আফগানিস্তানে সক্ষম ও কার্যকরী নিরাপত্তা বাহিনী প্রতিষ্ঠা করে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে তালেবান সরকারের পতন ঘটিয়ে আজ থেকে ২০ বছর আগে হামিদ কারজাইকে রাষ্ট্রক্ষমতায় এনেছিল আমেরিকা। কিন্তু দুই দশক ব্যর্থ চেষ্টার পর তালেবানের হাতেই আবার আফগানিস্তানকে তুলে দিয়ে বিদায় নিয়েছে তারা। চোখের সামনে তালেবান দ্বারা রাজধানী কাবুলের দ্রুত পুনর্দখল, আমেরিকার পুতুল সরকারের পলায়ন- নিশ্চয়ই মার্কিনিদের জন্য সুখের নয়। আফগানিস্তানে তাদের লজ্জাজনক পিছু হটা আমেরিকানদের জন্য একটি ট্র্যাজেডি।
Advertisement
ট্র্যাজেডি, কারণ আমেরিকানরা পৃথিবীতে ‘অপরিহার্য জাতি’ হওয়ার স্বপ্ন দেখে যেখানে বিশ্বকে বদলে দিয়ে তারা নাগরিক অধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন ও ধর্মীয় সহনশীলতা নিশ্চিত করবে। কিন্তু স্বপ্ন পূরণে যে সততা দরকার সে পথে তারা হাঁটে না বলেই তাদের স্বপ্ন অধরা রয়ে যায়। তেমনই আফগানিস্তানে এসে তাদের মনে হয়েছে আসাটাই চরম ভুল। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষায়, ‘দেশের ইতিহাসের নিকৃষ্টতম সিদ্ধান্ত’। মাঝখান দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে হারাতে হয়েছে ২ হাজার ৪৫০ জন সৈন্য, রাষ্ট্রের করদাতাদের দুই ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ।
তাহলে চলে যাওয়া ছাড়া কী করার ছিল আমেরিকার! কিছুই না। যদি আফগানিস্তানে আরও থাকতো তাহলে আরও কিছু রক্তপাত, আরও কিছু অর্থব্যয় ছাড়া তাদের অর্জন শূন্য থাকতো। সে কারণেই প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলছেন, পূর্বসূরিদের কাছ থেকে পাওয়া এ আপদ থেকে সরে যাওয়ার এটাই ছিল সঠিক সময় এবং তিনি যথার্থই করেছেন। বাইডেন না এসে ক্ষমতায় ট্রাম্প থাকলে এটা কি ঘটতো না? অবশ্যই ঘটতো এবং ট্রাম্প নিজেই তো আফগানিস্তান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, দীর্ঘ আলোচনা শেষে ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি তালেবানদের সঙ্গে চুক্তি করে।
ওই চুক্তির পরপরই জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য ৫ মার্চ ২০২০ লিখেছিলাম- তালেবানদের সঙ্গে মার্কিনিরা স্বাক্ষর করল পরাজয়ের দলিল। বলেছিলাম, ‘আমেরিকা ২০০১ সালে মোল্লা ওমরের সরকারের বিরুদ্ধে যেই যুদ্ধ শুরু করেছিল, ২৯ ফেব্রুয়ারি কাতারের দোহায় তালেবানের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করে তা থেকে বিরত হওয়ার এবং আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে দৃশ্যত হার মেনেছে। এখন পর্যন্ত তালেবানকে দেখে মনে হচ্ছে না যে তারা আমেরিকা বা আফগান সরকারকে কোনো ছাড় দেবে এবং চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টিকে তারা নিজেদের বিজয় হিসেবে দেখছে। তালেবানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও বৈধতাও এর মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে গেছে। চুক্তির সময় দোহায় তালেবানের মধ্যে যে উচ্ছ্বাস দেখা গেছে তাতে বোঝা গেছে চুক্তির শর্তগুলোকেও তারা নিজেদের লক্ষ্য অর্জনের সুযোগ মনে করছে।’
Advertisement
সুতরাং আজ যাদের মনে হচ্ছে হঠাৎ করে তালেবান কাবুল দখল করে ফেলেছে তারা ভুলের মধ্যে আছেন। চুক্তি অনুযায়ী ১৪ মাসের মধ্যে তাদের আফগানিস্তান ত্যাগের কথা ছিল। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় এসে সেটা কয়েক মাস বাড়িয়েছেন শুধু। বাইডেন যেটা ভুল করেছেন সেটা হচ্ছে চুপিসারে ২ জুলাই ২০২১ সব সৈন্য প্রত্যাহার করে কাবুলের পতন ত্বরান্বিত করা। নিজেদের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করলেও আফগান সরকারের সঙ্গে তালেবানের স্থবির আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে কোনো চুক্তি বা সমঝোতায় ভূমিকা রাখেননি। এটাও ঠিক তালেবানের ইসলামী রাষ্ট্র আর আশরাফ গানিদের আধুনিক গণতান্ত্রিক আফগানিস্তান- এই দুই ধারণার মধ্যে সমন্বয় করা এতো সহজ নয়। কিন্তু এ বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের চেষ্টাও দৃশ্যমান ছিল না। তালেবান এবং কাবুল সরকার আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে তাদের একটি সমন্বিত সংবিধান রচনার দরকার ছিল। সেটা হয়নি।
পতাকা নিয়ে বিরোধ থামেনি। প্রতিবারই দেখা যাচ্ছে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে রাষ্ট্রটির পতাকা পরিবর্তন হচ্ছে। এতে স্পষ্ট যে জাতিগত ঐক্য, জাতিয়তাবাদী চেতনা আফগানিস্তানে অনুপস্থিত। বিভিন্ন আফগান জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রতি বাড়িয়ে ঐক্যবদ্ধ আফগান জাতি গঠনে আমেরিকা কোনো ভূমিকাই রাখেনি।
অবশ্য আফগানিস্তানে ট্র্যাজেডি শুধু আমেরিকানদের জন্য রচিত হয়নি। আফগানিস্তানকে বলা হয়, ‘সম্রাটদের কবরস্থান’। ১৮৪২ সালে ব্রিটিশ গিয়েছিল আফগানিস্তান দখল করতে, ১৯৭৮ সালে ফ্রেন্ডশিপ চুক্তির আড়ালে সোভিয়েত ইউনিয়নও গিয়েছিল এবং ২০০১ সালে ’ওয়ার অন টেরর’ নামে আমেরিকা গিয়েছিল- সবাইকে একই ভাগ্যবরণ করতে হয়েছে। এটা ঘটেছে কারণ আফগানদের মতো স্বাধীনচেতা জাতি বিশ্বে বিরল। তারা সবসময় যুদ্ধ করেছে তাদের চেয়ে বেশি শক্তি সম্পন্ন শক্তির সঙ্গে। এ নিয়ে কখনো আফগানরা বিব্রতবোধ করেনি।
এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এই তালেবানরা কি আবার আফগানিস্তানে জঙ্গি শাসন ফিরিয়ে আনবে নাকি সুশাসন? আমরা আজ ২০ বছর আগের তালেবান নই- বললেই কি তাদের বিশ্বাস করা যাবে?
