সাহিত্য

মায়াবতী : পর্ব ১৪

কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি—

Advertisement

পনেরো.রিয়া অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে।কুসুমকলি বলল, কী দেখছিস?রিয়া উত্তর দিল, জানি না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাইরে তাকাল ও। নির্বিকার তাকিয়ে রইল। মনে মনে ভাবে, কুসুমকলি অন্যরকম হয়ে গেছে। আগের মতো রিয়ার খবর নেয় না। রিয়ার জন্য বেপরোয়া হয় না। রিয়ার ডাকে ছুটে আসে না। কেমন রহস্যময় আচরণ করে। মাঝে মাঝে সারাদিন কোথায় উধাও হয়ে যায়। তাকে জানায় না। একদমই জানানোর প্রয়োজনবোধ করে না। তবে কি সে আর তার জানের জান ফ্রেন্ড নেই? নিজের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘটনাটা কি তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে? বদলে গেছে কুসুমকলি? বদলে গেছে বন্ধুত্ব? তলে তলে কি খারাপ ভাবছে রিয়াকে? নষ্ট ভাবছে?ভাবতে গিয়ে কষ্ট হয়। ভীষণ কষ্টে বুক চেপে ধরে। চোখ বেয়ে কান্না আসতে চায়। কান্না থামিয়ে দেয় ও। যাক। চোখ শুকিয়ে যাক। মনে মনে ভাবে, কারোর জন্য আর কষ্ট পাবে না, দুঃখ পাবে না ও। মন শক্ত করে চেয়ার থেকে উঠে খাটে গিয়ে শুয়ে থাকে।

কুসুমকলির ভাবনাজুড়ে এখন মাহিন। কেবলই মাহিন। তাই বলে রিয়ার প্রতি টান কমেনি। রিয়াকে আগের মতোই জানের জান দোস্ত ভাবে। তবু বাইরে থেকে দেখাতে পারছে না সেই দোস্তির নমুনা। মাহিনের টানের স্রোতে রিয়ার টান চাপা পড়েছে মাত্র। টানে ভাটা পড়েনি। নিজের মনের অবস্থা এখন নিজেই বোঝে না কুসুম। মাহিনের কথা গোপন রাখা কি ভুল হলো? জানে না ও।রিয়া ভাবছে একরকম। কুসুম ভাবছে আরেকরকম। দুই ভাবনার মাঝপথে তৈরি হয়েছে গ্যাপ। এই গ্যাপ কীভাবে ঘুচবে জানে না কেউ। নিয়তি কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে জানে না ওরা।

আগামীকাল কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কথা মনে আছে? রেডি হয়ে থাকিস। তোর সঙ্গে বের হব, রিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেই খাটের পাশে বসল কুসুম।আমি যাব না। তুই মুনাকে নিয়ে যাস। মাথা ঘুরিয়ে বলল রিয়া।যাব না বললেই তো হবে না। তোকে তো যেতে হবেই। কোনো ছাড় নেই।ছাড় দেওয়ার মালিক কে?মালিকের প্রশ্ন আসছে কেন? যে যার অবস্থানে অ্যাকটিভ থাকতে হবে। সেলফ রিয়ালাইজেশন হচ্ছে, নিজেই আমরা নিজের মালিক। কলেজের অনুষ্ঠান, নিজের দক্ষতা অনুযায়ী নিজেকেই ফিট রাখতে হবে। কাজ করতে হবে যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী।রিয়া মোচড়াতে থাকে নিজেকে।কুসুম বোঝে, এই রিয়া আসল রিয়া নয়। আসল রিয়া ছিল অনেক প্রাণবন্ত। অনেক উচ্ছ্বল। এই রিয়া অনেক অনুজ্জ্বল। অনেক নিষ্প্রাণ। জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘটনাটা কি তবে তাকে নিষ্প্রভ করেছে? ওই ঘটনা তো ওকে ভাঙতে পারেনি। তবে? অন্য কোনো ঘটনা আছে? নিজের গোপন অভিসারের মতো অন্য অভিসার কী ঘটছে রিয়ার জীবনে?উত্তর খুঁজে পেল না কুসুম। ওর নিজের আচরণের জন্য রিয়া কষ্ট পেতে পারে কুসুমের মনে এই ভাবনা ঠাঁই পায়নি। ভেতরে ভেতরে রিয়ার জন্য স্বচ্ছ ও। এই স্বচ্ছতার কোনো খাদ নাই। নিখাদ মন নিয়েই বলল, ওঠ রিয়া।কেন?ওঠ বলছি। রেডি হ। এখনই বের হব। চল। বাঁধনের বাসা থেকে ঘুরে আসি।বাঁধনের বাসায় কেন? কোনো অনুষ্ঠান আছে?না। অনুষ্ঠান না। ও তো ঈদে হুমায়ূন আহমেদের নাটকে অভিনয় করেছে। এখন জবরদস্ত অভিনেত্রী। ঘুরে এসেছে দুবাই। চ্যানেল আইয়ের ব্যান্ড শোতে নিমন্ত্রণ পেয়েছিল। চল। মজা হবে। অনেক গল্প শোনা যাবে।

