আন্তর্জাতিক

বিরোধীদের সুবিধা দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী

মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে ফের উত্তাপ, বিরোধীদের সুবিধা দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন হারাতে পারেন বুঝতে পেরে কোনোরকমে তার গদি টিকিয়ে রাখতে বিরোধী দলগুলোর সমর্থন চাইলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী মুহিদ্দিন ইয়াসিন। বললেন, বিরোধী দলীয় নেতাকে একজন সিনিয়র মন্ত্রীর মর্যাদা দেয়া হবে।

Advertisement

তাছাড়া তিনি আগামী বছর নির্বাচন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ১৩ আগস্ট এনএসটি অনলাইনের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী মাসে পার্লামেন্ট অধিবেশন শুরু হচ্ছে। সেখানে কঠিন এক পরীক্ষার মুখে পড়তে হবে তাকে। দীর্ঘদিন ধরে বিরোধী দলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম দাবি করে আসছেন- সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছেন মুহিদ্দিন।

পক্ষান্তরে আনোয়ারের নিজের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। তিনিই সরকার গঠন করতে পারেন। এছাড়া সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ও আনোয় ইব্রাহিম রাজপথে সভাও করেছেন। এমন হুমকির মুখে করোনা মহামারি যেন আশীর্বাদ হয়ে আসে মুহিদ্দিনের বেলায়। বিধিনিষেধ জারি করায় স্থগিত হয় পার্লামেন্ট অধিবেশন।

ফলে তিনি এমপি বা বিরোধীদের চাপকে কাটিয়ে উঠার একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেন। কিন্তু সম্প্রতি তার সরকারের জোটের বেশ কিছু এমপি সমর্থন প্রত্যাহার করেছেন। এমনিতেই মুহিদ্দিন ইয়াসিন সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী। তার ওপর এমপিদের সমর্থন প্রত্যাহার তাকে নতুন এক বিপদে ফেলে দিয়েছে।

Advertisement

তিনি তা ঠিক বুঝতে পারছেন। তাই কোনো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন না করেই স্বীকার করেছেন, পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাতে পারেন। এ অবস্থায় বিরোধী দলীয় এমপিদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন মুহিদ্দিন ইয়াসিন।

গত শুক্রবার তিনি বলেছেন, সহজ পথ বেছে নিতে পারেন এবং পদত্যাগও করতে পারেন। কিন্তু বর্তমানে এমন কোনো এমপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের মতো সমর্থন নেই, যার ওপর ভিত্তি করে রাজা ওই নতুন নেতাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন।

তিনি আরও বলেন, এমন অবস্থায় দেশে কোনো সরকার থাকবে না। তা হলে এই অবনতিশীল করোনা পরিস্থিতিতে দেশ বিকলাঙ্গ হয়ে পড়বে। এজন্য তিনিই ক্ষমতায় থাকতে চান। তাই তিনি বেশ কিছু প্রস্তাব বা সুবিধা দেয়ার বিনিময়ে বিরোধী দলীয় এমপিদের সমর্থন চাইছেন। এজন্য তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন তিনি।

যেসব প্রস্তাব তিনি দেবেন, তার মধ্যে রয়েছে- প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মেয়াদ সীমিত করা, ভোটার হওয়ার বয়স ২১ বছর থেকে কমিয়ে ১৮ করা হবে, চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স প্রতিষ্ঠা করা হবে, বিরোধী দলীয় নেতাকে একজন সিনিয়র মন্ত্রীর মর্যাদা দেয়া হবে। এছাড়া করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাজেট বৃদ্ধি করবেন তিনি। গরিবদের আরও অর্থ সহায়তা দেবেন।

Advertisement

টেলিভিশনে দেয়া এক ভাষণে তিনি বলেন, আমার এসব প্রস্তাবের উদ্দেশ্য হলো এই করোনা মহামারির মধ্যে সরকারকে অব্যাহতভাবে সচল রাখা। এক্ষেত্রে পার্লামেন্টে উভয় পক্ষের সমর্থন থাকতে হবে। আমি আর ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকতে চাই না। এটা ঠিক যে, এই ম্যান্ডেট একটি নতুন নির্বাচিত সরকারের হাতে তুলে দেয়া উচিত, অবশ্য যখন সময় আসবে। করোনা মহামারির ওপর নির্ভর করে, প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, দেশের ১৫তম জাতীয় নির্বাচন আগামী বছর জুলাই মাস শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই হবে।

মাত্র এক সপ্তাহ আগে তিনি দেশবাসীকে বলেছিলেন, এখনও তার সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন আছে। তিনি সেপ্টেম্বরে পার্লামেন্টে আস্থা ভোট দেবেন। কিন্তু তার এক সপ্তাহ পরেই তিনি ইউ-টার্ন নিয়েছেন। কারণ, এরই মধ্যে ক্ষমতাসীন জোটের সবচেয়ে বড় দল ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের কমপক্ষে ৮ জন এমপি সরকারের ওপর থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহারের ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছেন।

সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা মুহিদ্দিন সরকারের পতনের জন্য এটাই যথেষ্ট। তার ওপর ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের দু’জনও মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।

এদিকে আগামী মাসে পার্লামেন্টে আস্থা ভোটের আগে কোনো সংসদ সদস্য (এমপি) প্রমাণ করতে পারবে না যে তার বা তার সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন আছে তা প্রমাণ করতে না পারলে দেশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব অচলাবস্থায় থাকবে।

দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার জন্য প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের আহ্বানের পরে দুইজন বিশেষজ্ঞের মধ্যে এই মতো ছিল, যা বিরোধীদের আপত্তির সম্মুখীন হয়েছিল।

আইনজীবী এডমন্ড বন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করার কোনো প্রয়োজন নেই ‘যদিও তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর কথা স্বীকার করেছেন’।

তিনি বলেন, এই স্থিতাবস্থা রয়ে গেছে যতক্ষণ না এই ঘটনার পর দুটি দৃশ্যকল্প ঘটে যে, মুহিউদ্দিন হয় একটি সাধারণ নির্বাচনের ডাক দেন। কিন্তু ইয়াং দি-পার্টুয়ান আগং আল-সুলতান আবদুল্লাহ রিয়াতুদ্দিন আল-মুস্তফা বিল্লাহ শাহকে প্রত্যাখ্যান করা হয়; অথবা যদি কোনো সংসদ সদস্য (এমপি) সংখ্যাগরিষ্ঠতা দাবি করতে এগিয়ে যান এবং রাজা তা গ্রহণ করেন।

আসিয়ানের আন্ত:সরকার কমিশন মালয়েশিয়ার সাবেক প্রতিনিধি বলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে পারেন বা পদত্যাগ চাইতে পারেন। এমপিদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আরও সংস্কার দাবি করা উচিত।

তিনি ২০০৯ সালে পেরাক সাংবিধানিক সংকটের কথা উল্লেখ করেছিলেন, যেখানে বিচলিত মেন্টেরি বেসার মোহাম্মদ নিজার জামালউদ্দিন পেরাকের সুলতানের রাজ্য বিধানসভা ভেঙে দিতে এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থার সমাধানের জন্য নতুন নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছিলেন।

তৎকালীন বারিসান ন্যাশনাল (বিএন) চেয়ারম্যান এবং প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক বিএন’র সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের জন্য পেরাক শাসকের কাছে সমর্থন চেয়েছিলেন এবং ঘটনাগুলো শেষ পর্যন্ত ড. জাম্বরি আবদুল কাদিরকে নতুন এমপি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

সংকটের সূত্রপাত হয়েছিল যখন তিনজন পেরাক বিধানসভা, যারা পূর্বে নিজারের প্রশাসনকে সমর্থন করেছিলেন, ঘোষণা করেছিলেন যে তারা স্বাধীন হচ্ছেন এবং তারা বিএনকে সমর্থন করবেন, যার ফলে পাকাতান রাকিয়াত নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন হারায়।

এদিকে, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আইনুল আদজেলি হাসনুল বলেছেন, বিরোধীদের উচিত মুহিউদ্দিনের পরামর্শগুলোকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করার পরিবর্তে বিবেচনা করা। মুহিউদ্দিন একভাবে সব দলের সঙ্গে দ্বি-পক্ষীয় সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছেন।

ড. আইনুল আগামী মাসে আস্থা ভোটের সময় সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে ঝুলন্ত সংসদের সম্ভাবনা উত্থাপন করেন, যেমন যুক্তরাজ্য ২০১৭ সালে অনুভব করেছিল।

উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টির সঙ্গে আস্থা ও সরবরাহ চুক্তি দ্বারা সমর্থিত থেরেসা মে নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভদের সঙ্গে সাত বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো একটি ঝুলন্ত যুক্তরাজ্যের সংসদ সংঘটিত হয়েছিল।

যদি এটি ঘটে থাকে, এটি সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার জন্য বিশেষ করে কোভিড-১৯ পরিচালনার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করবে এবং পরবর্তী বছরের বাজেটের তালিকাভুক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে। মহামারি পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে, বিরোধীদের উচিত জনগণের চাহিদা প্রথমে রাখা এবং কমপক্ষে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রস্তাবটি বিবেচনা করা উচিত।

আইনুল বলেন, ফলাফল যাই হোক না কেন, সব রাজনৈতিক দলই সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে জনগণের সমর্থন নির্ধারণে, যা আগামী বছর অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এরই মধ্যে বিরোধী দলগুলোর উচিত মুহিউদ্দিনের প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করা যেমন হপিং-বিরোধী আইন এবং প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দুই মেয়াদে সীমিত করা যা তাদের জন্যও উপকারী হবে।

এমআরএম/এমকেএইচ