মতামত

আশুরার শিক্ষা ও তাৎপর্য

আজ পবিত্র মহররম মাসের ১০ তারিখ। এ তারিখটি মুসলিম বিশ্বের কাছে গভীর শোকের দিন। এই দিনে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু অন্যায় ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে চক্রান্তকারী ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে কারবালার প্রান্তরে শাহাদত বরণ করেন। সেদিন প্রকৃত ইসলাম ও সত্যের জন্য হজরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু ইয়াজিদ বাহিনীর কাছে মাথানত না করে লড়াই করে শাহাদতবরণ করেছিলেন।

Advertisement

হজরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু সেদিন ন্যায় ও সত্যের জন্য চরম আত্মত্যাগের যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা অনুকরণীয়। শিয়ারা বর্তমানে হজরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদতের শোকে যে মাতম করে তা আবেগ তাড়িত এক বেদাত ছাড়া কিছুই নয়। তবে এবছরও করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় পবিত্র আশুরা উপলক্ষে সকল প্রকার তাজিয়া মিছিল ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করেছে সরকার। তবে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে আবশ্যক সব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা যাবে। গত মঙ্গলবার (১৭ আগস্ট) ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

হজরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর ত্যাগের কথা স্মরণ করে তার আদর্শ হৃদয়ে ধারণ করা। রাস্তা-ঘাট বন্ধ করে অপরকে কষ্ট দিয়ে শোক প্রকাশের কোন শিক্ষা ইসলামে নেই। এছাড়া শহীদে কারবালা হজরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু বলে গেছেন- ‘আমি শহীদ হলে তোমরা আমার জন্য উহ্! আহ্! করো না, আঁচল ছিঁড়ো না, বরং ধৈর্য ধারণ করে থাকবে।’

হজরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু খিলাফতে রাশেদার ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নিজ দেহের শেষ রক্ত বিন্দু পর্যন্ত দান করে গেছেন, যুগ যুগ ধরে তাঁর এই ত্যাগ মুসলিম উম্মাহকে খিলাফতে রাশেদার অনুরূপ আল্লাহ মনোনিত খলিফা ও ঐশী ইমামত-এর ছত্র-ছায়ায় জীবন অতিবাহিত করার অনুপ্রেরণা জোগাবে।

Advertisement

হজরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদতের ঘটনার জন্য প্রত্যেক মুসলমানই সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রকাশ করে থাকে আর শিয়ারা প্রত্যেক বছর মহররম মাসে নিজস্ব রীতি অনুসারে সেই দুঃখ এবং বেদনায় হা-হুতাশ করে থাকে। যদিও আমাদের দৃষ্টিতে তারা এক্ষেত্রে খুবই বাড়াবাড়ি করে। কারবালায় হজরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু, তাঁর পরিবারের সদস্যবর্গ এবং কয়েকজন সাথী সঙ্গীকে বড় নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। সত্যিকার অর্থে এ ঘটনা হজরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদতের ঘটনারই একটি ধারাবাহিকতা।

হজরত ইমাম হাসান ও হোসাইন সম্পর্কে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জান্নাতের যুবকদের সরদার তারা। তাদের উভয়ের জন্য রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তাআলার কাছে এই দোয়া করতেন যে, হে আল্লাহ্! আমি তাদের ভালবাসি, তুমিও তাদেরকে ভালবাস। অতএব, যারা রাসুলুল্লাহর দোয়ার কল্যাণ এতটা লাভ করেছেন আর একই সাথে যারা শাহাদতের পদমর্যাদাও লাভ করেন এমন মানুষ অবশ্যই আল্লাহ্র প্রতিশ্রুতি অনুসারে জান্নাতে মহান জীবিকা লাভ করবেন এবং তাদের হত্যাকারী অবশ্যই খোদার গযব এবং ক্রোধের শিকার হবে। আজ থেকে চৌদ্দশ বছর পূর্বে এই মহররম মাসে দশ তারিখে নিষ্ঠুর পাষাণরা রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই প্রিয়কে শহীদ করে। যে শাহাদতের ঘটনা শুনে গা শিউরে উঠে। এই পাষাণরা এক মুহূর্তের জন্যও চিন্তা করল না যে কাকে আমরা খড়গাঘাত করতে যাচ্ছি।মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে শিক্ষা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন তা কিভাবে পদদলিত হয়েছে হজরত হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদতের ঘটনার মাধ্যমে তা ফুটে উঠেছে। হজরত হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর সৈন্য বাহিনীর ওপর যখন শত্রু নিয়ন্ত্রণ পায় তখন তিনি ঘোড়াকে সমুদ্রমুখী করে অগ্রসর হওয়ার জন্য ইচ্ছা করেন তারপরও তাকে বাধা দেওয়া হয় এবং তার প্রতি তীর ছুঁড়া এবং সেই তীর হজরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর চীবুকের নিচে লাগে। বর্ণনাকারী বলেন, আমি শাহাদতের পূর্বে তাকে এই কথাই বলতে শুনেছি, আল্লাহর কসম, আমার পর আল্লাহর এমন কোন বান্দাকে তোমরা হত্যা করবে না যার হত্যার কারণে আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি আরো বেশী অসন্তুষ্টি প্রকাশ করবেন।

