বিশেষ প্রতিবেদন

দেশে শান্তি-স্থিতিশীলতা আছে, তবে সতর্কতা জরুরি

১৭ আগস্ট ২০০৫। সিরিজ বোমা হামলার দিন। এ দিনটি এলেই একযোগে দেশের ৬৩ জেলায় বোমা বিস্ফোরণের সেই ভয়াল চিত্র সামনে আসে। এর মধ্যে দিয়েই বাংলাদেশে সন্ত্রাস-উগ্রবাদের উত্থানের বার্তা আসে। এরপর গুলশানের হলি আর্টিসানসহ নানা সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে বাংলাদেশ।

Advertisement

সর্বশেষ এ বছরও নারায়ণগঞ্জের একটি বাড়িতে জঙ্গিরা অবস্থান করছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালানো হয়।

বর্তমানে জঙ্গিবাদের সমস্যা বাংলাদেশে কতটুকু আছে, শান্তি ও স্থিতি রক্ষায় এখন করণীয় কী? এ বিষয়ে রাজনীতিক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্যে ভিন্নতা রয়েছে। জঙ্গিবাদ নির্মূলে রাষ্ট্রীয় সতর্কতার পাশাপাশি পরিবার, সমাজ ও সামাজিক সংগঠনগুলোর সতর্কতার বিষয়ে সবাই একমত।

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে এবং জনগণের মাঝে ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা সম্ভব।

Advertisement

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট একযোগে সারাদেশের ৬৩ জেলায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। এটি ছিল বাংলাদেশে মৌলবাদী-জঙ্গি-উগ্রগোষ্ঠীর উত্থানের একটি বার্তা। বিএনপি-জামায়াত রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর তাদের ছত্রচ্ছায়ায় এই জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে।’

বিবিসির বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের এক খবরে উল্লেখ করা হয়েছিল, বাংলাদেশে ১২৫টি বিভিন্ন ধরনের জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব রয়েছে। এর প্রত্যেকটার পৃষ্ঠপোষক ছিল হাওয়া ভবন এবং তারেক রহমান। বিএনপির সময় আমরা রাজশাহীতে জঙ্গিদের পুলিশ পাহারায় অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিতে দেখেছি। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে বিএনপি-জামায়াত দুর্নীতি করেই শুধু ধ্বংস করেনি, তারা বাংলাদেশের মূল জায়গায় কুঠারাঘাত করেছিল। উগ্রবাদে সমাজটাকে শেষ করে দিয়েছিল। বাংলাদেশকে একটি উগ্র-জঙ্গি দেশ হিসেব গড়ে তুলেছিল।’

হানিফ আরও বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে শেখ হাসিনা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর উন্নয়ন-অগ্রগতির পাশাপাশি জঙ্গিগোষ্ঠীকে কঠোরভাবে দমন করেছেন। গণতন্ত্রের এ ধারাবাহিকতার সঙ্গে সঙ্গে তাদের দমনের বিষয়টিও অব্যাহত থাকবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ বাংলাদেশ বিশ্বে মর্যাদাশীল দেশ। উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি অর্জন করেছে। জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকদের বাংলাদেশের মানুষ আর কখনোই ক্ষমতায় দেখতে চায় না।’

এ নিয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিরিজ বোমা হামলার ১৬ বছর পার হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশের অর্জন ইতিবাচক। সেই সময়ের শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রযন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গিবাদ লালন করেছে। অপশাসনের নাগপাশ থেকে জাতির মুক্তির পর রাষ্ট্র জঙ্গিবাদ দমন করেছে।’

Advertisement

তিনি আরও বলেন, ‘জঙ্গিরা নতুন নতুন প্রযুক্তি ও কৌশল উদ্ভাবন করে তাদের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। কখনো কখনো তাদের পরিচয় পরিবর্তন করে কৌশলে তৎপরতা চালানোর চেষ্টা করছে।’

স্বপন মনে করেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ও শান্তি প্রতিষ্ঠার কৌশল এবং সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জঙ্গিবাদের উত্থান প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এখনো নির্মূল হয়েছে বা আশঙ্কা পরিপূর্ণ দূর হয়েছে এমন দাবি করা সম্ভব নয়। আমার বিশ্বাস, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে এবং জনগণের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে পারলে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা সম্ভব।’

