পাকা নয় পুরাতন টিনে মোড়ানো ভাঙা টয়লেটে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে শিকলবন্দি করে রাখা হয়েছে শংকরী লাল গুহ (৪৫) নামের নারীকে। পরিত্যক্ত টয়লেটে বাঁশের মাচার ওপর কাঠের তক্তায় দুর্গন্ধে দিন কাটছে মানসিক ভারসাম্যহীন এ নারীর।
Advertisement
সরেজমিনে দেখা যায়, শংকরীর ডান পায়ের গোড়ালিতে লোহার শিকলে তালা দিয়ে টয়লেটের একটি বাঁশের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। দীর্ঘদিন পাটি বেঁধে রাখায় দাগ পড়েছে। শিকলেও ধরেছে মরিচা। পরনে একটি কালো রঙের জামা। পুরনো হয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। তা দিয়েই কোনো রকমে শরীরটি ঢাকা। মাথার চুলগুলোতে শক্ত হয়ে জট বেঁধেছে। এভাবে টয়লেটে বাঁধা অবস্থায় খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, পয়ঃনিষ্কাশনসহ সবকিছু চলে তার।
শংকরী লাল গুহ নেত্রকোনার দুর্গাপুর পৌর শহরের আমলাপাড়া মৃত শম্ভুলাল গুহের তৃতীয় সন্তান। তার বড়ো দুই বোন ও এক ছোট ভাই রয়েছেন। ছোটবেলায় খুব মেধাবী ছিলেন শংকরী। তিনি দুর্গাপুর বিরিশিরি মিশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন। বাবার মৃত্যুতে তার পরিবারে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। বাবার শোক কাটিয়ে মামার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও দরিদ্রতার কারণে নবম শ্রেণির গণ্ডি পেরোতে পারেননি তিনি।
এক সময় পড়াশোনা ছেড়ে সংসারের কাজে মনোযোগ দেন শংকরী। ২০০১ সালে নাকের সমস্যা দেখা দিলে কয়েকদিনের ব্যবধানে তা রূপ নেয় টিউমারে। স্বজনরা চিকিৎসা করে ভালো করলেও হঠাৎ করে অস্বাভাবিকভাবে পরিবর্তন হতে শুরু করে তার আচরণ। একপর্যায়ে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন শংকরী।
Advertisement
এরপর থেকে শুরু হয় শংকরীর বন্দিজীবন। পায়ের কখনো বা মোটা রশি কিংবা শিকল বেঁধে স্বজনরা শুরু করে আটকে রাখার চেষ্টা। পাগল মেয়েকে কোনরকম শান্ত রেখে সবসময় দেখাশোনা করতেন মা। ২০১৩ শেষের দিকে তিনিও পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। পুরো সংসারের ভার পরে ছোট ভাই জীবন লাল গুহের কাঁধে।
জীবন লাল গুহ স্থানীয় একটি বেসরকারি প্যাথলজিতে পিয়নের চাকরি করেন। স্বল্প আয়ে কোনোমতো সংসার চললেও বোনের চিকিৎসার অর্থ মিলাতে পারেননি তিনি। একটি মাত্র ভাঙা টিনের ঘরে গাদাগাদি করে থাকছেন পাঁচ সদস্যের পরিবার। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না পেয়ে বাড়ির পেছনের পুকুর ঘাটের সঙ্গে পরিত্যক্ত টয়লেটের ওপর টিনের বেড়া দিয়ে তার ভেতর রেখেন মানসিক ভারসাম্যহীন বোনকে।
স্থানীয়রা জানান, বছরের পর বছর ধরে আমরা শংকরীকে এভাবেই দেখছি। তাকে কখনোই বাইরে আসতে দেখা যায়নি। এভাবে একটা মানুষ কতদিন বাঁচতে পারে? তার জন্য আমাদের অনেক কষ্ট হয়। তার ভাইও খুব গরিব মানুষ। আর্থিক সঙ্কটে বোনটির চিকিৎসা করাতে পারছেন না। এখন যদি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারের পক্ষ থেকে কেউ এগিয়ে আসেন তাহলেই হয়তো শংকরী নতুন জীবনে ফিরে পেতে পারেন।
শংকরীর স্কুলের সহপাঠী শ্যামল রায় বলেন, অনেক মেধাবী ছাত্রী ছিলেন শংকরী। বেশিরভাগ সময় তিনি মামার বাড়ি শিবগঞ্জ থেকেই বিরিশিরি মিশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় পড়াশোনা করতেন। হঠাৎ করেই কী জানি হয়ে গেলো। পরিবারের সদস্যরা অনেক চিকিৎসা করিয়েছেন তবুও তাকে ভালো করতে পারেননি।
Advertisement
শংকরীর ভাই জীবন লাল গুহ বলেন, হঠাৎ করেই আমার বোন অসুস্থ হয়ে গেছে। আমরা চিকিৎসা করিয়েছি। প্রায় ২০ বছরের বেশি হয়ে গেছে তার মানসিক সমস্যা। অনেক কষ্ট লাগে, কিন্তু কী করবো! আমার সামর্থ্য নেই। সামান্য একটা চাকরি করে কোনো রকমে সংসার চলে। নিজের ঘর ভেঙে পড়ছে। এখন তার জন্য একটা ঘর করে দেবো তারও কোনো ব্যবস্থা নেই। টাকার সঙ্কটে চিকিৎসা করতে পারতেছিনা।
দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজিব উল আহসান বলেন, ওই নারীর অসুস্থতার বিষয়টি শুনেছি। আমি খুব দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করবো। এছাড়া খবর পেয়ে খাবারের ব্যবস্থা করেছি। ঘরের জন্য টিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এইচ এম কামাল/আরএইচ/এমএস