আমি আশা করি আল্লাহ তাআলা তোমাদের লাঞ্ছিত করবেন আর আমাকে সম্মানিত করবেন। এরপর আমার হত্যার প্রতিশোধ এমন ভাবে নেবেন যে, যা তোমরা ভাবতেও পার না। আল্লাহর কসম, আমাকে যদি তোমরা হত্যা কর তাহলে আল্লাহ তাআলা তোমাদের মাঝে যুদ্ধ সৃষ্টি করবেন এবং তোমাদের রক্ত ঝরবে। যতক্ষণ পর্যন্ত বেদনাদায়ক শাস্তিকে আল্লাহ্ বহুগুণে বৃদ্ধি না করেন তিনি বিরত হবেন না।

তাকে শহীদ করার পর কুফাবাসীরা তার পবিত্র লাশের সাথে কি ব্যবহার করেছে দেখুন, আমর বিন সাদ আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা দেয়, কে কে হজরত ইমাম হোসেনের মৃত দেহের উপর ঘোড়া দৌড়ানোর জন্য প্রস্তুত। এই কথা শুনে দশজন ঘোড়সোয়ার বের হয় যারা নিজেদের ঘোড়া নিয়ে তাঁর পবিত্র দেহের উপর ঘোড়া দৌড়ায় এবং পিষ্ট করে আর তাঁর বক্ষ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায়। এই যুদ্ধে হজরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু দেহ ৩৫টি তীরে আঘাত বিদ্ধ হয়।

Advertisement

তিনি এজিদের প্রতিনিধিদের একথাও বলেছিলেন যে, আমি যুদ্ধ চাই না, আমাকে যেতে দাও, আমি গিয়ে আল্লাহর ইবাদত করতে চাই বা কোন সীমান্তে আমাকে পাঠিয়ে দাও যেন ইসলামের জন্য যুদ্ধ করতে করতে আমি শাহাদত বরণ করতে পারি বা আমাকে এজিদের কাছে নিয়ে যাও যাতে আমি তাকে বুঝাতে পারি যে, আসল ব্যাপার কি। কিন্তু তার প্রতিনিধিরা কোন কথা শুনে নাই। অবশেষে যুদ্ধ যখন চাপানো হয় তখন বীরপুরুষের মত মোকাবেলা করা ছাড়া তাঁর আর কোন উপায় ছিল না। এই স্বল্পসংখ্যক মুসলমান যাদের সংখ্যা ৭০-৭২ হবে তাদের মোকাবেলায় ছিল এক বিশাল সৈন্যবাহিনী।

এদের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করা কোন ভাবেই সম্ভব ছিল না। একে একে তারা সবাই শাহাদত বরণ করেন। আল্লাহ তাআলার প্রতিশোধ নেয়ার নিজস্ব রীতি আছে যেভাবে হজরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজেই বলেছিলেন যে, আল্লাহ তাআলা আমার হত্যার প্রতিশোধ নিবেন আর আল্লাহ তাআলা প্রতিশোধ নিয়েছেনও।

হজরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর জীবনের একটি উদ্দেশ্য ছিল। তিনি কখনো রাষ্ট্র ক্ষমতা অর্জনের লোভ রাখতেন না, তিনি সত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। তিনি ন্যায়ের জন্য দণ্ডায়মান হয়েছিলেন। হজরত ইমাম হোসাইনের ত্যাগ, কোরবানি আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা রেখে গেছে। নিজের অধিকার নিজের জীবন বাজি রেখে পৃথিবীতে সত্যের প্রসার করেছেন সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি সত্য প্রচারের যে আদর্শ রেখে গেছেন তা সব সময় আমাদের আঁকড়ে ধরে রাখতে হবে। আর এর ওপর যদি আমরা প্রতিষ্ঠিত থাকি তাহলে সেই বিজয়ের অংশ হবে যা ইসলামের জন্য অবধারিত। কারবালা প্রান্তরে তাঁর শাহাদতবরণ ইসলামের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।

সত্য, ন্যায় এবং নবুওয়াতের পদ্ধতিতে আল্লাহর জমিনে সত্যিকারের ইসলামী খেলাফত পুনঃপ্রবর্তনের লক্ষ্যে হজরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর সঙ্গী-সাথিরা যে ত্যাগ ও কোরবানি স্বীকার করেছেন, কিয়ামত পর্যন্ত তা আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

তাই আসুন, হজরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদতের এ দিনে তাঁর আদর্শ হৃদয়ে ধারণ ও লালন করার অঙ্গীকার করি।

এইচআর/এমএস