যেকোনো সময় আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে তালেবান। ফলে আবারও হয়তো আফগানিস্তানের মসনদে বসতে যাচ্ছে কঠোর শরিয়া আইনে পরিচালিত এই সশস্ত্র গোষ্ঠী। ২০০১ সালে পতনের আগে তালেবান দীর্ঘ ছয় বছর দেশটির সাধারণ মানুষকে কঠোর শাসনে রেখেছে। কিন্তু প্রায় ২০ বছর পর আবারও আগ্রাসী হয়ে আফগানিস্তান দখলে তীব্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তালেবান যোদ্ধারা।
Advertisement
দীর্ঘ লড়াই শেষে তালেবানের জয়ী হওয়ার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা কি করে সম্ভব হলো? এতো অল্প সময়ের ব্যবধানেই বা কী করে তারা একের পর এক আফগান শহর দখল করে নিচ্ছে? যুক্তরাষ্ট্র কী আগে থেকেই আভাস পেয়েছিল যে, এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে? এসব নিয়েই এখন চলছে জোর আলোচনা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তালেবানের ক্ষমতা দখলের পূর্বের ঘটনা পরম্পরা বলে দেয় কি হতে যাচ্ছে। সবশেষ বড় যে বিষয়টি আলোচনায় আসছে তা হলো কী ছিল তালেবান-যুক্তরাষ্ট্রের দোহা শান্তি চুক্তিতে?
কাতারের রাজধানী দোহায় ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি হয়। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং তালেবানের দোহা মুখপাত্র সোহাইল শাহীন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সেই শান্তির চুক্তির দেড় বছরের মাথায় আবারও যুদ্ধ-বিধ্বস্ত আফগানিস্তান। দেশটির সরকারি বাহিনী ও তালেবানদের সংঘর্ষে বহু বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে, বাস্তুহারা হয়েছে আরও কয়েক লাখ মানুষ। তালেবানের ভয়ে সন্ত্রস্ত গোটা দেশ।
Advertisement
‘আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য চুক্তি’ এই শিরোনামে দোহায় তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটি চুক্তি হয়। ৪টি মূল ধারা সম্বলিত চুক্তির শুরুতেই বলা হয় ‘ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান’ নামটিকে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয় না, একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তারা তালেবান নামেই পরিচিত। যদিও তালেবান নিজেদেরকে চুক্তির কাগজে ‘ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান’ হিসেবে উল্লেখ করে।
চুক্তির প্রথম ধারায় বলা হয়, আল-কায়েদাসহ এমন কোন গোষ্ঠী বা ব্যক্তিকে আফগানিস্তানের মাটি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দিবে না বলে তালেবান নিশ্চয়তা দিচ্ছে এবং এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নেরও ব্যবস্থাপনা করবে তারা। অপরদিকে, আফগানিস্তান থেকে সব বিদেশি সেনা প্রত্যাহার করা হবে, এটা বাস্তবায়নের ব্যবস্থাপনা তারা করবে এবং সেনা প্রত্যাহারের একটি সময়সূচিও ঘোষণা করা হবে, দ্বিতীয় ধারায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।
তৃতীয় ধারায় বলা হয়, প্রথম ও দ্বিতীয় ধারা নিশ্চিতে ২০২০ সালের ১০ মার্চ আফগান সরকারের সঙ্গে আন্তঃআফগান আলোচনা ও সমঝোতার প্রক্রিয়া শুরু করবে তারা। চতুর্থ ধারায় বলা হয়, আলোচ্যসূচির একটি অংশে অস্ত্রবিরতির বিষয়টিও থাকবে।
চুক্তির পরের তিনটি অংশের প্রথম অংশে যুক্তরাষ্ট্রের কী কী করণীয় তার বর্ণনা রয়েছে। বলা হয়েছে, চুক্তি স্বাক্ষরের ঘোষণার দিন থেকে পরের ১৪ মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। প্রথম অংশে সেখানে ছয়টি বিষয়ের উল্লেখ আছে। প্রথমটিই সেনা প্রত্যাহার নিয়ে। যেখানে বলা হয়, আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এই চুক্তি ঘোষণার প্রথম ১৩৫ দিনের মধ্যে আট হাজার ৬শ সেনা প্রত্যাহার করে নেবে। একই সময়ের মধ্যে তারা সেদেশের পাঁচটি সেনাঘাঁটি থেকেও সেনা প্রত্যাহার করবে।
Advertisement
দ্বিতীয়টিতে বলা হয়, পরের সাড়ে নয় মাসের মধ্যে বাকি সেনা প্রত্যাহার করতে হবে এবং বাকি সেনাঘাঁটিগুলো থেকেও সৈন্য সরিয়ে নিতে হবে।
তৃতীয়টি মূলত বন্দি বিনিময় সংক্রান্ত ছিল। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের সময় বন্দি ৫ হাজার তালেবানকে মুক্তি দেবে। এর বিনিময়ে তালেবান তাদের হাতে বন্দি ১ হাজার জনকে মুক্তি দেবে।
চতুর্থ বিষয়টি হলো, আন্তঃআফগান আলোচনা শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো পুনর্বিবেচনার প্রক্রিয়া শুরু করবে এবং যাদের বিরুদ্ধে ধরিয়ে দেওয়ার পুরস্কার ঘোষণা করা হয় সেই তালিকা পুনর্বিবেচনার প্রক্রিয়া শুরু করবে। ২০২০ সালের ২৭ আগস্টের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ারও উদ্যোগ নেবে।
