মহামারি করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত সারা বিশ্ব। গত বছর করোনার প্রথম ঢেউয়ে বাংলাদেশে সংক্রমণ ও মৃত্যু কিছুটা কম ছিল। তবে এ বছর দ্বিতীয় ঢেউয়ে দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যু রেকর্ড ছাড়িয়েছে। সংক্রমণ রোধে টানা কঠোর লকডাউন আরোপ করে সরকার।
Advertisement
দীর্ঘদিনের লকডাউনে সুফল হিসেবে আগের তুলনায় মহামারি করোনাভাইরাসে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমেছে। ফলে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে নগরবাসীর মনে। এর মধ্যেই ফের এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। গত সপ্তাহজুড়ে প্রতিদিন আড়াইশ থেকে তিনশ রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। ফলে করোনা ‘ভুলে’ এখন ডেঙ্গু আতঙ্কে রাজধানীবাসী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত সাত হাজার ২৫১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রাজধানীসহ সারাদেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ৩১ জন। আক্রান্ত ও মৃতদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা বেশি।
জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৭২ জন। কিন্তু জুলাই থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে বাড়ে। জুলাইয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দুই হাজার ২৮৬ জন। তাদের মধ্যে ১২ জনের মৃত্যু হয়।
Advertisement
চলতি আগস্ট মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা আরও বেড়েছে। মাসের প্রথম ১৯ দিনেই আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৫৯৩ জনে। আর মারা গেছেন ১৯ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, সারাদেশের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা এখন এক হাজার ২৩৮ জন। তাদের মধ্যে এক হাজার ১৪৫ জন ঢাকার হাসপাতালে এবং ঢাকার বাইরে ৯৩ জন ভর্তি রয়েছেন।
ডেঙ্গু আতঙ্কের মধ্যেই শুক্রবার (২০ আগস্ট) ‘বিশ্ব মশা দিবস’ পালিত হচ্ছে। এবছর মশা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘ম্যালেরিয়াশূন্য লক্ষ্য অর্জন’।
১৯৩০ সাল থেকে প্রতিবছর ২০ আগস্ট দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ব্রিটিশ চিকিৎসক রোনাল্ড রস ১৮৯৭ সালের ২০ আগস্ট ম্যালেরিয়া রোগের কারণ ‘অ্যানিফিলিস প্রজাতির মশা’ আবিস্কার করায় এ দিনটি ‘বিশ্ব মশা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়।
Advertisement
স্বাধীনতার পর ৫০ বছর পার করেছে বাংলাদেশ। এ পাঁচ দশকে বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় বসেছে। মশক নিধন ও নিয়ন্ত্রণে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু মশার দাপট সব সরকারের আমলেই অব্যাহত রয়েছে।
স্বাস্থ্য ও রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১২৩ প্রজাতির মশা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় রয়েছে ১৪ প্রজাতির মশা। মশাবাহিত রোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া ও জাপানিজ এনকেফালাইটিস।
উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়া, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা ও মানুষের অসচেতনতার কারণে বাংলাদেশ মশার প্রজননের উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে পরিণত হয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।
চলতি বছর বিশ্ব মশা দিবসের প্রতিপাদ্য ‘ম্যালেরিয়াশূন্য লক্ষ্য অর্জন’ থাকলেও বর্তমানে মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে।
ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশার দুটি প্রজাতির মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়ায়। সেগুলো হলো, এডিস ইজিপ্টি ও অ্যালবোপিকটাস প্রজাতি। এডিস ইজিপ্টিকে শহুরে ও অ্যালবোপিকটাসকে গ্রামের মশা বলা হয়। এডিস মশা পাত্রে জমা পানিতে জন্ম নেয়। বর্ষাকালে এর ঘনত্ব বেশি হয়। তাই ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব এ সময়ে বেড়ে যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টারের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০০ সালে দেশে প্রথম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। ওই বছর পাঁচ হাজার ৫৫১ জন আক্রান্ত হয়েছিল, যার মধ্যে মারা যান ৯৩ জন। এরপর ২০১৯ সালে এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন। ওই বছর আক্রান্তদের মধ্যে ১৭৯ জন মারা যায়।
মশাবাহিত আরও যেসব ভাইরাস
চিকুনগুনিয়াডেঙ্গুর মতো চিকুনগুনিয়া রোগটিও এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। ১৯৫২-৫৩ সালে তানজানিয়ায় প্রথম চিকুনগুনিয়া শনাক্ত করা হয়। ২০০৫-২০০৬ সালে ভারতে ভাইরাসবাহিত এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে প্রথম চিকুনগুনিয়া ধরা পড়ে। ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছর চিকুনগুনিয়া রোগ শনাক্ত হয়। এ রোগে আক্রান্ত হলে হাড়সহ শরীরে ব্যথায় কাতর হয়ে পড়েন রোগী।
ম্যালেরিয়াঅ্যানোফিলিস মশার সাতটি প্রজাতির মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। এর মধ্যে চারটি প্রজাতিকে প্রধান বাহক বলা হয়। বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা ও সীমান্ত এলাকায় মোট ১৩ জেলার ৭২টি উপজেলায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। ২০০০ সালের পর সবচেয়ে বেশি ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায় ২০০৮ সালে।
২০০৮ সালে ৮৪ হাজার ৬৯০ জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং ১৫৪ জন মারা যায়। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে এ সংখ্যা কিছুটা কমে আসে। ওই বছর আক্রান্ত হয় ১৭ হাজার ২২৫ জন। ম্যালেরিয়া বাহক অ্যানোফিলিস মশা গ্রীষ্ম-বর্ষায় বেশি জন্ম নেয় এবং রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ে।
ফাইলেরিয়াফাইলেরিয়া বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম-দক্ষিণের প্রায় ৩৪টি জেলায় কম-বেশি পাওয়া যায়। এ রোগে মানুষের হাত-পা ও অন্যান্য অঙ্গ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ওঠে। স্থানীয়ভাবে এ রোগকে ‘গোদ রোগ’ বলা হয়ে থাকে। এক সময় এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি ছিল। তবে ফাইলেরিয়া এলিমিনেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে এটিকে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। ফাইলেরিয়া নেমাটোড জাতীয় কৃমি, ইউচেরিয়া ব্যানক্রফটি বাহিত মশার দ্বারা সংক্রমিত হয়। কিউলেক্স মশার দুটি প্রজাতি ও ম্যানসোনিয়া মশার একটি প্রজাতির মাধ্যমে বাংলাদেশে এ রোগ ছডায়।
জাপানিজ এনকেফালাইটিসএ রোগ বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৭৭ সালে। মধুপুর বন এলাকায় এর বিস্তার দেখা যায়। এরপর বিভিন্ন সময়ে রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রাম, খুলনা অঞ্চলে এ রোগটি পাওয়া যায়। জাপানিজ এনকেফালাইটিস রোগটি কিউলেক্স মশার মাধ্যমে ছড়ায়।
মশাবাহিত বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মশক নিধন ও নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। এর থেকে রক্ষা পেতে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে হবে। তিন দিনে এক দিন জমানো পানি ফেলে দিতে হবে।’
এমইউ/এএএইচ/এমএস