মতামত

মিডিয়া ট্রায়াল!

বাংলাদেশে চার ধরনের বিচার ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। একটি তো প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা। যেখানে আইন আছে, আদালত আছে। যেখানে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলা হয়, তদন্ত হয়, আদালতে বিচার হয়, দুই পক্ষের আইনজীবীর যুক্তিতর্ক, সাক্ষ্যপ্রমাণে বিচার হয়। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা যায়, রিভিউ করা যায়। এমনকি সব বিচার শেষে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করা যায়। রাষ্ট্রপতি চাইলে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিকেও মার্জনা করতে পারেন।

Advertisement

বাংলাদেশের এ বিচার ব্যবস্থা খুবই মানবিক। প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কাউকে অপরাধী বলা যায় না। এ বিচার ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো, এ ব্যবস্থায় দশ জন অপরাধী মুক্তি পেয়ে যাক, কিন্তু কোনো নির্দোষ ব্যক্তি যেন সাজা না পায়। কিন্তু এ চমৎকার বিচার ব্যবস্থাকে আমরা ধ্বংস করে ফেলেছি। দলীয়করণ, দীর্ঘসূত্রতা, অর্থ আর প্রতিপত্তিতে প্রভাবিত করা, মিথ্যা মামলা, মিথ্যা সাক্ষ্য, একজনের সাজা আরেকজনের খাটা- সব মিলিয়ে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। অন্য সব ঠিক হলেও দীর্ঘ মামলাজট কমানো সহজ নয়।

আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে বিচারপ্রার্থীরা ক্লান্ত হয়ে যান, নিঃস্ব হয়ে যান। তাই প্রচলিত এ বিচার ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ক্রমশই কমছে। এ আস্থাহীনতার সুযোগ আরেকটি বিচার ব্যবস্থা প্রচলিত হয়েছে। এটি হলো, বিচারবহির্ভূত ব্যবস্থা। র‌্যাব বা পুলিশ কাউকে ধরে নিয়ে খুন করে ফেলে এবং ক্রসফায়ারের গল্প সাজায়। আর আমরা সুশীল ভাষায় বলি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার সাথে এ বিচারবহির্ভূত বিচার ব্যবস্থার আকাশ পাতাল ফারাক।

প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় যেখানে ‘১০ জন দোষী ব্যক্তি ছাড়া পেলেও কোনো নির্দোষ ব্যক্তি যেন সাজা না পায়’ এ নীতি অনুসরণ করা হয়, বিচারবহির্ভূত বিচার ব্যবস্থায় সেখানে একদম উল্টো। কাউকে সন্দেহ হলেই হলো। বিচার, রায় এবং তা কার্যকর হয় রকেটগতিতে। সকালে আটক, রাতে অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান এবং এক গুলিতেই বিচার শেষ। নিজের ওপর এলে কেউ কেউ প্রতিবাদ করেন বটে, তবে সাধারণ ভাবে এই রকেটগতির বিচারবহির্ভূত বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের প্রবল আস্থা। ক্রসফায়ারের পর কোনো কোনো এলাকায় মিষ্টি বিতরণের খবরও ছাপা হয় পত্রিকায়।

Advertisement

গত বছর কক্সবাজারে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহার ক্রসফায়ারের পর থেকে আপাতত এ বিচার ব্যবস্থা স্থগিত আছে। ক্রসফায়ার বন্ধ থাকলেও গুমের খবর আসে মাঝে মধ্যে। গুমও এ বিচারবহির্ভূত বিচার ব্যবস্থার অন্যতম অনুষঙ্গ। আরেকটি বিচার হলো প্রকৃতির বিচার হলো প্রকৃতির বিচার বা আল্লার মাইর। অসহায় মানুষ অপেক্ষায় থাকে এ বিচারের। কারও পাপের পেয়ালা পূর্ণ হলে কোনো না কোনোভাবে তিনি ধরা পড়েন। নইলে বাংলাদেশে এমপি পাপুল কেন কুয়েতে ধরা খাবেন। আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাটও এই প্রকৃতির বিচারের মুখোমুখি।

তবে সব বিচার ব্যবস্থাকে ছাপিয়ে ইদানীং আলোচনায় গণমাধ্যমের বিচার বা মিডিয়া ট্রায়াল। ক্রসফায়ার বন্ধের পর এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় এই মিডিয়া ট্রায়াল। প্রমাণিত হোক আর না হোক, সত্য হোক আর মিথ্যা; বিচারের আগেই কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে তাকে সামাজিকভাবে ধসিয়ে দেয়ার নামই মিডিয়া ট্রায়াল। মূলধারার গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মিলে এই মিডিয়া ট্রায়াল এখন অন্য যে কোনো ট্রায়ালের চেয়ে ভয়ঙ্কর।