পঞ্চমটি হলো, আন্তঃআফগান আলোচনা শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে তালেবানের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়া চালুর জন্য সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করবে এবং ২০২০ সালের ২৯ মের মধ্যে তারা এ কাজটি করবে।
ষষ্ঠ বিষয়টি হলো, যুক্তরাষ্ট্র এবং মিত্ররা আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না এবং আফগানিস্তানকে বিভক্ত করতে হুমকি দেয়া বা বল প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকবে।
চুক্তির দ্বিতীয় অংশে তালেবানের করণীয়গুলো উল্লেখ করা হয়। সেখানে বলা হয়, পাঁচটি দফায় চুক্তি বাস্তবায়ন করবে তালেবান।
প্রথমটি হলো, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে নিজেদের কোনো সদস্য বা আল-কায়েদাসহ অন্য কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তি যাতে আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে না পারে তা নিশ্চিত করবে তালেবান।
দ্বিতীয় দফায় বলা হয়, তালেবান পক্ষ যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্রদের বিরুদ্ধে সক্রিয় কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তিকে সহযোগিতা করতে পারবে না, যারা যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্রদের জন্য হুমকি স্বরূপ।
তৃতীয় দফাটি হল, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টিকারী কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তি যাতে সদস্য ও তহবিল সংগ্রহ এবং তাদের প্রশিক্ষণের জন্য আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে না পারে তা নিশ্চিত করবে তালেবান।
চতুর্থ ও পঞ্চম দফায় শরণার্থীসহ আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিধি মেনে চলার অঙ্গীকার করে তালেবান এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ও ব্যক্তিকে ভিসা না দেওয়া, অন্য কোনো ভ্রমণ অনুমতি না দেওয়া বা অন্য কোনো আইনি নথি না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় তারা।
এছাড়া তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরি কথাও বলা হয় চুক্তিতে। তবে দেড় বছরের মাথায় সেই শান্তি চুক্তির মধ্যে আর সীমাবদ্ধতা রইল না। আফগান সরকার আর তালেবানের কঠিন লড়াইয়ে মারা পড়ছে সাধারণ মানুষ। তালেবান এখন ক্ষমতা ভাগাভাগির আলোচনায় উঠে এসেছে।
ইউএস ইন্সিটিটিউট ফর পিস এর এশিয়াবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু উইলডার বলেন, তালেবান কমান্ডাররা ভাবছে তারা বিজয়ের আচঁ পাচ্ছে এবং তারা সেভাবেই এগোচ্ছে।
তালেবানরা দেখতে পাচ্ছে তাদের আর সমঝোতা করার প্রয়োজন নেই। লওরেল মিলার নামে সাবেক এক কূটনীতিক বলেন, তারা যেভাবে ক্ষমতার কাছাকাছি চলে এসেছে এখন সেভাবে এগোলেই বিজয় নিশ্চিত।
২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলা পুরো বৈশ্বিক রাজনীতির পট পরিবর্তন করে দেয়। ক্ষোভে পুড়তে থাকা যুক্তরাষ্ট্র আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে ফেরত চাওয়ার শর্ত দেয় আফগান তালেবানকে। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করলে আফগানিস্তানে হামলা চালানো শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। উৎখাত করে তালেবান সরকারকে।
দুই দশক ধরে চলা যুদ্ধে কত আফগান বেসামরিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও তালেবান সদস্যের প্রাণ গেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান অজানা। তবে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই যুদ্ধে ৩২ হাজারের বেশি বেসামরিক লোক নিহত হয়েছেন।
শান্তি চুক্তির সূত্র ধরে গতবছর সেপ্টেম্বরে আফগানিস্তান সরকার ও তালেবানের মধ্যে শান্তি আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু তারপর দুই পক্ষের আলোচনায় তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। আফগান সরকারি বাহিনী ও তালেবানের তীব্র লড়াইয়ের মাঝে সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারে তার অনুতাপ নেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর বৈশ্বিক রাজনীতিতে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র বদলে ফেলছে পররাষ্ট্রনীতি। সেনা প্রত্যাহার তাদের সেই রকমের একটি কৌশলও হতে পারে। তবে আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় এলে কতটা শান্তি প্রতিষ্ঠা পাবে? সেটাই এখন দেখার বিষয়।
সূত্র: এনবিসি, বিবিসি
এসএনআর/টিটিএন/এমকেএইচ