ক্ষুধা কী মহামারি? এ-আমি জানি না। আমরা কি জানি পৃথিবীর কত শতাংশ মানুষ না-খেয়ে থাকে প্রতিদিন? না, আমরা জানি না। আমরা কী জানি পৃথিবীর কত শতাংশ মানুষ আধ-পেটা হয়ে রাতে ঘুমাতে যায়? না, আমরা জানি না। পৃথিবীর কত শতাংশ মানুষের খাবারের মান অত্যন্ত নিচু? প্রায় অখাদ্য-কুখাদ্য। খাবারের পুষ্টিমাণ বিবেচনায় তাকে ঠিক খাদ্যের মান-তালিকায় রাখা যায় না। কতো শতাংশ মানুষ অপুষ্টিজনিত কারণে খর্বাকৃতি হচ্ছে?
Advertisement
শুধু পুষ্টির হেরফেরের কারণে তারা কেবল শারীরিকভাবেই বামনাকৃতি হয় না, তাদের মেধামগজও বিকাশ লাভ করে না। অর্থাৎ গরিব-গোবরোদের শিশুরা যে পরিমাণ পুষ্টিকর খাবার পায়, তা দিয়ে তাদের মগজ পুষ্টি লাভ করে না। ফলে তারা মানসিকভাবেও তারা শারীরিক খর্বাকৃতির মতোই ব্রেনও তাদের বামনাকৃতির হয়ে থাকে। আর ওই অবিকশিত মগজ দিয়ে সে নিজেকে রাজনৈতিক-সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রামে অন্যদের সাথে জ্ঞান-গরিমায় সংগ্রাম করে জয়ী হতে পারে না। ফলে সে বা তারা পিছিয়ে পড়ে সব দিক থেকেই। শারীরিক ও মানসিক দিক থেকেই কেবল নয়, বেঁচে থাকার জন্য যে কৃতবিদ্য হয়ে তার দুঃখ-দুর্দশা ঘুচাবে, তাও সম্ভব হবে না। কারণ শিশুদের ব্রেনের পরিপুষ্টি সাধিত হয় জন্মের পর ৪/৫ বছরের মধ্যে। ওই সময়ের মধ্যে যতটা বিকাশ হয়, তাই দিয়েই তার মস্তিষ্ক সারাজীবন চলে। বড় হওয়ার পর যতই পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করুক না কেন, তাতে কোনো লাভ হয় না। পুষ্টিকর খাবার শিশুর জন্মের ৪/৫ বছরের মধ্যেই দরকার, যা পৃথিবীর অনেক দেশের শিশুরা পায় না। কেন পায় না, তা নিয়েই আমাদের ভাবতে হবে।
পৃথিবীর ৩শ’ কোটি মানুষ ঠিক মতো খাবার পায় না। এটা বিশ্ব খাদ্য সংস্থার তথ্য। এই তিনশ কোটির মধ্যে শিশু-কিশোর-যুবক-পৌঢ় এবং বৃদ্ধরাও রয়েছে। এই মানুষ পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক। এটা তো ভয়াবহ তথ্য, যদি সত্যই এই পরিসংখ্যান সত্য হয়, তাহলে বুঝতে হবে আমরা কতোটা সভ্য হয়েছি, কতোটা মানবিক ‘মানুষ’ হয়েছি, আর কতোটা সেই মানুষের মতো ‘মান’-এ উত্তীর্ণ হয়েছি। কারণ, আমাদের মনে রাখতে হবে যে আমরাও প্রাণি জগতেরই অংশ, প্রাণি সমাজেরই সদস্যমাত্র। কেবল মগজ থাকায় এবং তাকে কাজে লাগিয়ে, তার সাহায্যে নিজেদের প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করে আজতক পর্য়ন্ত আসতে পেরেছি বুদ্ধির জোরে। মানুষ এই অভিধায় সিক্ত করতে পেরেছি নিজেদের। নিজেদের মধ্যে মানবিক গুণাবলীর উদ্বোধন করে নিজেদের ‘মানব’ বলে চিহ্নিত করতে পেরেছি। আবার সেই মগজপ্রধান প্রাণি যখন মানুষের মানকে চরমভাবে অবহেলা/অবমাননা করে ধরার ধুলায় ফেলে দিয়ে ব্যক্তি ,গোষ্ঠী, বা রাষ্ট্রের জন্য ব্যয় করে