তাপস হালদার
Advertisement
২১ আগস্ট ২০০৪, বিকেল ৫.২২ মিনিট। স্তম্ভিত হয়ে গেলো বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্ব। ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সেদিন দেশব্যাপী সন্ত্রাস ও বোমা হামলার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সমাবেশ ও মিছিলের আয়োজন করা হয়েছিল। প্রধান অতিথি ছিলেন সেই সময়কার বিরোধী দলের নেতা, আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। মিছিল পূর্ব সমাবেশের জন্য একটি ট্রাককে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।বক্তব্য শেষে বিক্ষোভ মিছিলের জন্য ট্রাক থেকে নামতে যাবেন শেখ হাসিনা, ঠিক সেই সময়ে শুরু হয় গ্রেনেড হামলা। একটানা ১৩টি আর্জেস-৮৪ গ্রেনেড ছোঁড়া হয় যার মধ্যে ১২টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়,মঞ্চে উপস্থিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা মানব প্রাচীর তৈরি করে প্রিয় নেত্রীকে রক্ষা করেন।২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে রক্ত গঙ্গা বয়ে যায়,হয়ে উঠে মৃত্যুপুরী। শতশত মানুষের গগন বিদারী চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠে। পুরো এলাকা জুড়ে বিস্ফোরণে আহত-নিহতদের খণ্ড-বিখণ্ড দেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মীনি মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন নিহত ও প্রায় পাঁচশ জন নেতাকর্মী আহত হন।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় শরীরে স্পিন্টারের ভয়াবহ যন্ত্রণা নিয়ে আহতবস্থায় এখনও বেঁচে আছেন দলটির নেতাকর্মী, সাংবাদিকসহ শতাধিক ব্যক্তি। আহতদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাদের অনেকেই আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসতে পারেন নি। এটি ছিল ৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অসমাপ্ত কাজ। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার পরিকল্পনা। যুদ্ধে ব্যবহৃত গ্রেনেড দিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের সভায় হামলার ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল।
হামলার পর আহতদের ভিড়ে তিল ধারণের জায়গা ছিল না ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে।অথচ কর্তব্যরত ডাক্তাররা চিকিৎসা না দিয়ে সেসময়ে চলে গিয়েছিল। কারণ তারা ছিল বিএনপি সমর্থিত ড্যাবের ডাক্তার।খবর পেয়ে ঢাকা শহরের স্বাচিবের ডাক্তাররা ছুটে আসে আহতদের চিকিৎসা করতে।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল সরকারী হাসপাতাল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল যাতে করে আহতরা চিকিৎসা নিতে না পারে।তবে সেসময় মানবতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল কয়েকটি বেসরকারী হাসপাতাল,যার মধ্যে অন্যতম সিকদার মেডিকেল হাসপাতাল।
Advertisement
তখনকার সময়ে প্রযুক্তি এতটা উন্নত ছিলনা। চারিদিকে বিভিন্ন গুজব। দেশরত্ন শেখ হাসিনা জীবিত আছেন কিনা সেটাও তখন নিশ্চিত করে কেউ জানে না। ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে আহতদের সেবা করতে ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে দেখেছি হাত নেই,পা নেই যেকোন সময় হয়তো মৃত্যুবরণ করতে পারে এমন আহত নেতাকর্মীরাও কখনো নিজে বাঁচার আকুতি জানান নি।একটাই কথা আপা কি বেঁচে আছে?আপাকে বাঁচান।যখন সাড়ে সাতটার বিবিসি সংবাদে দেশরত্ন শেখ হাসিনা কথা বললেন,তখন সারা হাসপাতাল জুড়ে সে কি উল্লাস,কি আনন্দ। মুহূর্তেই যেন সকলে মৃত্যু যন্ত্রনা ভুলে গেলো। এটাই বঙ্গবন্ধু কন্যার সাথে নেতাকর্মীদের সম্পর্ক। আজও সেসময়ের কথা মনে পড়লে গা শিউরে উঠে।
এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর মতিঝিল থানায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মামলা করতে গেলে তৎকালীন পুলিশ সে মামলা গ্রহণ করেনি। ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করার জন্য তার আগেই পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করে। গ্রেনেড হামলার পরপরই আওয়ামী লীগের যেসকল নেতাকর্মী আহতদের উদ্ধার করছিলো তাদেরকে টিয়ার সেল ও লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। এবং হামলাকারীদের পালিয়ে যেতে সহযোহিতা করে।আলামত নষ্ট করতে মেয়র সাদেক হোসেন খোকার নির্দেশে সিটি কর্পোরেশনের লোকজন দ্রুত ঘটনাস্থল ধুয়ে মুছে ফেলে। খালেদা জিয়া প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা অধিদপ্তরকে তদন্ত করতে নিষেধ করে।আজ্ঞাবহ বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে লোক দেখানো এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে।এসব কিছুই ছিল ঘটনাকে আড়াল করার অপচেষ্টা।
