নীলফামারী পাক হানাদার মুক্ত হয় একাত্তরের ১৩ ডিসেম্বর। এর আগে পাক হানাদার বাহিনীরা সড়ক পথে ৩ মার্চ সকালে নীলফামারী দখল করে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ লড়াই আর মুক্তিকামী জনগণের দুর্বার প্রতিরোধে ডিমলা, ডোমার, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ, সৈয়দপুর ও নীলফামারীতে পতন হতে থাকে পাক হানাদার বাহিনীর। এক পর্যায়ে চূড়ান্ত বিজয়ের পূর্ব মুহূর্তে মুক্তিযোদ্ধারা নীলফামারী শহর ঘিরে ফেললে অবস্থা বেগতিক দেখে এই দিনে ভোর ছয়টায় নীলফামারী রেলওয়ে স্টেশন থেকে পাক সেনা, রাজাকার আলবদর ও তাদের দোসর অবাঙালিরা দুটি স্পেশাল ট্রেনে করে সৈয়দপুরে ক্যান্টমেন্টে পালিয়ে যায়। নীলফামারীর ১৯৭১ সালের এই দিনে এখানে সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে মুক্তির উল্লাস। ১৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পাক বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয় এ জেলা। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৬নং সেক্টরে পড়ে নীলফামারী। এছাড়া জেলার ডোমার ১০ ডিসেম্বর ও ডিমলা উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ১১ ডিসেম্বর মুক্ত করা হয়েছিল।১৯৭১ সালের এই দিনে নীলফামারী শত্রুমুক্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক থেকে লোকজন ছুটে আসতে থাকে শহরের দিকে। সন্ধ্যার মধ্যে শহর এলাকায় লোকজন পূর্ণ হয়ে যায় আর মুক্তির উল্লাস করতে থাকে। স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে শহর ও গ্রাম। আনন্দে উদ্বেলিত কন্ঠে স্বদেশের পতাকা নিয়ে ছোটোছুটি করতে থাকে তরুণ, যুবক থেকে শুরু করে সব বয়সীরা। ১৯৭১ সালের এই দিনে নীলফামারী শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হলে বিজয়ের উল্লাসে মেতে উঠে নীলফামারীর মুক্তিকামী সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ। শহরের বিভিন্ন রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ে আনন্দ মিছিল। বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো মানুষ জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে ও বিজয়ের পতাকা নিয়ে ঢুকে পড়ে তৎকালীন নীলফামারী মহকুমা শহরে।সন্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়া বীর মুক্তযোদ্ধা জয়নাল আবেদিন জাগো নিউজকে বলেন, নীলফামারী শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে ১৩ ডিসেম্বর প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। তারই স্মৃতিতে আজ সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে স্বাধীনতা স্মৃতি অম্লান স্তম্ভ।জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ফজলুল হক জাগো নিউজকে বলেন, প্রয়াত লোকমান হোসেন, প্রয়াত একরামুল হক ও ফুলু মিয়া নীলফামারীর বড় মাঠে কয়েকদিন অস্ত্র প্রশিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণ দেন। এরপর তিনিসহ সকল মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের দেওয়ানগঞ্জে গিয়ে সেখানেও প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিয়ে ৬নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খাদেমুল বাশারের নেতৃত্বে ১৩ ডিসেম্বর নীলফামারী হানাদার মুক্ত করেন। তিনি বলেন, জেলায় প্রায় দুই হাজার জন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। শহীদ হয়েছেন ৭১ জন। নীলফামারী জেলায় ৮১০ জন মুক্তিযোদ্ধা সরকারি ভাতা পাচ্ছেন। আরও ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধার জন্য ভাতার আবেদন করা হয়েছে। ১শ` ৩০ জন মারা গেছেন। অসুস্থ্য ও অসহায় অবস্থায় রয়েছেন প্রায় ১১৬ জন।জেলায় গণকবরের (বদ্ধভূমি) সংখ্যা ২৫টি। বদ্ধভূমিগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। বদ্ধভূমিগুলো সংস্কার ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানান জেলার সকল মুক্তিযোদ্ধারা। যে কয়েকটি বদ্ধভূমি সংস্কার করা হয়েছে তাও আবার অযত্নে ও অবহেলায় পড়ে রয়েছে।