল্লারা পারলেও বাংলাদেশী মোল্লারা সরকারের দালালী করলো। অবশ্য তালেবানদের দখলদারিত্বে বিএনপি শিবিরের উল্লাসটাও গোপন নেই। তাদের আশা কোনো দৈব বলে যদি বাংলাদেশেও আফগানিস্তানের মতো পরিস্থিতি হয়। আফগানিস্তান আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে এক নয়, সেটা তারা নিজেরাও জানে। কিন্তু ডুবন্ত মানুষের খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো আফগানিস্তান থেকেও তারা অনুপ্রেরণা পেতে চাইছে। কিন্তু যারা ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’র মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চায়, তারা কীভাবে তালেবানদের সশস্ত্র ‘বিজয়’ এ উল্লসিত হয়; আমি বুঝি না।
আফগান ইস্যুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আসিফ নজরুলের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। তালেবানদের কাবুল দখলের পর সাধারণ আফগানরা পালাতে থাকে। হাজারো মানুষ ভিড় করে বিমানবন্দরে। যে যেভাবে পারে, ভয়ে-আতঙ্ক দেশ ছাড়তে মরিয়া ছিল তারা। কাবুল বিমানবন্দর পরিস্থিতি দেখে ড. আসিফ নজরুল লিখেছিলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে কাবুল বিমানবন্দর ধরনের দৃশ্য বাংলাদেশেও হতে পারে।‘ এই স্ট্যাটাসের একটা সরল ব্যাখ্যা হতে পারে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ হেরে যাবে। এটা হতেই পারে। টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা একটি অজনপ্রিয় হতেই পারে। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই বাংলাদেশে কাবুল বিমানবন্দরের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, এই বক্তব্যের সাথে আমি একমত নই। হতে পারে, এটা তার ধারণা বা আকাঙ্ক্ষা।
কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর আফগানিস্তানের পরিস্থিতি এক নয়। বাংলাদেশে আমরা অতীতে সুষ্ঠু নির্বাচন, অসুষ্ঠু নির্বাচন, বন্দুকের জোরে ক্ষমতা পরিবর্তন দেখেছি। গণঅভ্যুত্থানেও ক্ষমতা বদল হয়েছে। কিন্তু কখনোই কাবুলের মতো মানুষ প্রাণভয়ে পালায়নি। ড. আসিফ নজরুল নিজে একসময় সাংবাদিকতা করেছেন, বর্তমানে শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়মিত লেখালেখি করেন এবং তার বক্তব্য রাখেন। বাংলাদেশের রাজনীতিটা তার কাছ থেকেই দেখা। এত দেখেও তিনি কেন বাংলাদেশে কাবুল বিমানবন্দরের পরিস্থিতির আশা করেন, জানি না। সবসময়ই ক্ষমতার পালাবদলে কিছু লোক দেশ ছাড়েন। বর্তমান ক্ষসতাসীনদের অনেকেও বিভিন্ন দেশে বাড়ি কিনেছেন বলে পত্রিকায় পড়েছি। তাদের কেউ কেউ হয়তো পালাতেও পারেন। কিন্তু সাধারণভাবে কাবুল বিমানবন্দরের মতো দৃশ্যের পুনরাবৃত্তির কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
Advertisement
আসিফ নজরুলের স্ট্যাটাসের আরেকটি ব্যাখ্যা হতে পারে, সুষ্ঠু নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে গেলে বাংলাদেশে তালেবানদের মত ভয়ঙ্কর কোনো অপশক্তি ক্ষমতায় আসবে। যাদের প্রতিহিংসার ভয়ে আওয়ামী লীগ তো বটেই সাধারণ মানুষও ভয়ে পালাবে। ড. আসিফ নজরুল কি সত্যি সত্যি তেমন কোনো অপশক্তির উত্থানের আশঙ্কা করছেন? ক্ষমতার পালাবদলে কাবুল বিমানবন্দরের মত পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলেও অতীতে আমরা প্রতিহিংসার উদাহরণ দেখেছি। ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় আসার পর দেশের বিভিন্নস্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের স্মৃতি আমরা ভুলে যাইনি। আসিফ নজরুল কি তেমন কোনো প্রতিহিংসার আশঙ্কা করছেন। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকার বিরোধী লোকজনের আস্ফালন দেখে সে আশঙ্কার কিছুটা সত্যি হতে পারে বলে মনে হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াত সমর্থক বা সাম্প্রদায়িক অপশক্তি যেভাবে হুমকি দেয়- ‘সময় আসুক দেখে নেবো, কেটে ফেলবো, মের ফেলবো, দেশে থাকতে দেবো না’ তাতে প্রতিহিংসার আশঙ্কা করতেই পারেন।
তবে আসিফ নজরুলের স্ট্যাটাসের সঙ্গে আমার যতই ভিন্নমত থাকুক, এর প্রতিক্রিয়ায় ছাত্রলীগ এবং মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ যা করেছে; তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। স্ট্যাটাসের সাথে একমত না হলেও আমি তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সম্মান করি। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বাংলাদেশে কাবুল বিমানবন্দরের মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, এটা রাজনৈতিক বাস্তবতা না হলেও এই ধারণা প্রকাশ করার পূর্ণ অধিকার তার রয়েছে। অনেকে বলছেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানেই যা ইচ্ছা তাই লেখা বা উস্কানিমূলক লেখার অধিকার নয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে যে যা ইচ্ছা তাই লেখা নয়, সেটাও আমিও যেমন জানি, আশা করি আইনের শিক্ষক আসিফ নজরুলও জানেন।
সংবিধানে ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া আছে। আসিফ নজরুলের স্ট্যাটাসটি একটি রাজনৈতিক আকাঙ্খা, আমি মনে করি না, এখানে সংবিধান প্রদত্ত বাক ও ভাব প্রকাশের শর্ত ভঙ্গ হয়েছে। কারো যদি আসিফ নজরুলের স্ট্যাটাসের সাথে ভিন্নমত থাকে, তা লিখতে পারেন, যুক্তি দিয়ে তার পাল্টা স্ট্যাটাস দিতে পারেন, মিছিল করতে পারেন, স্লোগানও দিতে পারেন। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে মত থাকবে, ভিন্নমত থাকবে, যুক্তি থাকবে, পাল্টা যুক্তি থাকবে। কিন্তু আপনি যখন মতপ্রকাশের 'অপরাধে' একজন শিক্ষকের রুমে তালা লাগিয়ে দেবেন বা তার বিরুদ্ধে মামলা করবেন; তখন নিজেদের আর গণতান্ত্রিক দাবি করতে পারবেন না। মতপ্রকাশ করা অপরাধ নয়; যারা আসিফ নজরুলের রুমে তালা লাগিয়েছে, তারাই অপরাধ করেছে।
আমরা চাই দেশে সব মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। মত থাকবে, ভিন্নমত থাকবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন হবে। কিন্তু কারো প্রতিহিংসায় বা কারো ভয়ে কেউ দেশ ছাড়বে না। যারা ভিন্ন পথে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখেন বা ক্ষমতায় এসে ভিন্নমতের মানুষদের দেশ ছাড়া করার স্বপ্ন দেখেন; তাদের সে স্বপ্ন কোনোদিনই পূরণ হবে না। বাংলাদেশ কখনোই আফগানিস্তান হবে না।
২২ আগস্ট, ২০২১
এইচআর/এমকেএইচ