প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় আইনি লড়াই শেষে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু মিডিয়া ট্রায়ালে দোষী বা নির্দোষ প্রমাণের বালাই নেই, আপিলের সুযোগ নেই, যা হয়, একবারেই। এই ক্ষতির কোনো পূরণ নেই। ক্রসফায়ারে তো সন্দেহভাজনকে একেবারে মেরে ফেলা হয়। মিডিয়া ট্রায়ালে মারা হয় তিলে তিলে। মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার একজন নির্দোষ মানুষকেও আজীবন দোষের গ্লানি বয়ে বেরাতে হয়। মিডিয়া ট্রায়ালের আওয়াজ যত জনের কানে যায়, পরে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও তা ততজনের কাছে পৌঁছায় না। তারচেয়ে বড় কথা হলো, কিছু মানুষ সবসময়ই বিশ্বাস করে, যা রটে তার কিছু না কিছু বটে।

মিডিয়া ট্রায়ালের অবশ্য অনেক ধরন আছে। কিছু কিছু মিডিয়া নিজেদের ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত স্বার্থে কাউকে লক্ষ্য বানিয়ে দিনের পর দিন তার বিরুদ্ধে সত্য-মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করে। কোনো কোনো মিডিয়ার লক্ষ্যই থাকে, অমুককে সাইজ করো, শুইয়ে দাও। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিডিয়া পরিণত হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাইক বা হাতিয়ারে। পুলিশ বা র‌্যাব যাই বলে, যাচাই বাছাই ছাড়াই মিডিয়া তা বাজাতে থাকে। কদিন আগে ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদ ছিলেন ভিলেন।

Advertisement

চিত্রনায়িকা পরীমনি তার বিরুদ্ধে ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যা চেষ্টার অভিযোগে মামলা করেছিলেন। মিডিয়া তাকে প্রায় ধর্ষক এবং খুনি বানিয়ে ছেড়েছে। নাসির ইউ মাহমুদ দোষী না নির্দোষ সেটা আদালতে প্রমাণিত হবে। কিন্তু তার আগেই মিডিয়া ট্রায়ালে সামাজিকভাবে তার শাস্তি পাওয়া শেষ। মাস ঘুরতে না ঘুরতেই এখন সেই পরীমনি ভিলেন। কোনো মামলা ছাড়াই র‌্যাব মাফিয়া ডনের কায়দায় তার বাসায় অভিযান চালায়। চার ঘণ্টার অভিযানে মাদকসহ তাকে নিয়ে যায় র‌্যাব। তারপর থেকে চলছে নির্মম মিডিয়া ট্রায়াল। পরীমনির চৌদ্দগোষ্ঠীর ইতিহাস এখন সবার জানা। একজন চিত্রনায়িকার ব্যক্তিগত জীবন এখন সবার খোলা খাতা। চলছে তার চরিত্র হননের প্রতিযোগিতা। সাথে পরীমনির সাথে সম্পর্ক আছে, যেটা থাকা দোষের কিছু নয়, এই অজুহাতে আরও অনেকের মিডিয়া ট্রায়াল। মিডিয়া নিজেদের সুবিধা মতো কাউকে ভাসায়, কাউকে ডোবায়। অনেক ক্ষেত্রে মামলার আসামির নামও আড়াল করে।

আবার অনেক ক্ষেত্রে সন্দেহভাজনদেরও সামাজিকভাবে হেনস্তা করা হয়। এসব ক্ষেত্রে পুলিশও জানে, প্রচলিত আইনে এদের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো অভিযোগ নেই, আদালতে তেমন কিছু প্রমাণও করা যাবে না। তাই মিডিয়া ট্রায়ালই আসলে এদের শেষ বিচার। গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মিলে এমন মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার মানুষের সংখ্যা কম নয়। প্রচলিত আদালতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা যায়। কিন্তু মিডিয়া ট্রায়ালে কোনো যুক্তিতর্ক নেই, সাক্ষ্যপ্রমাণ লাগে না, আপিলের সুযোগ নেই।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের না হয় কোনো বাপ-মা নেই। কিন্তু গণমাধ্যমের তো কিছু এথিক্স আছে, জবাবদিহিতা আছে, সম্পাদকীয় বিবেচনা আছে। কিন্তু মাঝে মাঝে আমরা যেন সব ভুলে যাই, মেতে উঠি প্রতিহিংসাপরায়ণতায়। এভাবে চলতে থাকলে বিচারিক আদালতের মতো গণমাধ্যমের ওপর থেকেও মানুষের আস্থা ওঠে যাবে।১৫ আগস্ট, ২০২১

এইচআর/এমকেএইচ