ফিচার

বাড়ুক বৈচিত্র্যময়তা, আদিবাসীরা পাক বাঙালির মর্যাদা

আবির হাসান সুজন

Advertisement

আজ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। প্রতিবছর ৯ আগস্ট পালিত হয় এই দিবসটি। বিশ্বের প্রায় ৯০টি দেশের ৩৭০ মিলিয়ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী এ দিবসটি পালন করে। এ দিবসে নিজেদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি উপস্থাপনের পাশাপাশি; নানা দাবি-দাওয়া নিজ রাষ্ট্র এবং বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন।

তবে অত্যন্ত দুঃখজনক যে, রাষ্ট্রের কাঠামো এবং সাংবিধানিক পরিভাষায় ‘বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই’। বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’ বলতে কাদেরকে বোঝায়, তা এখনও বিতর্ক অমীমাংসিত রয়ে গেছে। আদিবাসী শব্দটির প্রকৃত সংজ্ঞা, তাদের জাতীয় পরিচয় ও অধিকার নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিস্তর বিতর্ক আছে।

আদিবাসী বলতে বোঝায়- সাধারণত কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় অনুপ্রবেশকারী বা দখলদার জনগোষ্ঠীর আগমনের পূর্বে যারা বসবাস করত (এটা ঔপনিবেশিকতার অভিজ্ঞতার সাথে সম্পৃক্ত এবং আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) এবং এখনও করে।

Advertisement

যাদের নিজস্ব ও আলাদা সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও মূল্যবোধ আছে। যারা নিজেদের আলাদা সামষ্টিক সমাজ-সংস্কৃতির অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যারা সমাজে সংখ্যালঘু হিসেবে পরিগণিত তারাই আদিবাসী।

বিভিন্ন দেশের বৈচিত্রময় সংস্কৃতির সংরক্ষণের জন্য ১৯৯৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ঘোষণা করা হয় আদিবাসী দিবস। এরপর থেকেই প্রতিবছর ৯ আগস্ট বিশ্বের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একটি আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

সত্যিকার অর্থে তখন থেকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপন করে আসছে। প্রতিবছর আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে জাতিসংঘ কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে একটা ঘোষণা দেয়। যাতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো সেটা সমানে রেখে এ দিবস পালন করে।

বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাস করছে প্রায় ৩০ লাখ ক্ষুদ্র-জাতিগোষ্ঠীর জনগণ। সাংবিধানিক কাঠামোতে বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো জাতিসত্তার মানুষকে বাংলাদেশের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। এর কারণ হলো, বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬(২)-এ উল্লেখ আছে, ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন’।

Advertisement

অর্থাৎ বাঙালিরাই বাংলাদেশের নাগরিক এবং বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ (সাঁওতাল, গারো, মণিপুরি, ওরাং, মুন্ডা, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খুমি, ম্রো প্রভৃতি) বাংলাদেশের নাগরিক হবে না । তবে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৩-এ গিয়ে এসব জাতিগোষ্ঠীকে জাতি হিসেবে নয় বরং অন্য নামে এক ধরনের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

বাঙালি ছাড়া ভিন্ন জাতিসত্তার যেসব মানুষ বাংলাদেশে বাস করে তারা রাষ্ট্রের ভাষায় ‘বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী, এবং সম্প্রদায়’ (বাংলাদেশ সংবিধান ২৩/ক) হিসাবে পরিচিত।

আজ সারা পৃথিবী জুড়ে বহুভাষা ভাষী মানুষ এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের আদিবাসী মানুষ যথাযথভাবে আন্তর্জাতিক এই দিবসটি পালন করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের আদিবাসীরা তাদের আত্মপরিচয় খুঁজে বেড়াচ্ছে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকেই আদিবাসীরা তাদের আত্মপরিচয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। ১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৬(২) ধারায় বাংলাদেশকে ‘বাঙালির দেশ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।

২০১১ সালের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ‘এদেশের নাগরিক বাঙালি বলিয়া গন্য হইবে’ বলে ‘অবাঙালি আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীকে সাংবিধানিকভাবে অস্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যার অর্থ বিগত চার দশকেরও অধিক সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। তবে ‘আদিবাসীদের’ স্বীকৃত অধিকার বিষয়ের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়নি।

এছাড়াও ২০১১ সালের আদমশুমারিতে বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসীদের বলা হয়েছে ‘এথনিক পপুলেশন’ আর পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ২৩ (ক) অনুচ্ছেদে সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্ন জনগোষ্ঠীকে ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’ প্রভৃতি শব্দ দিয়ে নির্দেশ করা হয়েছে। যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আদিবাসীবিষয়ক বিতর্কটি এখনো অথৈ সমুদ্রেই রয়ে গেল। তাই আদিবাসী দিবস এর মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত- পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অবহেলিত, সুযোগবঞ্চিত আদিবাসী জাতিসমূহের সমস্যাগুলোর ওপর মনোযোগ আকর্ষণ করা। তাদের অধিকার রক্ষা ও উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করা।

যেদিন এ রাষ্ট্র আদিবাসীদের যথাযথ স্বীকৃতি দিয়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজেদের আত্মপরিচয়ের অধিকার প্রদান করবে; সেদিনই সত্যিকার আদিবাসী দিবস হবে। আদিবাসীদের জন্য যুগপোযগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমিকমিশন তাঁদের ভূমিসংক্রান্ত জটিলতার নিরসন করতে হবে।

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকল্পে দক্ষতাবৃদ্ধিসহ আদিবাসী যুব সমাজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় আদিবাসী প্রতিনিধিত্ব ও জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে আদিবাসী নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণ করতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়৷

জেএমএস/এমকেএইচ