Advertisement

আগে সবাই রিয়ার কাছে ছুটে আসত। রিয়ার গল্প শোনার জন্য ব্যাকুল হতো। এখন ছুটে যেতে হবে বাঁধনের কাছে। এজন্য মন কি ছোট হয়ে গেছে? ভেতর থেকে সাড়া আসছে না কেন? ডাক আসছে না-যাওয়ার। কী করবে রিয়া। বুঝে ওঠার আগেই কুসুমকলি নরম সুরে বলতে লাগল, ওঠো সোনামণি। ঘুরে আসি।কুসুমের আদুরে আহ্বান অবজ্ঞা করতে পারল না রিয়া। দেহ বাঁকিয়ে অনেক কষ্টে উঠে বসল। কেবল দেহ উঠেছে। ওর মনে হচ্ছে, মন ওঠেনি। এ আবার কী! মনে হচ্ছে, দেহ থেকে মন আলাদা হয়ে গেছে, দেহমনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে! তবে কি রোবট হয়ে যাচ্ছে ও!কুসুমের অবহেলা বেশি কষ্ট দিয়েছে। নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা কষ্ট দেয়নি, শঙ্কিত করেছে। শঙ্কা আর কষ্ট এক নয়। দুই ঘটনায় মন দুভাবে রিঅ্যাক্ট করেছে।কুসুমের আদর পেয়ে তাড়া পাচ্ছে ও। ভেতর থেকে সাড়া পাচ্ছে। অনীহা কেটে যাচ্ছে। কুসুমের অবহেলাকে আর অবহেলা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে অবহেলার বিষয়টা ওর মনের ভুল চিন্তা।

ওঠো সোনামণি, ওঠো। কুসুম আদর করে আবার ডাকে রিয়াকে, যেন মা ডাকছে মেয়েকে। কুসুমের এ ডাক বোঝে রিয়া। এ ডাক এড়াতে পারল না। এ ডাকে আবার কানেক্ট হয়ে যাচ্ছে দেহমন। রোমান্টিক মনে ‘প্রাণ’ ঢুকে যাচ্ছে। ‘ইচ্ছা’ জাগছে একদম ভেতর থেকে।সিনিয়র হলেও বাঁধনও ওদের ভালো বন্ধু। বাঁধনের সফলতায় তারাও তো সফল। বন্ধুর বিজয় তো ওদেরও গৌরব! এই অনুভূতি ফিরে আসতে লাগল মনে। বাঁধনের বাসায় যাওয়ার তাগিদ বোধ করতে লাগল রিয়া।এ সময় কুসুমকলির ফোনসেটে রিংটোন বেজে ওঠে। চমকে উঠল কুসুম। কুসুমের এমন চমকানো স্বভাব আগে ছিল না। চমকানো ঢংটি রিয়া খেয়াল করেনি, নিজের মনে ডুবেছিল, ভাবছিল বাঁধনের কথা।হঠাৎ খেয়াল করল কুসুম নেই।রিয়া এদিক তাকায়। ওদিক তাকায়। নেই। কুসুম উধাও।বাথরুমে ঢুকেছে?বাথরুমে উঁকি দেয় ও। না। নেই।তাজ্জব বনে গেল রিয়া।গেল কোথায়। ভয় নয়, বিস্ময় জাগল। বিস্ময় নিয়ে নিজ ঘরের বারান্দায় এলো ও। কুসুম দাঁড়িয়ে আছে। নারকেল গাছের পাতার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। বাঁ হাতে মুঠোফোন সেটটি কানে চেপে রেখেছে। ডান হাতে নারকেল গাছের পাতা প্যাঁচাচ্ছে। ফিসফিস করে কথা বলছে।

