দেশজুড়ে

আজও মুছেনি স্প্লিন্টারের দাগ, ১৭ বছরেও পাননি সহায়তা

২০০৪ সালের ২১ আগস্টের কথা। সেদিন গ্রেনেড হামলায় আহত হন কৃষ্ণা পাটিকর। শরীরে বিদ্ধ হয় স্প্লিন্টার। সেই দাগ আজও মুছেনি। শরীরের ক্ষত চিহ্ন দেখলেই আঁতকে ওঠেন। এখনো যে বেঁচে আছেন তা অনেক সময় বিশ্বাস করতে পারেন না কৃষ্ণা।

Advertisement

এরই মধ্যে কেটে গেছে দীর্ঘ ১৭ বছর। এ সময় কোনো রকম গায়ের জোরে সংসার চালিয়ে গেলেও দিন দিন নিজের কাছে অনেকটাই খারাপ লাগতে শুরু করেছে কৃষ্ণার। সঙ্গে বেড়েছে শারীরিক ভোগান্তি। কারণ স্প্লিন্টারের ক্ষতস্থানে তীব্র ব্যথা অনুভব করছেন তিনি।

এদিকে বর্বরোচিত এ গ্রেনেড হামলার দীর্ঘ ১৭ বছর পার হলেও দলীয় কোনো সহযোগিতা পাননি বলে জানান কৃষ্ণা পাটিকর। তাই বৃদ্ধ বয়সে এসে একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন তিনি।

গ্রেনেড হামলায় আহত কৃষ্ণা পাটিকর কচুয়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের পাটিকর বাড়ির। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। কিস্তি নিয়ে সন্তানদের বিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে সংসার চালানোর পাশাপাশি কিস্তি পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। আগের মতো এখন আর গায়ে জোর নেই। চাইলেও অনেক কাজ করতে পারেন না। ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন তিনি।

Advertisement

গ্রেনেড হামলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কৃষ্ণা পাটিকর বলেন, ‘আমি ওই সময় বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সমাবেশে হাজির ছিলাম। কচুয়া থেকে উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আহসান হাবীব প্রানজল, দেবীপুর গ্রামের মিজান এবং আমাদের গ্রামের গাজী কামালের বাবা আব্দুল গফুরসহ আমরা চারজন ওই সমাবেশে যোগ দেই।’

তিনি বলেন, ‘আমি শারীরিকভাবে একটু বেঁটে হওয়ায় পেছন থেকে কিছু দেখতে পাইনি। তাই মানুষকে ডিঙিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাই। এতে আমি পৌঁছে যাই মঞ্চের খুব কাছাকাছি। একপর্যায়ে মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাই। মনোযোগ সহকারে বক্তৃতা শুনছিলাম।’

‘কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ বিকট শব্দ। ঠিক সেই সময় ডান পাশে থাকা লোকটি আমার গায়ের ওপরে লুটিয়ে পড়ে। আমি সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পড়ে যাই। প্রথমে কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। এ সময় আমার গায়ে সামান্য উষ্ণভাব লাগছিল। হাত দিয়ে বুঝতে পারলাম আমার শরীরে রক্ত লেগে আছে। সঙ্গে সঙ্গে একটির পর একটি বোমা বিস্ফোরিত হতে শুরু হলো। আমি দেখতে পেলাম আমাদের সব নেতাকর্মী বিভিন্ন দিকে ছোটাছুটি শুরু করেছেন।’

কৃষ্ণা পাটিকর বলেন, ‘এ সময় আমি দেখতে পেলাম আমাদের কচুয়ার নেতা ড. মো. মহীউদ্দীন খান আলমগীর স্যার ছোটাছুটি করছেন। আমি দ্রুত উনার কাছে গেলাম। তখন আমার শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছে। নিজের চিন্তা না করে স্যারকে বাঁচানোর জন্য তার কাছে ছুটে গেলাম। এ সময় একটি ভ্যানগাড়ি আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, তখন আমি তাকে অনুরোধ করে স্যারকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সে স্যারকে নিয়ে গেল।’

Advertisement

‘পরে আমাদের পাশের গ্রামের জামাল নামের একটি ছেলে ছিল, সে ট্রাভেলসের ব্যবসা করত। অনেক কষ্টে আহত অবস্থায় আমি তার মক্কা ট্রাভেলসে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তাৎক্ষণিক ওই ট্রাভেলসের মালিক জামালের ব্যবসায়িক পার্টনার আমাকে মনোয়ারা হাসপাতালে নিয়ে গেল। ওখানে যাওয়ার পর আমাকে চিকিৎসা দেয়া হয়। পরে কচুয়ার আওয়ামী লীগ নেতা প্রাঞ্জল সেখান থেকে তার বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে আমি কচুয়ায় চলে আসি। পরে পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘদিন কচুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়েছি।’

কৃষ্ণা পাটিকর বলেন, ‘সেই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে এখনো আমার হাঁটুতে, কোমরে এবং পায়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এতদিন যাই চলেছি এখন এসব স্থানে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব হয়। বর্তমানে চলাফেরা করতে খুব কষ্ট হয়।’

তিনি বলেন, ‘শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ঠিকমতো কাজ করতে পারি না। ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে অনেক টাকা ঋণগ্রস্ত হয়েছি। আমার রাজনৈতিক গুরু ও নেতাসহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জোরালো আবেদন করছি, আমার চিকিৎসার জন্য একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে। তাহলে হয়তো বৃদ্ধ বয়সে একটু বাঁচতে পারব।’

কচুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আহসান হাবীব প্রাঞ্জল বলেন, ‘২১ আগস্ট ওই সমাবেশে আমি নিজেও ছিলাম। তখন আমার খুব পানির পিপাসা পেয়েছিল, তাই পার্শ্ববর্তী একটি দোকানে পানির বোতল সংগ্রহ করতে যাই। ঠিক সে সময় বিকট শব্দ শুনতে পাই। সবাইকে চারদিকে ছোটাছুটি করতে দেখি। আমরা ডক্টর মহীউদ্দীন খান আলমগীর কোথায় আছে তাদের খোঁজাখুঁজি শুরু করি। পরে জানতে পারি আমাদের নেতা মহীউদ্দীন খান আলমগীর মনোয়ারা হাসপাতালে আছেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি সেখানে ছুটে যাই। সেখানে গিয়ে আমি কৃষ্ণা পাটিকরকে দেখতে পাই। পরে তাকে চিকিৎসা দিয়ে আমার বাসায় নিয়ে যাই।’

তিনি বলেন, ‘আমি সব সময়ই তার খোঁজ রাখি এবং আমার পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব আর্থিক সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করি। অসহায় আহত এই কর্মীকে যদি দল থেকে কোনো সহযোগিতা করা হয় এক্ষেত্রে সে ভালোভাবে থাকতে পারবে। আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আকুল আবেদন, অসহায় এই আহত নেতাকে যেন আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়।’

কচুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন সোহাগ বলেন, ‘২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় কৃষ্ণা পাটিকর আহত হয়েছে। পরে সে চিকিৎসা নিয়েছে। তবে বর্তমানে তার পরিবার নিয়ে চলাচল করতে একটু হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আকুল আবেদন, অসহায় এ আহত কর্মীকে যেন আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়।’

নজরুল ইসলাম আতিক/জেডএইচ/এমকেএইচ