করোনাভাইরাস (কোভিড ১৯) উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধ শেষে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টও খুলেছে। বুধবার (১১ আগস্ট) থেকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের কার্যক্রমও শুরু হয়েছে পুরোদমে। এজন্য বিচারিক এখতিয়ার দিয়ে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন হাইকোর্ট বিভাগের দ্বৈত ও একক মিলে ৫৩টি বেঞ্চ গঠন করে দিয়েছেন। পাশাপাশি দেশের সব নিম্ন (বিচারিক) আদালতও খুলে দেওয়া হয়েছে।
Advertisement
আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে আটকে আছে অনেক আলোচিত চাঞ্চল্যকর মামলার চূড়ান্ত বিচার কার্যক্রম। যেহেতু বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছে, তাই কোর্টও ভার্চুয়ালি চালু করা হয়েছে। এখন গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর সব মামলার শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বৈশ্বিক মহামারি করোনার বিধিনিষেধের কারণে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারিক কার্যক্রমও নিয়মিত চলেনি। বন্ধ ছিল গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত মামলার শুনানি। নিয়মিত আদালত না খুললেও হাইকোর্ট বিভাগের ৫৩টি বেঞ্চে বিচার কাজ চলবে। তাই এখন থেকে এসব মামলার শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বিধিনিষেধের পর দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট খুলে দেওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন আইনজীবীরা।
Advertisement
এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, কোর্ট খোলা হয়েছে, লকডাউনের কারণে এতদিন আদালত সীমিত আকারে চলছিল। কিন্তু ওই সময় অনেক চাঞ্চল্যকর গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি করা যায়নি। এখন যেহেতু আদালত খুলছে আমরা পর্যায়ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত মামলা শুনানির উদ্যোগ নেবো।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান জাগো নিউজকে বলেন, দেশে যেহেতু করোনায় সরকারঘোষিত লকডাউন তুলে দেওয়া হয়েছে, এখন আমরা দুদকের যেসব গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর মামলা রয়েছে সেগুলো শুনানির উদ্যোগ নেবো। দেশের সর্বোচ্চ আদালত খোলায় আমরা খুশি। আশা করি আগের মতো আদালত চলবে। ক্লায়েন্টদের দুর্ভোগ লাঘব হবে।
তিনি আরও বলেন, গুরুত্বপূর্ণ মামলার অংশ হিসেবে রোববার (৮ আগস্ট) পার্থ গোপাল বণিকের মামলা আদালতে উপস্থাপন করেছিলাম ম্যানশন করার জন্য। এভাবে যেসব মামলার শুনানি প্রয়োজন সব মামলাই উপস্থাপন করা হবে বলে।
আপিল বিভাগে যেসব আলোচিত মামলার শুনানি হতে পারেপিলখানার বিদ্রোহে সেনা কর্মকর্তা হত্যা মামলায় আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম ও জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ কায়সারের রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন।
Advertisement
এছাড়াও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় আসামিপক্ষের আপিল আবেদন, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের মামলায় দলটির পক্ষ থেকে করা আপিল আবেদন, পুলিশ দম্পতি মাহফুজুর রহমান ও স্বপ্না রহমান হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত তাদের কন্যা ঐশী রহমানের পক্ষে আবেদন, আওয়ামী লীগ নেতা আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আবেদন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে শুনানির জন্য রয়েছে।
হাইকোর্ট বিভাগে শুনানি হতে পারে যেসব আলোচিত মামলারএদিকে হাইকোর্ট বিভাগে গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় হামলা মামলায় আসামিপক্ষের জেল আপিল, ফেনীর সোনাগাজী ফাজিল মাদরাসার শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন), ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, রমনার বটমূলে বোমা হামলাসহ বেশকিছু মামলা হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। পেপারবুক প্রস্তুতির পর্যায়ে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলা।
এছাড়াও নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলা, পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ হত্যা, সিলেটের শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যা মামলা, খুলনায় শিশু রাকিব হত্যা মামলার চূড়ান্ত বিচার প্রক্রিয়াও আটকে আছে।
উচ্চ আদালত খোলার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল জাগো নিউজকে বলেন, আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্ট খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এখন যেহেতু প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টের সবক’টি বেঞ্চ ভার্চুয়ালি চালু করেছেন এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। আইনজীবীদের পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের কাছে দাবি- যাতে আগাম জামিন শুনানি করা যায় সেই ব্যবস্থা করা।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, দেশে করোনার কারণে সরকারঘোষিত লকডাউনে সর্বোচ্চ আদালত বন্ধ ছিল। এখন কোর্ট খুলে দেওয়ায় আইনজীবীরা এটা ইতিবাচকভাবে দেখবেন বলে মনে করি।
করোনার কারণে ২০২০ সালের ৩০ মার্চ থেকেই বন্ধ ঘোষণা করা হয় দেশের সব আদালত। এরপর মে মাস থেকে সীমিত পরিসরে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভার্চুয়াল আদালত চালু করা হয়। করোনা সংক্রমণের হার কমে এলে জুলাই মাসে থেকে আবার আদালত পর্যায়ক্রমে খুলতে থাকে। ওই সময় ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি শেষে ধীরে ধীরে কড়াকড়ি শিথিল হতে থাকলে সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে থাকা চাঞ্চল্যকর ও আলোচিত মামলাগুলোও সচলের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
কিন্তু চলতি বছরের মার্চের শেষ দিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ প্রকট আকার ধারণ করলে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়। ফলে এসব মামলার বিচার কার্যক্রম আটকে যায়। শেষ পর্যন্ত সংক্রমণ বাড়তে থাকায় ১ জুলাই থেকে কঠোর বিধিনিষেধ জারি করে সরকার। এ অবস্থায় বিলম্বিত হচ্ছিল ওইসব মামলার শুনানি ও নিষ্পত্তির কার্যক্রম।
বিধিনিষেধের কারণে সুপ্রিম কোর্টে আটকে আছে আলোচিত বহু মামলা, যেগুলোর শুনানি বা নিষ্পত্তি হয়নি। আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে ভার্চুয়ালি বিভিন্ন মামলার শুনানি হলেও চাঞ্চল্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি হচ্ছিল না। এ কারণে মামলার বাদী, বিবাদী, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রশ্ন- বিধিনিষেধ এভাবে দীর্ঘায়িত হতে থাকলে আলোচিত মামলাগুলোর কী হবে। সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট ভার্চুয়ালি চালু করাই একটু হলেও সেই প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন বিচারপ্রার্থীরা।
এফএইচ/এআরএ/এএ/এমএস