২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। নজিরবিহীন বোমা হামলার এমন কাণ্ডে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেছে আদালত। এদের মধ্যে দুই শীর্ষ নেতা বাংলা ভাই ও শায়খ আব্দুর রহমানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
Advertisement
ঘটনার পর দায়ের হওয়া ১৫৯টি মামলার তদন্ত শেষে ১৬ বছরে পুলিশ সবকটি মামলার প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছে। এসব মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি ছিল ১৩০ জন। গ্রেফতার করা হয় ৯৬১ জনকে। এক হাজার ৭২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়।
অভিযোগপত্রে আসামিদের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছিল এক হাজার ২৩ জনকে। আসামিদের মধ্যে ৩২২ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। ১৫ জনের ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়।
এখন পর্যন্ত ১৪৩টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয়া হয়েছে। বাকি ১৬টি মামলায় ঘটনার সত্যতা থাকলেও আসামি শনাক্ত করতে না পারায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) দেয়া হয়।
Advertisement
মামলার বিবরণ ও প্রতিবেদন
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জঙ্গিদের বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল সারাদেশ। ইতিহাসের পাতায় লেখা নজিরবিহীন এমন কাণ্ড আজও আতঙ্কিত করে দেশবাসীকে। মনে করিয়ে দেয়, ভয়ঙ্কর এক দিনের কথা। মুন্সীগঞ্জ জেলা বাদে ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালানো হয়।
সেদিন বেলা সাড়ে ১১টায় ৬৩ জেলার ৪৩৪ স্থানে পরিকল্পিতভাবে একযোগে সিরিজ বোমা হামলা চালিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল জঙ্গি সংগঠন জেএমবি। এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে যায় গোটা দেশের মানুষ। এই হামলায় দু’জন নিহত ও অন্তত ১০৪ জন আহত হন। সিরিজ বোমা হামলার ওই ঘটনার পর সারাদেশে ১৫৯টি মামলা দায়ের করা হয়। তদন্ত শেষে এই ঘটনার ১৬ বছরে পুলিশ সবকটি মামলার প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছে।
মামলাগুলোর মধ্যে ডিএমপিতে করা হয় ১৮টি মামলা, সিএমপিতে আটটি, আরএমপিতে চারটি, কেএমপিতে তিনটি, বিএমপিতে ১২টি, এসএমপিতে ১০টি, ঢাকা রেঞ্জে ২৩টি, চট্টগ্রাম রেঞ্জে ১১টি, রাজশাহী রেঞ্জে সাতটি, খুলনা রেঞ্জে ২৩টি, বরিশাল রেঞ্জে সাতটি মামলা, সিলেট রেঞ্জে ১৬টি, রংপুর রেঞ্জে আটটি, ময়মনসিংহ রেঞ্জে ছয়টি ও রেলওয়ে রেঞ্জে তিনটি মামলা দায়ের করা হয়।
Advertisement
২০০৫ সাল থেকে চলতি বছরের ১৬ আগস্ট পর্যন্ত এসব মামলার মধ্যে ১৪৩টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয়া হয়। বাকি ১৬টি মামলায় ঘটনার সত্যতা থাকলেও আসামি শনাক্ত করতে না পারায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) দেয়া হয়।
পুলিশ জানায়, সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় সারাদেশে ১৫৯টি মামলার মধ্যে ৯৬টি মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। ৯৬টি মামলায় ৩২২ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জনকে দেয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। খালাস দেয়া হয়েছে ৩৫৮ জনকে, জামিনে রয়েছেন ১৩৩ জন আসামি। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া আসামিদের মধ্যে ছিলেন বাংলা ভাই ও শায়খ আব্দুর রহমান।
ইতিহাস বলছে, বিএনপি-জামায়াতের শাসন আমলে (২০০১-২০০৬) সারা বাংলাদেশে শক্ত অবস্থান তৈরি করে জঙ্গিরা। অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম মুছে ফেলতে পরিকল্পনা করতে থাকে তারা। শুরু হয় জেএমবির আত্মঘাতী বোমা হামলা। ২০০৫ সালেই কয়েকটি ধারাবাহিক বোমা হামলায় বিচারক ও আইনজীবীসহ ৩০ জন নিহত হন। আহত হয় চার শতাধিক মানুষ।
৩ অক্টোবর জঙ্গিরা বোমা হামলা চালায় চট্টগ্রাম, চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরের আদালতে। নিহত হন তিনজন। বিচারকসহ আহত হন কমপক্ষে ৫০জন। সিলেটে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক বিপ্লব গোস্বামীর ওপর বোমা হামলায় গাড়িচালকসহ তিনি আহত হন। ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠিতে বিচারক বহনকারী গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা হামলায় নিহত হন ঝালকাঠি জেলা জজ আদালতের বিচারক জগন্নাথ পাড়ে ও সোহেল আহম্মদ। আহত হন অনেকে।
২৯ নভেম্বর গাজীপুর বার সমিতির লাইব্রেরিতে বোমা হামলা চালানো হয়। ১ ডিসেম্বর গাজীপুর ডিসি অফিসের গেটে আবারও বোমা বিস্ফোরণ করে জঙ্গিরা। ঘটনায় নিহত হন গাজীপুরের কৃষি কর্মকর্তা আবুল কাশেম। আহত হন কমপক্ষে ৪০ জন। ৮ ডিসেম্বর নেত্রকোনায় ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় উদীচী শিল্প গোষ্ঠীর দু’নেতাসহ আটজন নিহত হন। আহত হন শতাধিক।
বোমা হামলার ঘটনায় আদালত-মামলার জল গড়িয়েছে বেশ। চাঞ্চল্যকর এসব মামলা চাইলেই শেষ করে দেয়া যায় না। আশা করা যায় শিগগিরই শেষ হবে বিচার কাজ। কলঙ্কমুক্ত হবে দেশ-জাতি।
এফএইচ/এআরএ/জেআইএম