আফগান পরিস্থিতি এবং এর জের নিয়ে অন্তহীন আগ্রহ ও প্রশ্নের ঝড় বাংলাদেশে। এসব প্রশ্নের জবাব নানান তবে, যদি, কিন্তুতে ভরপুর। তারপরও অসম্পূর্ণ জবাব। আর কথার পিঠে কথাতো আছেই। ক্যামনে কী করে বসলো মোল্লা ওমরের জাত-গোষ্ঠী? কূটনীতির এমন বিশ্বম্যাজিক তারা শিখলো কোথায়? বিশ্ব রাজনীতির মারপেঁচে মার্কিনীদের এভাবে চুবানি দিলো চীন-রাশিয়া-পাকিস্তান? যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান থেকে নাটকীয় পিছটানের পেছনে কোনো অতিনাটক নেই তো? বাংলাদেশে এর কেমন জের পড়তে পারে? এর ফল কে খাবে? হেফাজত না জামায়াত? সরকার তা সামলাবে কিভাবে?– এমনতর প্রশ্নের পর প্রশ্ন।
Advertisement
উৎসুকরা কেবল জানতে চান। নিজেদের চাওয়া-পাওয়ারও ঠিকঠিকানা নেই। তারা আফগানিস্তানে তালেবানি অ্যাকশনে খুশি। আবার বেজারও। সঙ্গে আতঙ্কও। বিশ্লেষকদের কোনো হিসাব মিলছে না। যদি, কিন্তু, তবে যুক্ত বাক্যে কতো যে ভবিষ্যতবাণী, তাগিদ, পরামর্শ! তালেবানদের নামের সঙ্গে ‘জঙ্গি’ যোগ করা থেমে গেছে। তালেবানরা কি ধরনের বৈদেশিক ও অভন্তরীণ নিয়ম চালু করে সেটা দেখারও অধীর প্রতীক্ষা। কোন দেশ আগে আফগানিস্তানের নতুন তালেবান সরকার কে স্বীকৃতি দেয়-তা দেখতে নির্ঘুম অনেকে। তালেবান যোদ্ধাদের নিয়ে গালমন্দ-ক্রিটিসাইজ করা, জঙ্গী-কাঠমোল্লা নামে গাল দেয়াদের একটু রয়েসয়ে চলতে হচ্ছে। ভারতের স্বাধীনতা দিবস, বাংলাদেশের জাতীয় শোকদিবসে তালেবানদের জয়। তারা দেশটি দখল করলো না, মুক্ত করলো-সেই প্রশ্নও কম নয়। এ রকম সময়েই সিনোফার্মের টিকা তৈরির চুক্তিতে মেলবন্ধন হলো বাংলাদেশ-চীনের মধ্যে। প্রস্তাবটা চীন আগেই দিয়েছিল।
আফগান পরিস্থিতির পর চুক্তিতে আসতে সময় লাগেনি। চীনের মুরুব্বিয়ানায় তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিতে দেরি করবে না, দৌড়ে এগিয়ে যাবে?– এ প্রশ্নও জ্বলন্ত। এর মাঝেই কাবুলে আটকে পড়া ৪৫ হাজার দোভাষী ও সেনা সদস্যকে নিয়ে যেতে বাংলাদেশের কাছে বিমান চাওয়ার পর এবার কিছু আফগানকে বাংলাদেশে এনে আশ্রয় দেয়ার প্রস্তাব করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সরকার বিমান দেবার বিষয়টি বিবেচনায় রাখলেও আফগানদের থাকতে দেয়ার প্রস্তাব নাকচ করেছে। ধনে-জনে সামর্থবান আরো বিভিন্ন দেশের কাছেই তারা এই পয়গাম পাঠিয়েছে। আফগানিস্তানের পাশের দেশ পাকিস্তানও তো আছে। নরম দিলের বাংলাদেশকে তারা আরো অতিথি পরায়ন করতে চায় কেন? এর আগে চীন তার পাশের দেশ মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ঢুকিয়ে অতিথি সেবা নিয়েই চলছে।
এ রকম সময়ে রীতিমতো বোমা ফাটালেন ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তার কথা, কথার অর্থ, উদ্দেশ্য বুঝতে সময় সময় লাগে। অনেকে বুঝেও উঠতে পারেন না। এবার তিনি সরকারকে রোহিঙ্গাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছেন। কিসের মধ্যে কী? আহ্বানটি যেনতেন জায়গায় নয়, ভার্চুয়ালেও নয়। একেবারে অ্যাকচুয়ালে। শহিদ মিনারে প্রকাশ্য এক সমাবেশে। বর্তমান পরিস্থিতি ও বিশ্ব বাস্তবতায় এ আহ্বান কতোটা প্রাসঙ্গিক? সম্ভব? প্রকাশ্যে মুখে আনার মতো?