জেলা মুক্তিযোদ্ধা অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছরে এই দিনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা অর্পণ, র্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।নীলফামারীর জেলা প্রশাসক সূত্রে জানা গেছে, এই দিনটি উদযাপনের জন্য নীলফামারীর বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন, সাংবাদিকবৃন্দ ও জেলা প্রশাসন বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সকাল ১০টায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স থেকে র্যালি বের করা হবে। র্যালিটি শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ শেষে নীলফামারীর মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্সের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার গোলনা ইউনিয়নের কালীগঞ্জ নামক স্থানে এ দেশীয় দোসর রাজকার আলবদরের সহযোগিতায় পাকিস্তানী সেনারা ৩শ`র বেশি নিরাপরাধ মানুষকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করেছিল। সেদিনের এই হত্যাযজ্ঞের ঘটনা চেঙ্গিস খান, হালাকু খান ও হিটলার মুসোলিনীর বর্বরতাকেও হার মানিয়েছিল। যা আজও সকলের হৃদয়ে পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদরের বর্বরতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। স্থানটি কালীগঞ্জ বধ্যভূমি বলে পরিচিতি লাভ করে। কালীগঞ্জ হত্যাকাণ্ডে সেসব শহীদদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্মরণীয় করে রাখতে সেখানে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিসৌধ এবং একটি শহীদ মিনার। যা আজও কালের সাক্ষী হিসেবে বিদ্যমান। বধ্যভূমির চারপাশে ময়লা আবর্জনা পড়ে থাকে। সামনেই রয়েছে দোকান। এলাকাবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বছরের একদিন পরিস্কার করা হলেও বছরের বাকি সময়টুকু পড়ে থাকে চরম অবহেলায়। সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে অমল চন্দ্র অধিকারী জাগো নিউজকে বলেন, পাকসেনা রাজকার ও আলবদরের হাত থেকে জীবন বাঁচাতে ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল গোলনা ইউনিয়নের তিনিসহ চার শতাধিক নারী-পুরুষ নিরাপদ স্থানে সরে যাচ্ছিলেন। সেদিন দুপুর ১২টার দিকে নারী পুরুষের দলটি কালীগঞ্জ নামক স্থানে পৌঁছালে আকস্মিকভাবে পাকসেনাদের ৪-৫টি গাড়ি সেখানে উপস্থিত হয়। রাজকারসহ পাকসেনারা গাড়ি থেকে নেমে সবাইকে ঘিরে ফেলে। বেছে বেছে পুরুষ ও নারীদের পৃথক করা হয়। এরপর পুরুষদের দাঁড় করিয়ে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে। এ নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে গাড়ি নিয়ে জলঢাকা থানা সদরে পৌঁছে হানাদার সেনাবহর। সেখান থেকে শান্তি কমিটির সদস্যদের ঘটনাস্থলে পাঠিয়ে মরদেহ মাটিচাপা দেয়া হয়। সে সময়ে ৯ম শ্রেণির ছাত্র অমল চন্দ্র অধিকারী ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। পিস কমিটির সদস্যরা যখন মাটিচাপা দিয়ে চলে যায় তখন তিনি মাটি ভেদ করে রাতে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় তিনশ` হিন্দু পরিবারের পুরুষদের সঙ্গে তার বাবা ও দাদাও নিহত হন পাক সেনাদের হাতে। জলঢাকা উপজেলা পরিষদের আর্থিক সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কালীগঞ্জ বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে। জলঢাকা উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হামিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, দিনটির কথা শুনলে গা শিউরে উঠে। পাকিস্তানী বাহিনী বাঙালিদের উপর যে বর্বরতা চালিয়েছে তা ভুলবার কথা নয়। নতুন প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস শেখার আহ্বান জানান তিনি।নীলফামারী জেলা শহর থেকে কালীগঞ্জের বধ্যভূমির দুরত্ব ৩০ কিলোমিটার। জলঢাকা উপজেলার ৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমের ছোট্ট একটি বাজার, যার বর্তমান নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু হাট। এখানে হত্যা করা হয়েছিল কাঠালী, বালাগ্রাম ও জলঢাকার ৩ শতাধিক তরুণ ও যুবককে।জাহেদুল ইসলাম/এমজেড/আরআইপি
Advertisement