অন্য মানুষের জীবনের জন্য নরক তৈষ্টি করে, তখন ধরে নিতে হবে যে, তারা ‘ইতর’ স্তর থেকে আজো নিজেদের মানুষ স্তরে উন্নীত করতে পারেনি। আমরা কি সবিস্ময়ে এটাই লক্ষ্য করছি না আমাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায়? বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, নগর-মহানগরের নিম্ন আয়ের জনজীবনে, বস্তিবাসীদের শিশুরা যেমন অপুষ্টি আর অর্ধাহারে রাত যাপন করছে, তেমনি পৃথিবীর বহুদেশেও রয়েছে একই রকম সামাজিক পরিবেশ-পরিস্থিতি।
পৃথিবীর বহুদেশের শিশুরা দুইবেলা খেতে পায় না। চিকিৎসা পায় না, শিক্ষা পায় না। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই তাদের—উন্মুক্ত আকাশই তাদের ঘরের ছাদ। বছরের পর বছর ধরে এমনটাই চলছে। যুগের পর যুগ ধরে, বলা উচিত শতাব্দীর মতোই পুরোনো ও প্রাচীন এই সামাজিক ক্ষুধা মানব সভ্যতার এক মারাত্মক ব্যাধি, যাকে আমরা মহামারির সাথে তুলনা করতে পারি। মহামারি কোভিড-১৯-এর শিকার হয়ে আজ পর্য়ন্ত ৪২/৪৩ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে সারা পৃথিবীতে। ধারণা করি, ক্ষুধায় প্রতি বছর মারা যায় এর চেয়ে যায় বেশি মানুষ। ক্ষুধা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘমেয়াদি ‘মহামারি’। মাত্র দেড় বছর বয়সী মহামারি কোভিড-১৯-এর আক্রমণে গোটা বিশ্ব কেবল কেঁপেই ওঠেনি, তার অভিঘাতে জর্জরিত হয়ে যে সজাগ-সচেতনতার প্রপাগান্ডা চলছে, তাতে আমরা কেবল খুশিই নই, বিশ্বের মানুষ অনেকটাই সচেতন হয়ে উঠেছে। বিত্তশালীদের লাগামহীন আচরণ, তাদের খাদ্য অপচয়, অর্থনৈতিক ব্যভিচার, সামাজিক অন্যায়, শিক্ষা ও প্রযুক্তির হাত বদলের অনীহা সারা বিশ্বকে ‘ইমব্যালান্স’ করে ফেলেছিলো এবং তাই আজো অব্যাহত।
Advertisement
অন্যদিকে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে পুষ্টির সমুদ্রে ডুবে থাকার পরও ধনশালী আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি মানুষ কোভিডের শিকার হয়েছে। তার মানে কেবল ধনই মানুষকে বাঁচাতে পারে না, আরো কিছু বিষয় আছে জীবনের জন্য। আর তাহলো সব বিষয়ে সংযম। খাদ্য থেকে শুরু করে খাদ্যে সমবন্টনের মধ্যে তা নিহিত। পৃথিবীতে খাদ্যের যে পরিমাণ উৎপাদন হয় প্রতিবছর, তার কতো অংশ অপচয় হয়, কতো অংশ নষ্ট হয়, আর কতো অংশ দিয়ে তরল জ্বালানি উৎপাদন করা হয় একমাত্র আমেরিকাতে, সে হিসাব তো আমিরা জানি।
আমরা এটাও জানি যে, টনকে টন গম নষ্ট করা ফেলে তারা, তবু গরিব মানুষের জন্য তার স্থানবদল করবে না। ওই লক্ষ লক্ষ টন খাদ্যশস্য যদি সব গরিব দেশে সমানভাবে বন্টন করা হতো ,তাহলে ওই ৩০০শ কোটি মানুষকে প্রতিদিন, আধ-পেটা হয়ে জীবন কাটাতে হতো না। পুষ্টির অভাবে শিশু বামনাকৃতির হয়ে থাকতো না। আর ওই সব বামনের মেধা-মননও পড়ে থাকতো না অবিকশিত। অবিকশিত মগজ সৃষ্টিচেতনায় পারঙ্গম নয়, যতটা পারঙ্গম উন্নত দেশের পুষ্টিতে সমৃদ্ধ দেশের শিশু-কিশোর ও যুবক মানুষেরা।