এতবড় একটি রাজনৈতিক হত্যাকান্ডকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরণের আষাঢ়ে গল্প তৈরি করে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।প্রথমে এ হত্যাকান্ডে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত জড়িত এটি প্রমান করতে শৈবাল সাহা পার্থ নামে একজন নিরীহ কম্পিউটার ইন্জিয়ারকে গ্রেফতার করা হয়।পার্থ যেহেতু ভারত থেকে ইন্জিয়ারিং পাশ করছে তাই সে ভারতের চর এটা প্রমানের চেষ্টা করে।এর কয়েকদিন পর ঘটনাটি আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীন কোন্দল এটি প্রমান করতে মগবাজার এলাকার সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর আওয়ামী লীগ নেতা মোখলেছুর গ্রেফতার করা হয়।এদের ফাঁসাতে না পেরে ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগের একটি চায়ের দোকান থেকে জজ মিয়াকে বড় সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়। বলা হয় সে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের এজেন্ট হয়ে এ কাজ করেছে। জজ মিয়াকে দিয়ে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দেয়া হয়। কিন্তু ২০০৬ সালের আগস্টে জজ মিয়ার ছোট বোন খোরসেদা বেগম সরকারের পর্দা ফাঁস করে দেয়।তিনি গনমাধ্যমকে বলেন,ঘটনার জন্য জজ মিয়া পরিবারকে মাসে মাসে টাকা দেয় সিআইডি। এসব খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর জজ মিয়া গল্প আর এগোতে পারেনি। এর কিছুদিন পর বিএনপিই ক্ষমতাচ্যুত হয়ে যায়। তারপরই তো গনেশ উল্টাতে থাকে।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে মামলাটির নতুন করে তদন্ত শুরু করলে বের হয়ে আসতে থাকে একের পর এক নতুন তথ্য। গ্রেনেড হামলার মোট তিন দফা তদন্ত হয়েছে। ২০০৪ সালে ঘটনার পর বিএনপি-জামায়াত একটি ফরমাইশি তদন্ত করেছিল। তাদের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবেদন দাখিল করা হয়নি। বরং ওই সময় তদন্ত কর্মকর্তারা মামলাটিকে ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা করেন।সাজানো হয়‘জজ মিয়া’ নাটক। ওই ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে নতুন করে তদন্ত শুরু হয়। দ্বিতীয় দফার ওই তদন্তের পর ২০০৮ সালের ১১ জুন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ২২ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর দীর্ঘ তদন্ত শেষে সিআইডি ২০১১ সালের ৩ জুলাই বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান,জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ,সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু ও সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদসহ ৩০ জনকে আসামি করে আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়ার পর মোট আসামির সংখ্যা ৫২ হলেও মুফতি হান্নান,আলী আহসান মুজাহিদসহ তিনজনের অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় ৪৯ জনের বিচারিক আদালতে মামলার কার্যক্রম চলে।
Advertisement
তদন্তে বের হয়ে আসে তারেক-বাবরদের পরিকল্পনায় হরকাতুল জিহাদ (হুজি)র নেতৃত্বে কাশ্মির ভিত্তিক বিছিন্নতাবাদী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিন,তেহরিক জিহাদ-ই ইসলাম,লস্কর-ই-তৈয়বা এবং মায়ানমার ভিত্তিক রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এই পাঁচটি জঙ্গী সংগঠনকে এই হামলায় সরাসরি অংশগ্রহণ করে।।তাদেরকে হামলা করে নির্বিঘ্নে পালানোর ব্যবস্থা করা,পরবর্তী বিদেশে পালিয়ে যেতেও সহযোগিতা করেছে খালেদা জিয়া সরকার।
২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পক্ষ থেকে এমন অবিশ্বাস্য কথাও প্রচার করা হয়েছিল যে আওয়ামী লীগ নিজেরাই জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন পেতে ওই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। তাদের বক্তব্য ছিল, গ্রেনেড হামলা এমনভাবে করা হয়েছে যেন শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে যান এবং জোট সরকারকে একটি বিব্রতকর অবস্থায় ফেলানো যায়।সরকারের মন্ত্রী, এমপি,দলীয় নেতা ও ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী মিলে এক যোগে হিটলারের ‘গোয়েবলস' কায়দায় মিথ্যা প্রচারণা শুরু করে।
২০০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সংসদে হাস্যরস করে বলেছিলেন, তাঁকে (শেখ হাসিনাকে)কে হত্যা করতে চায়? শেখ হাসিনা নিজেই ভ্যানিটি ব্যাগে করে জনসভায় গ্রেনেড নিয়ে এসেছিলেন। আওয়ামী লীগ বিদেশীদের সহানুভূতি অর্জনের জন্যই নিজেদের লোকদের উপর হামলা করে।
ইতিহাস বড় নির্মম,সত্য একদিন বের হয়ে আসবেই। দীর্ঘদিন পর হলেও সেদিনের ষড়যন্ত্রকারীদের বিচারের রায় হয়েছে। তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী সহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন ও বাবর, পিন্টু সহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয়া হয়েছে।সেদিনের ঘটনা ধামাচাপা দিতে যা যা করার সবকিছু করেছে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তাহলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের বিচার হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া কিভাবে দায় এড়াতে পারেন?
২০০৪ এর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, আর ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ড- একই সূত্রে গাঁথা। একই রকম ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা। দুটির লক্ষ্য ছিল একই। সেটি হল বাংলাদেশকে আরেকটি পাকিস্তান বানানো। বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চিন্তা-চেতনাকে চিরতরে ধূলিসাৎ করে দেয়া। ’৭৫ এ পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। আর ২০০৪ সালে হামলায় নেতৃত্ব দিয়ে জিয়ার পুত্র তারেক রহমান। ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা একটি পরিকল্পিত গণহত্যা। প্রকাশ্য দিবালোকে যেভাবে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে এটি মানবতাবিরোধী অপরাধও। হামলায় যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল, তার প্রত্যক্ষ ও নেপথ্যের কুশীলবদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দ্রুত কার্যকরের মাধ্যমে দেশকে কলঙ্কমুক্ত করতে হবে।
লেখক: সদস্য,সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।haldertapas80@gmail.com
এইচআর/এমএস