রিয়া কথা শোনার চেষ্টা করল না। মনোযোগ দিয়ে দেখল কেবলই কুসুমকে।মনে হচ্ছে এ কুসুম তার প্রাণের কুসুম না। এ কুসুমের মধ্যে ঢুকে গেছে অন্য কুসুম। এ কুসুমকে চেনে না। অচেনা কুসুমকলিকে কিছু বুঝতে না-দিয়ে ব্যালকনির দরজার পাশ থেকে ফিরে এলো রিয়া। বাথরুমে ঢুকে আয়নায় নিজেকে দেখল।নিজেকে দেখে চমকে উঠল। নিজেকেও অচেনা লাগছে। কুসমকেও অচেনা লেগেছে। চেনা জগৎ কি তবে গোপনে গোপনে অচেনা হতে থাকে, অচেনা হয়ে যায়?বাথরুম থেকে ফিরে এলো রিয়া। ব্যালকনি থেকে ঘরে ঢোকে কুসুম। আবার চাঙা হয়ে উঠেছে রিয়ার স্বর।বাথরুমে ঢোকার সময় রিয়ার মনে হয়েছিল, কুসুম নিজেকে লুকোচ্ছে। একটা কিছু গোপন করতে চাইছে। তার গোপন করার স্বভাব নেই। গোপন করে বেশিদিন চেপে থাকতে পারবে না কুসুম। জানে রিয়া। তাই ‘লুকোচ্ছে’ ভাবনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। নিজের স্বরে ফিরে এসেছে আসল রিয়ার উচ্ছ্বাস। নিজের মনে জেগে ওঠা আজেবাজে ভাবনা থেকেও ফিরে এসে দ্রুতই নিজেকে রেডি করে বাইরে বেরোনোর জন্য প্রস্তুত হয় রিয়া।

শেফালিকে ডেকে রিয়া জিজ্ঞেস করল, মামণি কোথায়?ঘরে আছে।বাপি?ভাইজান, বাসায় নাই।গাড়ি আছে নিচে?আছে। গাড়ি আপনার জন্য রাইখ্যা গ্যাছে।ড্রাইভারকে বলো গাড়ি বের করতে। এসি চালিয়ে রাখতে বলো।আচ্ছা। বলেই ইন্টারকমের দিকে এগিয়ে গেল সে। ইন্টারকমের রিসিভার তুলে থমকে গেল শেফালি।আম্মা, ইন্টারকম নষ্ট। নিচে যান। নিচে গেলেই ড্রাইভার পাবেন।যাওয়ার মুহূর্তে একটা ‘নষ্ট’ শব্দ শুনতে পেল রিয়া। সঙ্গে সঙ্গে মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে গেল। কুসংস্কারবাদী না ও। তবু মাঝে মাঝে এ চুন লেপটে ধরে। জ্বালিয়ে দেয়, তেতো হয়ে ওঠে মনের চাওয়া-পাওয়া। চুনের বিক্রিয়ায় ঝলসে ওঠে চারপাশ।এ অশান্ত মনের লাগাম টেনে ধরে নিজেকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে মায়ের কক্ষে উঁকি দিল রিয়া। দেখল মামণি ঘুমাচ্ছে।মায়ের ঘরের সামনে থেকে ফিরে ও চলে যাচ্ছিল বাইরে। ঘুরে দাঁড়াল আবার, শেফালিকে উদ্দেশ্য করে বলল, মামণিকে বোলো, আমি বাঁধনের বাসায় যাচ্ছি। গুলশান। আমার সঙ্গে যাচ্ছে কুসুম!

