মওলবি আশরাফ
Advertisement
আল্লাহ রব্বুল আলামিন কোরআনুল কারিমের দ্বিতীয় ও সবচেয়ে বড় ‘সুরা বাকারার দ্বিতীয় আয়াতে এ মহাগ্রন্থের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন- هُدًى لِّلْمُتَّقِیْنَۙ ‘ইহা (কোরআন) মুত্তাকি তথা আল্লাহকে ভয়কারীদের জন্য হেদায়েত বা পথ প্রদর্শক।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২)
হেদায়েত শব্দের অর্থ পথপ্রদর্শক। সাধারণ চোখে দেখলে হেদায়েতের প্রয়োজন হওয়ার কথা পথভ্রষ্ট বা গোমরাহদের, কিন্তু কোরআনে কেন মুত্তাকিদের কথা প্রথমে বলা হলো; অথচ তারা কিনা আগে থেকেই আল্লাহকে ভয় করে?
যদি আমরা মুত্তাকি শব্দের প্রকৃত অর্থ বুঝি তবে নিশ্চিত এই মর্মে এই প্রশ্নের সমাধান পাব যে- কোরআনের বর্ণনায় মুত্তাকি কারা?
Advertisement
কোরআনের বর্ণনায় মুত্তাকির পরিচয়
‘তাকওয়া’ শব্দ থেকে ‘মুত্তাকি’র উৎপত্তি । হজরত কাতাদাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘মুত্তাকি তারাই, যাদের কথা আল্লাহ আয়াতের পরবর্তী অংশে বলেছেন।’ আল্লাহ তাআলা মুত্তাকিদের গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন-
الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ - والَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنزِلَ مِن قَبْلِكَ وَبِالآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ ৎ
‘যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করে এবং যে রিজিক আমি তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে খরচ করে। আর যে কিতাব তোমাদের ওপর নাজিল করা হয়েছে এবং তোমার আগে যেসব কিতাব নাজিল করা হয়েছিল সে সবগুলোর ওপর ঈমান আনে আর আখেরাতের ওপর বিশ্বাস রাখে।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ৩-৪)
Advertisement
> অদৃশ্যে বিশ্বাস
এ আয়াতে ‘গায়েব’ দ্বারা এমন জিনিসকে বোঝানো হয়েছে, যা মানুষ পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহায্যে জানতে পারে না। আমরা কেবল বস্তুর উপরিভাগকে (Surface) জানতে পারি, কিন্তু বস্তুর প্রকৃত রূপ (Thing-in-Itself) জানতে পারি না। জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট যাকে Noumenon বলেন। গায়েবের ওপর বিশ্বাস মানে একথা স্বীকার করা যে, ‘আমার জ্ঞানের বাইরেও জ্ঞান আছে, যে জ্ঞান একমাত্র স্রষ্টাই রাখেন।’
> নামাজ প্রতিষ্ঠা
নামাজ প্রতিষ্ঠা করার অর্থ হলো সৃষ্টির সেজদা কেবলই স্রষ্টার জন্য। অন্য কোনো সৃষ্টির জন্য নয়। এই মত সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা। তাইতো আল্লামা ইকবাল বলেন-
یہ ایک سجدہ جسے تو گراں سمجھتا ہے
ہزار سجدے سے دیتا ہے آدمی کو نجات
‘এই এক সেজদা, যাকে তুমি কঠিন ভাবো; (যা) হাজারও সেজদা থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়।’
> রিজিক থেকে ব্যয়
আল্লাহ তাআলা যা রিজিক দিয়েছেন তা থেকে খরচ করার অর্থ হলো- ধনী-গরিবের মাঝে সাম্যতা প্রতিষ্ঠা করা। কোরআনের অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-
كَيْ لَا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاء مِنكُمْ
‘তোমাদের ধন-দৌলত যেন কেবল সম্পদশালীদের মধ্যেই না ঘোরে।’ (সুরা হাশর : আয়াত ৭)
> আসমানি কিতাবে বিশ্বাস করা ও মেনে নেওয়া
অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নাজিল হওয়া কিতাব এবং আগের নবি-রাসুলদের উপর নাজিল হওয়া কিতাবের ওপর বিশ্বাস রাখা। আর পরকালের প্রতি যারা বিশ্বাস স্থাপন করে। আল্লাহ তাআলা উল্লেখিত গুণের অধিকারীদের ‘মুত্তাকি’ বলে পরিচয় দেওয়ার পর আয়াতের পরবর্তী অংশে তাদেরকে সুসংবাদ দিয়েছেন।
তাকওয়ার ব্যাখ্যা
তাকওয়ার ব্যাখ্যায় হজরত আবদুল কাদের জিলানি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর লিখিত গ্রন্থ ‘গুনইয়াতুত ত্বালেবিন-এ কোরআনুল কারিমের এ আয়াত তুলে ধরেন-
إِنَّ اللّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالإِحْسَانِ وَإِيتَاء ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاء وَالْمُنكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ
আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার আদেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অসঙ্গত কাজ এবং অবাধ্যতা করতে বারণ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যেন তোমার তা গ্রহণ করো।’ (সুরা নাহল : আয়াত ৯০)
মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মতে, ‘কোরআনে ব্যবহৃত কোনো শব্দের প্রকৃত তফসির হলো- কোরআনে ওই শব্দটি যত জায়গায় ব্যবহার হয়েছে এবং সেখানে আল্লাহ কী কী অর্থে ব্যবহার করেছেন তার একত্রিত ফলাফল।’ তাই মুত্তাকি বিষয়ে মওলানা সিন্ধি বলেন-
‘মুত্তাকি বা আল্লাহভীরু হওয়া হলো এমন যোগ্যতা, যার ফলে মানুষ ইনসাফকারী ও ন্যায়ানুগ হয়। এই কারণে যিনি কোরআনে বিশ্বাস স্থাপন করেন তাকে প্রথমে ইনসাফের যোগ্যতা হাসিল করতে হবে, আর এমন লোকের জন্যই কোরআন হতে পারে হেদায়েত।’
অতঃপর মওলানা সিন্ধি বলেন, ‘কোরআনের যেখানেই তাকওয়া শব্দ ব্যবহার হয়েছে, সেখানে তাকওয়ার বৈশিষ্ট্য ঠিক আয়াতে উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যেরই বিস্তারিত বিবরণ। একারণেই কোরআনে বিষয়টি এভাবে ওঠে এসেছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُونُواْ قَوَّامِينَ لِلّهِ شُهَدَاء بِالْقِسْطِ وَلاَ يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلاَّ تَعْدِلُواْ اعْدِلُواْ هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُواْ اللّهَ إِنَّ اللّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনও ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। সুবিচার কর; এটাই আল্লাহভীতির অধিক কাছাকাছি অবস্থান। আর আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ সে বিষয়ে খুব খবর রাখেন।’ (সুরা মায়েদা : আয়াত ৮)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী প্রকৃত মুত্তাকি হওয়ার তাওফিক দান করুন। মুত্তাকি হয়ে দুনিয়া ও পরকালের সফলতা লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম