ভ্রমণ

মাটির নিচের প্রাচীন নগর!

বাংলাদেশে বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক এক নিদর্শন হলো উয়ারী বটেশ্বর। দেশে পাহাড়পুর বা সোমপুর বিহার, মহাস্থানগড়, লালবাগ কেল্লা বা ষাটগম্বুজ মসজিদ ইত্যাদি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অবস্থান মাটির উপরেই। তবে জানেন কি, মাটির নিচে অবস্থিত এক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আছে এদেশে! আর সেটি হলো উয়ারী বটেশ্বর। হাজার বছরের পুরনো এক দুর্গ নগরী এটি।

Advertisement

প্রায় সবসময়ই পর্যটকদের আনাগোনা দিখা যায় উয়ারী বটেশ্বরে। সেখানে প্রাচীন বাংলার বৌদ্ধধর্মের প্রচুর নিদর্শন পাওয়া গেছে সেখানে। উয়ারী ও বটেশ্বর মূলত দু’টি আলাদা গ্রাম। পাশাপাশি হওয়ায় গ্রাম দু’টির নাম একসঙ্গে পরিচিতি পেয়েছে উয়ারী-বটেশ্বর হিসেবে।

ঢাকা থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত উয়ারী বটেশ্বর। নরসিংদী জেলা শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার উত্তরে বেলাব ও শিবপুর উপজেলার পাশে এ গ্রাম দু’টির দেখা মেলে। মরজাল হতে উয়ারী বটেশ্বর যেতে পথের দু’ধারে অসাধারণ সব প্রাকৃতিক নৈসর্গিক দৃশ্য পথিমধ্যেই আপনাকে মুগ্ধ করবে।

উয়ারী বটেশ্বর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে মেঠোপথে হাঁটতে হবে। ঘিরে রাখা প্রত্নতত্ত্ব স্থানে যাওয়ার আগেই চোখে পড়বে নানা খনন কার্যক্রম। উয়ারী ও বটেশ্বর নামক দুটো গ্রাম নিয়ে বিস্তৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর প্রাপ্তি স্থান। প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা এটি এক সময় মাটির নিচের দুর্গ নগরী ছিল।

Advertisement

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এগুলো প্রায় ২৫০০ বছর আগের পুরনো নিদর্শন। তবে ২০০০ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কৃত কিছু প্রত্ন নিদর্শনের কার্বন ১৪ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে, উয়ারীর বসতি খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ অব্দের, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জানা যায়, একদা খুব প্রসিদ্ধ ছিল এ নগরটি।

সেখানকার প্রাপ্ত নিদর্শনের মাধ্যমে আন্দাজ করা যায়, উয়ারী-বটেশ্বর গ্রামের শাসকদের সঙ্গে রোমান সাম্রাজ্যের যোগাযোগ ছিল। প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা সব একমত যে, উয়ারী-বটেশ্বর শুধু নগরই ছিল না-এটা এক সময় ব্রহ্মপুত্র নদরে কারণে প্রসিদ্ধ বাণিজ্য ও নৌ-বন্দরও ছিল। অথচ আজ চারপাশ শুধুই নীরব।

১৯৩০ দশকে স্কুল শিক্ষক মোহাম্মদ হানিফ পাঠান প্রথম উয়ারী-বটেশ্বর গ্রামের প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনের গুরুত্ব জনসমক্ষে তুলে ধরেন। পরে তার পুত্র মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ পাঠান ওই স্থানের প্রত্ন বস্তু সংগ্রহ ও গবেষণার কাজ শুরু করেন। দীর্ঘ বছর পর ১৯৯৬ সালে উয়ারী-বটেশ্বরে প্রত্নতত্ত্ব জরিপের কাজ সম্পন্ন হয়।

এরপর ২০০০ সাল থেকে নিয়মিতভাবে উয়ারী-বটেশ্বর গ্রামে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যক্রম শুরু হয়। সেখানকার প্রায় ৫০টি প্রত্নস্থান থেকে প্রচুর নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার। যেমন- নব্যপ্রস্তর যুগের কাঠের তৈরি হাতিয়ার ইত্যাদি।

Advertisement

আরও পাওয়া গেছে পাথরের তৈরি দু’ধারী কুঠার, ছুরি, হাতুড়ি-বাটালী, লৌহবল্লম ইত্যাদি। নরসিংদী জেলায় যে প্রাচীন শিল্প-বাণিজ্যের প্রথম প্রসার লাভ করেছিলো, তা জানা যায় এখানে প্রাপ্ত বিভিন্ন ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা, বাটখারা এবং আরো কিছু নিদর্শন থেকে।

সেখানে অসমরাজার গড় দুর্গ নগরীতে খননের ফলে তখনকার জনবসতির ব্যবহার্য অনেক জিনিসপত্রের নিদর্শনও পাওয়া যায়। যেমন- গর্তের ঘর, পানি সংগ্রহের কূপ, বিভিন্ন আকৃতির চুলা এবং কালো ও লাল রঙের পাত্র ইত্যাদি। সেইসঙ্গে তৎকালীন মানুষের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা প্রচুর পাথরের তৈরি খণ্ডও পাওয়া গিয়েছে।

বর্তমানে উয়ারী-বটেশ্বরে দেখার মতো নিদর্শনের মধ্যে আছে- পরিখা সম্বলিত ৬০০x৬০০ মিটার আয়তনের ৪টি দুর্গ-প্রাচীর ও অসমরাজার গড়। উয়ারী-বটেশ্বর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে শিবপুর উপজেলায় মন্দির-ভিটা নামে একটি বৌদ্ধ মন্দির আছে। জংখারটেক নামে পাশের একটি গ্রামে আরেকটি বড় বৌদ্ধমন্দির আছে। ধারণা করা হয়, উয়ারী-বটেশ্বরের প্রাচীন জনপদ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিল।

উয়ারী-বটেশ্বরের প্রায় ৫০টি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের মধ্যে প্রধান যেসব স্থান থেকে বেশি নিদর্শন পাওয়া গেছে সেগুলো হলো- রাঙারটেক, সোনারতলা, কেন্ডুয়া, মরজাল, টঙ্গীরাজার বাড়ি, টঙ্গীরটেক, জংখারটেক, মন্দির-ভিটা ইত্যাদি।

কীভাবে যাবেন?

ঢাকার সায়েদাবাদ ও মহাখালী থেকে বিভিন্ন পরিবহনের বাস ভৈরবের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। সেসব বাসে চড়ে নরসিংদীর মরজাল বাস স্টপিজে নামতে হবে। ভাড়া পরিবহন ভেদে জনপ্রতি ৬০-৬৫ টাকা। মরজাল হতে অটো’তে যেতে হবে উয়ারী-বটেশ্বর প্রত্নতত্ত্বস্থল।

জেএমএস/এমএস