Advertisement
১৫ আগস্ট ২০২১ কাবুল দখল করার পর ১৭ আগস্ট প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি জানার আগ্রহ নারীদের বিষয়ে তিনি বলেছেন, “নারীরা আমাদের সমাজে খুবই সক্রিয় ভূমিকা রাখবে” এবং তারা বাইরে কাজ করতে পারবে, সেটা হবে “আমাদের শরিয়াহ আইনের কাঠামোর মধ্যে”। কাজের ধরন সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু ব্যাখ্যা করেননি।
লক্ষণীয় একটি বিষয় হচ্ছে, আমেরিকার সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিতেও তালেবান নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে ছাড় দেয়নি। নারী স্বাধীনতা বিষয়ে চুক্তিতে কোনো শর্ত না মানার কথাই বলেছে তালেবান এবং শেষ পর্যন্ত সেই শর্ত বাদ দিয়েই এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ফলে নারীদের প্রতি তালেবানের মনোভাব যে খুব উন্নত হবে এখন পর্যন্ত আমি তার কোনো লক্ষণ দেখছি না। একটুখানি সান্ত্বনা যে তালেবানি বোরকা থেকে সরে এসে হিজাবের মধ্যে নারীদের থাকতে বলেছে তারা। তালেবান কাবুল দখলের পর সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় আছে এখন। সরকার গঠনের পর মেয়েরা স্কুল-কলেজে যাচ্ছে, নির্ভয়ে আছে, সেই দৃশ্য দৃশ্যমান হওয়ার আগে তালেবানদের বিশ্বাস করা কঠিন।
আরও একটি প্রশংসার কথা হচ্ছে- দেশ গঠনে ‘সব পক্ষ, সব গোষ্ঠী, সবার অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করবে’ বলছে তারা। বলেছে, ‘কারও বিরুদ্ধে কোনোরকম প্রতিশোধ নেয়া হবে না’ এবং তালেবান ‘আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা ও শান্তির কথা মাথায় রেখে সবাইকে ক্ষমা করেছে।’
তালেবান সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাকে সম্মান প্রদর্শনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং অঙ্গীকার করেছে ‘বেসরকারি মিডিয়া স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে’। মিডিয়ায় ইসলামী মূল্যবোধের পরিপন্থি কিছুই প্রচার করা যাবে না- জানিয়ে দিয়েছেন। তালেবান শাসনের অধীনে আফগানিস্তান আল-কায়েদা বা অন্য চরমপন্থী যোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠবে কিনা- এ প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন ‘আফগানিস্তানের মাটি কারও বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না।’ অবশ্য এ প্রতিশ্রুতি আমেরিকানদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিতেও বলা হয়েছে।
সার্কিকভাবে এটা মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, এই তালেবান ১৯৯৬-২০০১ সালের সেই তালেবান থেকে ভিন্ন। কিছুটা মডারেট হয়েছে। কয়েকজন ইংরেজিও বলছে। ভালো পিআর শিখেছে। মডারেট না হয়েও তাদের উপায় নেই কারণ বিশ্বের চোখ তাদের ওপর। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পেলে তালেবান শাসন ক্ষণস্থায়ী হতে বাধ্য এবং বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা কাটিয়ে ওঠা তালেবানের পক্ষে সম্ভব নয়।
তাই বলে এখন বিশ্ব যদি ভাবে মডারেট হওয়া মানে তাদের হতে হবে ইরান কিংবা মধ্যপ্রচ্যের আমিরাতি সরকারদের মতো- তাহলে সেটা হবে আরেক ভুল। সেটা যদি তারা করতে যায়- তালেবান আর তালেবান থাকে কই! তারা নিজস্ব চরিত্র হারিয়ে আশরাফ গানির সরকার হয়ে যাবে। হয়ে যাবে আমেরিকা নয়, হয়তো অন্য কারও পুতুল সরকার। আমরা চাই আফগানিস্তানে শান্তি আসুক, আফগানরা নিজেদের মতোই এগিয়ে যাক। নারী-পুরুষ সবাইকে মানুষ হিসেবে দেখুক তালেবান সরকার।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। anisalamgir@gmail.com
এইচআর/জিকেএস/ফারুক