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার মনে করেন, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের সমস্যা আপাতত স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। তবে শঙ্কামুক্ত নয়। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার যথেষ্ট জায়গা আছে। বিশেষ করে আফগানিস্তান পরিস্থিতির কারণে সেটি আরও বেড়েছে।

জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের সমস্যাটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আপাতত স্থিতিশীল অবস্থায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের যে শেকড়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো, তাদের যে নেটওয়ার্ক, তাদের আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতার জায়গাগুলো আগের মতোই অটুট আছে। বর্তমান আফগানিস্তানের পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী ও তাদের সংগঠন আরও উৎফুল্ল হয়ে কার্যক্রম বহুদিকে বৃদ্ধির চেষ্টা করবে।’

মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, ‘আমরা কিন্তু শঙ্কামুক্ত হতে পরিনি। আমাদের উদ্বেগের যথেষ্ট জায়গা রয়েছে। সুতরাং আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রের সব জায়গায় সতর্ক হতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকেও মানুষকে সচেতন করার জন্য কার্যক্রম প্রসারিত করতে হবে। বাংলাদেশের উন্নতি, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি ও স্থিতি ধরে রাখতে হলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্রকে সচেতন হতে হবে।’

আরেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) রেজা উল করিম বলেন, ‘২০০৫ সালের ১৭ আগস্টের হামলা শুধু দেশের কিছু জঙ্গিগোষ্ঠীর হামলা নয়। এখানে বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দাদের সহযোগিতা ছিল। তারা চায়, উত্তেজনা ছড়াতে। এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় উগ্রদের ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছে। এখনও সে সমস্যা আছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানকার সমস্যাটা হলো- ধর্মকে ভুল বোঝা। মনে রাখতে হবে, ধর্মকে পাশ কাটিয়ে গেলে মানুষ ভুলটা শিখবে। প্রকৃত ধর্মটা শেখালে ভুল বোঝানোর সুযোগ কমে আসে।’

মেজর (অব.) রেজা আরও বলেন, ‘যারা ধর্ম চর্চা করে তাদের ভুল বোঝা উচিত নয়। তাদের অবারিত সুযোগ দেয়া এবং সঠিক ধর্ম শিক্ষা ও প্রচারের সুযোগ দেয়া দরকার। এজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নজরদারি প্রয়োজন। ভুল তথ্য ক্রসচেক করা প্রয়োজন। অনেকে বিদ্বেষী হয়ে নিরীহ মানুষকে ফাঁসাতে চায়, সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে।’

অন্যদিকে পুলিশ বলছে, জঙ্গি ও সন্ত্রাসীগোষ্ঠী অস্তিত্ব সংকটে। অনলাইনে তাদের কিছুটা কার্যক্রম থাকলেও শঙ্কা তৈরির মতো সক্ষমতা নেই। শঙ্কামুক্ত পরিবেশ বলা যায়।

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০০১ থেকে ২০০৫ সালের মাধ্যে জেএমবি ২৬ বার এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে। ১৭ আগস্টের ঘটনা মানুষের নজর কেড়েছে বেশি। যারা এ বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল, সেই জেএমবি এখন অস্তিত্ব সংকটে। তাদের শীর্ষ নেতারা গ্রেফতার হয়েছে, তাদের দণ্ডাদেশ কার্যকর হয়েছে। পরবর্তীতে তারা নিজেদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেছিল, পুলিশের অভিযানের ফলে সব প্রচেষ্টা ভণ্ডুল হয়েছে, তারা দাঁড়াতে পারেনি। ওই সময়ে জড়িতদের মধ্যে মাওলানা সাঈদুর রহমানসহ সবাইকেই গ্রেফতার করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘জঙ্গিদের বর্তমান কার্যক্রম একেবারেই দৃশ্যমান নয়। তাদের অনলাইনভিত্তিক কিছু দাওয়াতি কার্যক্রম আছে। সেটাও আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। তাদের সক্ষমতা শঙ্কা সৃষ্টি করতে পারার মতো নয়। আমরা এখন শঙ্কামুক্ত।’

এসইউজে/এমএইচআর/এসএইচএস/এমকেএইচ