আমরা কী জানি ওই ৩শ কোটি মানুষের বসবাস কোথায়? না, পরিপূর্ণভাবে জানি না। আমরা কেবল জানি আফ্রিকার কিছু দেশ অত্যন্ত গরিব। তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিও মানবিক পৃথিবীর মতো একই কাতারে নেই। কিন্তু আমরা কী জানি, আমারই পাশের বাড়ির একজন মানুষ কিংবা একটি পরিবার অপুষ্টির শিকার? প্রতিদিনই তাকে দেখছি, কিন্তু কল্পনাও করতে পারছি না কিংবা কল্পনা করতে পারলেও, তাকে সাহায্য করার মতো সাংস্কৃতিক মন ও মনন আমাদের সৃষ্টি হয়নি। আমরা নিজেদের স্থাবর-অস্থাবর সহায়-সম্পদ রক্ষার জন্য জীবনপণ করতে প্রস্তুত, কিন্তু পাশের বাড়ির লোকটির সংকট নিয়ে একটুও কাতর নই।
এভাবেই চলছে আমাদের সমাজের অপুষ্টির আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিপ্রেক্ষিত। সমাজটিও যে অপুষ্টি আর মেধাগত দিকে থেকে পুষ্টিহীনতার শিকার হয়ে রয়েছে, তা আমাদের রাষ্ট্র যেমন ভাবে না, বোঝে না, তেমনি ভাবছে না সমাজের কর্তারা। সমাজবিজ্ঞানিরা কি ভাবছেন বা তাদের গবেষণায় এই সামাজিক অপুষ্টির বিষয়টি স্থান পেয়েছে কি না, তা আমরা জানি না। তবে, সমাজের শিক্ষা ও দৃষ্টিভঙ্গিও যে পুষ্টিহীনতার শিকার সেটা আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি।
Advertisement
৩শ কোটি মানুষের আধা-পেটা থাকা মানুষেরা কিন্তু বাস করে আফ্রিকা আর এশিয়ার কিছু দেশে। তার মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, আফগানিস্তান,বাংলাদেশসহ আরো কিছু দেশে রয়েছে। আমরা সম্মিলিতভাবে এই খাদ্যের অপুষ্টি কমাতে সচেষ্ট হতে পারি। কিন্তু আমরা মানুষ বাঁচানোর চেয়ে পারমানবিক বোমার অধিকারী হতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে দ্বিধান্বিত নই।
পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর লোভ সবচেয়ে বেশি। তারা পৃথিবীর সেরা ক্ষমতার অধিকারী হতে চায়। অন্য দেশ ও জাতিকে দাবিয়ে রাখার জন্য খাদ্য নিরাপত্তাকে বাধা দেবার যন্ত্র করে তুলেছে ধনীরা। অন্যদেশের খনিজ সম্পদ কুক্ষিগত করতে তাদের শরম লাগে না। অর্থাৎ তারা মানুষের ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের ক্ষমতার রাজনৈতিক হাতিয়ার করে তোলা তোলে। মানুষের মৌলিক অধিকার খাদ্য পাওয়ার, অনেকেই ওই অধিকার নিয়ে বাহাস করেন, কিন্তু খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অস্ত্র ধরে না। কেন না, তারাও ওই ধনীদের রাজনীতিরই ক্রীড়নক বা পুডল বা গৃহপালিত কুত্তা।
এটাই হচ্ছে সেই মহামারি, যার নাম ক্ষুধা।
লেখক : কবি, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস