সম্প্রতি ইন্ডিয়া টুডের একটি নিউজ থেকে জানা যায় গায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকা পোশাক পরার ‘অপরাধে’ আফগানিস্তানে তালেবানের হাতে খুন হয়েছেন এক নারী। বাড়ির কোনো পুরুষ সদস্যকে সঙ্গে না নিয়ে, একা রাস্তায় বেরিয়েছিলেন ওই নারী, যা তালেবানের কাছে ‘গুরু অপরাধ’। তাই দিনের বেলা প্রকাশ্য রাস্তায় ওই নারীকে গুলি করে খুন করেছে তারা। যদিও তালিবানরা এ খুনের কথা অস্বীকার করেছে। এর আগে আফগানিস্তানের তালেবান কর্তৃক নিহত হয় বিশ্ববিখ্যাত পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী সাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকী।
Advertisement
কয়েক দশক ধরে এভাবেই প্রতিদিন প্রাণ হারিয়েছে অনেকে। শুধু তাইনা এই দিনগুলোতে প্রতিটি আফগান তাদের কোনও না কোনও প্রিয়জনকে অবশ্যই হারিয়েছে। তালেবানরা ক্ষমতায় আসার ইঙ্গিত পেয়ে তাদের হাত থেকে বাঁচতে দেশ ছাড়তে মরিয়া হয়ে উঠেছেন আফগানরা। যেখানকার প্রতিটি শিশু জন্মের পর থেকেই রক্তপাত লড়াই, আত্মঘাতী বোমা হামলাসহ নিষ্ঠুর দৃশ্য দেখে বেড়ে উঠে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্মের নামে কেন এই নিষ্ঠুরতা। কেন মানুষ শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে রাত্রিযাপন করতে ভয় পায়। কোন ধর্মই তো রক্তপাতের শিক্ষা দেয় না। তাহলে কেন এই অশান্তি?
বাহ্যত দৃষ্টিতে মনে হবে, যেখানেই ধর্ম সেখানেই অশান্তি, যেখানেই ধর্ম সেখানেই বিগ্রহ ও নৈরাজ্য। কিন্তু না একটু মনোযোগ দিয়ে গভীর দৃষ্টিতে দেখুন। দেখতে পাবেন, সমগ্র বিশ্বের এই বিশৃংখলা ও নৈরাজ্য প্রকৃত ধার্মিকদের পক্ষ থেকে নয় আর আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত সত্য ধর্মের অনুসারীদের পক্ষ থেকেও নয়। এসব নৈরাজ্য আসলে যারা সমাগত সত্য সুন্দর জ্যোতিকে অস্বীকার করে অন্ধকারের পূজারী হয়ে থাকতে চেয়েছে, যারা তাদের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও গলিত মথিত সমাজ দর্শন পরিত্যাগ করতে চায়নি-এসব অরাজকতা ও সন্ত্রাস সব সময় সর্বযুগে তাদের পক্ষ থেকেই পরিচালিত হয়েছে এবং হচ্ছে।
অনেকে মনে করেন হজরত রাসুল করিম (সা.) ইসলাম কায়েম করার জন্য অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। পবিত্র কোরআনে স্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে মহানবী (সা.) ও তার অনুসারীরা দীর্ঘকাল মক্কায় অত্যাচারিত, নিপীড়িত থাকার অনুমতি পর যখন তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য আবারও মক্কায় কাফেররা যুদ্ধ চাপিয়ে দিল কেবল তখনই আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করার দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, একথা বলা হয়েছে, কেবল মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষার্থে এই যুদ্ধ পরিচালিত হবে না। বরং মঠ, গীর্জা, সেনেগগ ও মসজিদ তথা সকল ধর্মের উপাসনালয় রক্ষার্থে আল্লাহ এ ব্যবস্থা নিয়েছেন। সকল ধর্মীয় ও বিবেকের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার এর চেয়ে স্পষ্ট ঘোষণা আর কি হতে পারে!