Advertisement
তিনি করোনা কিট বানানোর উদ্যোগ নিতে চেয়েছিলেন। তার বড় সেটআপ আছে। তার বিশ্ববিদ্যালয় এটা করতে পারে। কিন্তু তাকে সেটার অনুমতি দেয়া হয়নি। পরে টিকা তৈরির অনুমতি দেয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন। সেটাও দেয়নি সরকার। কিট-টিকা বানানোর চেয়ে এখন কেন রোহিঙ্গাদের গোলাগুলি শেখানো সহজ হয়ে গেল? সামনে আরো কী দেখা লাগতে পারে মধ্যচিন্তার মানুষের মধ্যে সেই অপেক্ষা স্পষ্ট। চতুররা এদিক-ওদিক ঢুঁ মারছে। নানা কথা বলছে। মধ্যচিন্তার সঙ্গে পোড় খাওয়ারা এ ব্যাপারে অতি সাবধানী।
তালেবানরাই আফগান, তারাই আফগানিস্তানবাসী?- এ প্রশ্ন মাথায় রাখতে হচ্ছে। আফগানানদের বৈশিষ্ট্য একটু ভিন্ন। জহির শাহ্কে খেদিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন সেখানে বিপ্লব রপ্তানি করতে চেয়েছিল। আফগানরা তা ঠেকিয়েছে। এবার খেদিয়েছে সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রকে। দীর্ঘ দাঙ্গার পর শেষ সিকুয়েন্সে কূটনীতিতে ঘানিসহ রাজাকার সরকারের মন্ত্রী-নেতাদের তাজাকিস্তানে প্যাকেট করার মতো পাঠিয়ে দিয়েছে। সমাজতন্ত্র কায়েম করে কথিত প্রগতিশীল আফগানিস্তান গঠনের উসিলায় বর্বব সোভিয়েত বাহিনী ১৯৭৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর আগ্রাসন শুরু করে।
প্রায় দশ বছরব্যাপী অভিযানে ১৫ লাখের উপর আফগান নিহত হয়। মূলত: এই অযথা আগ্রাসনের কারণেই তৈরি হয় মুজাহিদীন যা পরবর্তিতে বিভিন্ন আঙ্গিকে ছড়িয়ে পড়ে মুসলিম দেশগুলোর বেশক’টিতে। আজ যারা আধুনিক আফগানিস্তান ছিল বলে কিছু স্কার্ট পরা মেয়েদের ছবি দিচ্ছেন তাদের জন্য সোভিয়েত আগ্রাসনটি বিবেচনায় নেয়া দরকার। আফগানিস্তানের গ্রামাঞ্চলের সংস্কৃতি গায়ের জোরে পরিবর্তন করতে যাওয়ায় যে মনোজাগতিক পরিবর্তন ঘটেছে তারই প্রতিক্রিয়া আজকের আফগানিস্তান।
বাংলাদেশের অবস্থা আফগানিস্তানের মতো নয়। তবে, কিছু মিল আছে। তালেবান বৈশিষ্ট্যের হেফাজত-জামায়াতের কদর আছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। বাংলাদেশে তালেবানি শাসন নেই। সদরে ধর্মনিরপেক্ষ। অন্দরে প্রচুর গরল। এখানে টুপি, বোরখা-হিজাব রাজনীতিতেও ঢুকেছে। বা ঢোকানো হয়েছে। হতে পারে টুপি-বোরকা কেউ পরে ধর্মের কারণে। ফ্যাশন করার জন্যও পরে অনেকে। তালেবানের প্রেতাত্মা, পৃষ্টপোষক টুপি-বোরকার ভেতরে নয়। বাইরেও কম নয়। ক্ষেত্রবিশেষে আরো বেশি। বিশেষ করে রাজনৈতিক সমীকরণ মেলাতে তাদেরকে ব্যবহার-অপব্যবহারে কেউই কম যারনি। ভোট মৌসুমে যে ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা বোরখা-হিজাব-টুপিতে নিজেরাই তালেবান সাজে। এর বিপরীতে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতায় তো আছেই।
Advertisement
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/জেআইএম