Advertisement

বলেই বেরিয়ে গেল রিয়া এবং কুসুম।নিচে এসে দেখল ড্রাইভার নেই। সিকিউরিটি গার্ড খুঁজতে লাগল তাকে। একসময় খুঁজে পেল। গেটের বাইরে অন্য ড্রাইভারদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল সে। সিগারেট ফুঁকছিল।নিচে অপেক্ষা করা বিরক্তিকর। বিরক্তি সামাল দিয়ে গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে রইল ওরা। একসময় ড্রাইভার ছুটে এসে হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি নিয়ে সামনে দাঁড়াল।পাশ থেকে গাড়ির দরজার হ্যান্ডেলে চাপ দেয় রিয়া। হ্যান্ডেল ভাঙা। ভাঙা হ্যান্ডেল চাপ দিতে গিয়ে আবারও রেগে বলল, এটা ভাঙল কখন? কালও তো ঠিক ছিল?কখন ভেঙেছে জানি না। দুপুরে দেখলাম ভাঙা। রাতে বদলিয়ে নেব। ঘটনা সামাল দেওয়ার চেষ্টায় ড্রাইভার বোঝাতে লাগল ওকে।রিয়ার মন বোঝে। বুঝলেও কুসংস্কার আবারও চেপে ধরে। যাত্রাপথে ভাঙা হ্যান্ডেল ছুঁতে হয়েছে! আবারও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে মন। সব মিলিয়ে যাত্রা অশুভ মনে হচ্ছে। মুখ ফুটে বলে ফেলল, চল কুসুম ফিরে যাই। মনে হচ্ছে যাত্রা শুভ হবে না।কুসুমকলি বলল, ঝামেলা করিস না। চল। শুভ-অশুভ বলে কিচ্ছু নেই।আগে নেই বলে বিশ্বাস করতাম। এখন বিশ্বাস করি। মনে হয় আছে। কুসংস্কার আছে। বলতে বলতে গাড়িতে উঠে বসল দুজন।রিয়ার গলার স্বর ভারী। ভারী কণ্ঠে ড্রাইভারকে বলল, গুলশান চলো।কুসুমকলি বলল, কল করে দেখি বাঁধন কোথায় আছে।কোথায় আছে মানে? তুই না বললি সে বাসায় থাকবে!বলেছি ওর বাসায় যাব। থাকবে কি-না, তা তো জানি না।ঠিক আছে। কল কর। কুসুমের উদ্দেশে কথা শেষ করে রিয়া। ড্রাইভারকে বলল, তুমি চলতে থাকো।

চট করে বাঁধনকে ফোনে পেয়ে গেল কুসুম।কিরে, কোথায় আছিস?বনানী রোডে নন্দনে আছি। শপিং করছি।আমরা তো তোর বাসায় যাচ্ছিলাম।যাচ্ছিলি তো আয়। বাসা তো কাছে। আমি বাসায় ফিরব। আমরা মানে কী? কে কে আছে তোর সঙ্গে? বাঁধনের কথায় উচ্ছ্বাস। ঝড়ো প্রশ্ন।আমি আর রিয়া আসছি।বাহ! বাহ! আয়। চলে আয়। নন্দনে আয়। পরে একসঙ্গে বাসায় যাব।কুসুম বলল, কথা বল বাঁধন, রিয়ার সঙ্গে কথা বল।রিয়া মোবাইল ফোনসেট কানের কাছে ধরেই বলে, হ্যালো। হাই দোস্ত! সুইট গার্ল। আমাকে মনে পড়েছে? খুব খুশি হয়েছি।ধন্যবাদ! আসছি আমরা।আসছি কিরে, দ্রুত আয়! এক কাজ কর তোরা বনানী রোডে নন্দনে চলে আয়। পরে একসঙ্গে বাসায় যাব।আচ্ছা। আসছি।

ফোনে কথা শেষ করে রিয়া ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলো, বনানী রোডে নন্দনে চলো।ড্রাইভার শুনল। মুখে শব্দ না করে, শুনেছি, এমন ভঙ্গিতে মাথা দোলাল সে।রিয়া ও কুসুম আলাপে জমে গেছে। গাড়ি চলছে ভিড় ঠেলে। কয়েকদিনের অবরোধে ঢাকার চেহারা পালটে গিয়েছিল। আবার চিরচেনা ব্যস্ত ঢাকা গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। ভিড় দেখে মনে হলো, শহরের সব গাড়ি রাস্তায় নেমে এসেছে। কয়েকদিন আগের চেহারার সঙ্গে এ চেহারার কোনো মিল নেই। অমিলটা হচ্ছে লম্বা। রাজনৈতিক কারণে এমনটা ঘটেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজ তিন মাসের ছুটিতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। সাংবিধানিক নিয়মে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকাকে ছুটি হিসেবে গণ্য করা হবে। শর্ত হচ্ছে: তিন মাসের ছুটিকালীন দেশে থাকবেন তিনি, নিরাপত্তা ও সুবিধা অব্যাহত থাকবে। রাষ্ট্রপতি দুজন নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করবেন।কুসুম বলল, মনে হচ্ছে আপাতত রাজনৈতিক জটিলতার সুরাহা হবে।রিয়া সংশয় প্রকাশ করে বলল, মনে হয় দিল্লি বহুদূর।কেন? এমন মনে হলো কেন?রিয়া গুণীজনের মতো বলল, দেখিস না, আওয়ামী লীগ বলছে এটা তাদের আন্দোলনের বিজয়, জনগণের বিজয়।কুসুম বলে উঠল, তা তো ঠিকই। আন্দোলন না করলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কি সরে যেতেন?ঠিক আছে মানলাম তোর কথা। কিন্তু বিএনপি বলছে এটা সংবিধান রক্ষায় তাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিজয়, গণতন্ত্র রক্ষায় জনগণের বিজয়।হ্যাঁ। ঠিকই আছে। দুই দল দুভাবে দেখছে, নিজেদের অবস্থান থেকে ঘটনা দুভাবে মাপছে।তার মানে, দ্বিমত তো জিইয়ে থাকল।একমত হলে তো আর রাজনীতি হলো না। রাজনীতি মানেই দ্বিমতের খেলা। এ খেলায় কেউ হারে কেউ জেতে। মুশকিল হলো, কার বিজয় হয়েছে এ বিতর্ক নিয়ে এখন আবার যুদ্ধ শুরু হতে পারে।দলগুলো বিতর্ক করুক। আমরা শান্তি পেলেই হলো। কোনো বিতর্ককে অসহনীয় চোখে ঘোলানো ঠিক না। শান্তির জন্য সব মতকে শ্রদ্ধা জানানো উচিত। শ্রদ্ধা জানানোর একটা আলামত দেখা যাচ্ছে। দুই দল অন্তত একমত হয়েছে। বিজয়ের ব্যাপারে। দুই দলই ভাবছে তারা বিজয়ী। এ বিজয়ে তারা একমত। মতের মিলের কারণে শান্তি আসতে পারে।শান্তি আর পাচ্ছি কোথায়, রিয়া ক্ষোভের সঙ্গে বলল, দেখিস না জ্যামে আবার আটকে যাচ্ছে শহর। আবার অশান্তি জেগে উঠছে অন্য ঢঙে, অন্য রূপে অশান্তি হানা দিচ্ছে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মনে।তোকে তো এখন সাধারণ মানুষ মনে হচ্ছে না, রিয়া। মনে হচ্ছে বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছিস।ওরে বাবা! রাজনীতিবিদ হতে চাই না।না চাইলে কি চলবে না-কি? কথাবার্তায় তো তোকে অনেক ম্যাচিউর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মনে হচ্ছে।হোক। তবুও ওই পথে পা দেব না।দিবি না তো, রাজনীতির কথা বলিস না। চুপ থাক।চুপ তো থাকতে পারি না, মনের মধ্যে নানা কারণে ক্ষোভ জেগে ওঠে। এই দেখ না, ফারুক মামাকে বদলি করে দিয়েছে।এবার বুঝেছি, তোকে রাজনীতিবিদ হওয়া চলবে না। একটু আগে বললি এই পথে নামতে, আবার বলছিস চলবে না। ব্যাপার কী? দুই মত কেন? এটাও কি রাজনীতির খেলা?না। খেলা না। এটা হচ্ছে বাস্তবতা। ফারুক মামার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবেছিস তুই। মানে নিজের স্বার্থের বৃত্ত থেকে বেরোতে পারিসনি।তো। এটাই তো স্বাভাবিক। নিজের স্বার্থের কথা ভাবব না? বলেই কুসুমের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে রিয়া।কুসুম আবার বিজ্ঞের মতো বলল, রাজনীতিবিদদের দেখতে হবে জনগণের স্বার্থ। নিজের স্বার্থ না। জনগণের স্বার্থরক্ষায় একজোট হলে দেশের কল্যাণ হবে। মঙ্গল হবে। দেশে শান্তি আসবে। তুই ইনিয়ে-বিনিয়ে দেখছিস নিজের স্বার্থ। তোকে দিয়ে রাজনীতি হবে না।রিয়া এবার উল্লসিত হয়ে বলল, আমার কথায় এলি তুই।মানে কী, রিয়া?মানে আমি তো রাজনীতিবিদ হতে চাইনি। সেই বাক্সে ভোট দিলি। আমার দলে ভিড়ে গেলি না?দুজনেই এবার হো-হো করে হাসতে লাগল।

চলবে...

এসইউ/জিকেএস