Advertisement
কিন্তু আক্ষেপের বিষয় বরং লজ্জার বিষয় হলো, কোরআন করিমের অনুসারী হবার দাবিদার এক শ্রেণির মুসলমান আজ কোরআন শরীফে বর্ণিত এই সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের শিক্ষা ভুলে গিয়ে, পরমত সহিষ্ণুতার পথ জলাঞ্জলি দিয়ে যে কোনভাবে রাজ্য ক্ষমতা লাভের নাম ‘ইসলামী জেহাদ’ রেখেছে। আত্মহত্যার মত হারাম কাজকে কাফের বধ করার ‘জান্নাতি পন্থা’ হিসেবে অবলম্বন করে বসে আছে। আজ পৃথিবীতে শান্তি ও নিরাপত্তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সর্বত্রই ভয়-ভিতি আর অশান্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে। অস্ত্র-শস্ত্র এবং মানুষকে ধ্বংস করে দেয়ার অস্ত্র ও মাধ্যম সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। একজন মানুষ অন্যজনের শত্রু বনে বসে আছে। শক্তিশালী জাতি তার চেয়ে তুলনামূলক দুর্বল জাতির ওপর জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাস দমনের নামে বৃহৎ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একটিই পথ আর তা হলো, পবিত্র কোরআনের শিক্ষার ওপর আমল আর মুসলমানরা যেন নিজেদের আমলের মাধ্যমে ইসলামকে বদনাম করা ছেড়ে দেয়। তারা যেন ইসলামের প্রকৃত শিক্ষায় আমল করে এবং পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়। অন্যান্য জাতিদের কল্যাণও এতেই নিহিত যে, তারা যেন ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হয়ে যায়, কেননা বিশ্বের শান্তি কেবলমাত্র প্রকৃত ইসলামের সাথেই সম্পৃক্ত। বর্তমানে বিশ্ব যেসব বড় বড় সমস্যায় জর্জরিত এসব পরিস্থিতিকে যদি এক বাক্যে বলতে হয় তাহলে মৌলিক সমস্যা হলো, শান্তি উঠে যাওয়া আর এটি নিরসনে আজ পর্যন্ত যত চেষ্টা-প্রচেষ্টা করা হয়েছে তা বাহ্যত সবই ব্যর্থ হয়েছে।
জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়েছে আর এখন ইউনাটেড ন্যাশনসকে পর্যদুস্ত মনে হচ্ছে। পুরো মানবজাতি আজ অস্থির যে, তাদেরকে কখন, কোথা থেকে এবং কীভাবে শান্তি নামের অমূল্য সম্পদ জুটবে। হ্যাঁ, পুরো বিশ্বে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে কিন্তু তা কেবল পবিত্র কোরআনে উপস্থাপিত শিক্ষামালা অবলম্বনের মাধ্যমেই সম্ভব। রাসুল পাক (সা.)-এর কল্যাণমণ্ডিত পুরো জীবন এ বিষয়ের জীবন্ত সাক্ষী, তিনি শান্তি ও নিরাপত্তার এক মহান মূর্তিমান প্রতিক হিসাবে জীবন যাপন করেছেন এবং চরম প্রতিকূল ও কঠিন পরিস্থিতিতেও শান্তির পতাকা উঁচু রেখে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, কুরআনি শিক্ষামালার ওপর আমল করলে পরেই বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তার মাক্কী জীবনী এবং মাদানী যুগেও তার পুরো জীবনাদর্শ এমনসব ঘটনাবলীতে পরিপূর্ণ যে, কীভাবে রাসুল পাক (সা.) তার মান্যকারীদেরকে কোরআনের শিক্ষামালার কল্যাণে শান্তির মূর্তিমান প্রতিক বানিয়ে দিয়েছেন।
যুদ্ধ ক্ষেত্রেও তিনি মুসলমানদের সামনে এক পরম সহানুভূতিপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ উত্তম নৈতিক আদর্শ উপস্থাপন করেছেন। যুদ্ধের নাম নিলেই তো বর্তমান যুগের নাম সর্বস্ব সভ্য দেশগুলো নম্রতা, নৈতিক আচরণ, সহমর্মিতা এবং ন্যায়বিচারের সকল দাবি সম্পূর্ণভাবে ভুলে যায়। কিন্তু বিশ্বশান্তির মহানায়ক হজরত মুহাম্মদ (সা.) যুদ্ধ এবং হানাহানির ক্ষেত্রসমূহে শান্তি ও নিরাপত্তার উন্নত মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করে এমন অতুলনীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছেন যা সকল যুগে পুরো মানবজাতির জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে। ‘যুদ্ধ’ মানেই যেখানে বিভীষিকা, মৃত্যু, ধ্বংস, সেখানেও মহানবী (সা.) যুদ্ধনীতির ঠিক করেছিলেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন ‘যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতারণা করা যাবে না, বিশ্বাস ভঙ্গ করা যাবে না, নিহত ব্যক্তির অঙ্গচ্ছেদ করা যাবে না, নারী-শিশু-বৃদ্ধদের হত্যা করা যাবে না, শত্রু হলেও প্রার্থনারত অবস্থায় কোনো ব্যক্তিকে আঘাত করা যাবে না, ফলদায়ী গাছ কাটা যাবে না।’ (তারিখ আল-তাবারি)
Advertisement
মক্কা বিজয়ের দৃষ্টান্ত এ বিষয়ে স্পষ্ট সাক্ষি। তার সকল খুনি শত্রুদের ক্ষমা করে বিশ্ব ইতিহাসে সেই দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করেছেন যা কিয়ামত পর্যন্ত এর কোন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিভিন্ন চুক্তি পালনের ক্ষেত্রে মহানবী (সা.) সর্বদা এমন আদর্শ দেখিয়েছেন যার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। শান্তির অভিযাত্রা এক ব্যক্তি সত্তা থেকে শুরু হয়। এর বীজ মূলত সবচেয়ে প্রথমে মানুষের হৃদয়ে বপন করা হয়। এটি যখন বর্ধিত হয় তখন সেই ব্যক্তির পরিবার শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করে। এরপর এটি পারিবারিক জীবনকে ছাড়িয়ে শান্তির এই কল্যাণ সমাজে এবং চারপাশে বিস্তার লাভ করে। এর পরবর্তী ধাপ জাতীয় শান্তি ও নিরাপত্তা হয়ে থাকে যা অবশেষে আন্তর্জাতিক শান্তির রূপ ধারণ করে নেয়। এটি কোন ধারণাপ্রসূত ও কাল্পনিক ফরমুলা নয় বরং এটি এমনই সত্য যার প্রকাশ পুরো বিশ্বে দৃষ্টিগোচর হয়।
বর্তমানে তালেবানরা ধর্মের নামে যে রক্তপাতের ঘটনা ঘটাচ্ছে তা কখনই ইসলাম ও শান্তির দূত বিশ্বনবী (সা.)- এর আদর্শ নয়। মহানবী (সা.) যুদ্ধ ক্ষেত্রেও কোন নারী এবং শিশুকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। এমনকি বিদায় হজের ভাষণে বিশ্বনবী (সা.) বিনা অপরাধে একজন নিরীহ মানুষকেও হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। অথচ গায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকা পোশাক পরার ‘অপরাধে’ (তালেবানদের দৃষ্টিতে) একজন নারীকে হত্যা করে যারা ইসলামে সেবা করছে বলে মনে করছেন তারা নিশ্চয় অনেক বড় ভ্রান্তির মাঝে আছে। মানুষ হত্যা এটি কখনই ধর্মের শিক্ষা হতে পারে না। তারা আর যাই করুক না কেন তারা যে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষার অনেক দূরে অবস্থান করছেন এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তারা ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের মনমস্তিষ্ককে ধোলাই করে। যার ফলে তাদের মতাদর্শে আসক্ত হয়ে আমাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করে।
আমাদের প্রত্যেকের পরিবারের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। আমাদের সন্তানরা যেন কোনভাবেই ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে সরে না যায়। অনেকে হয়তো বলবেন তালেবান আফগানিস্তানে, এখানে এসব সম্ভব নয়। আমরা চাই এমনটিই যেন হয়। তবে এমন ধারণা করে বসে থাকা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা। কেননা আমাদের দেশেও স্লোগান দিতে শুনতাম ‘আমরা হবো তালেবান বাংলা হবে আফগান’। আমরা চাই আমাদের কানে এমন স্লোগান আর কখনও ভেসে না আসুক। বিশ্বের প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি ধর্মের অনুসারী শান্তি, সৌহাদ্য ও নিরাপত্তার সাথে জীবন যাপন করবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
এইচআর/এমএস