বিশেষ প্রতিবেদন

আজও চাচৈর রণাঙ্গনে নির্মিত হয়নি স্মৃতিস্তম্ভ

১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর। ঝালকাঠি সদর উপজেলার চাচৈর রণাঙ্গনে ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকহানাদার বাহিনীর মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এতে মুক্তিযোদ্ধা আউয়াল, আদু খান, হামেদ আলী, সেকান্দার মাঝি, আলেয়া ও তার ছোট ভাই শহীদ হন এবং পাকহানাদার ও রাজাকারসহ ৬০ জন মারা যায়। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পার হলেও এ পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়নি কোনো স্মৃতিস্তম্ভ, সহায়তা পায়নি কোনো শহীদ পরিবার। সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার জানান, ঝালকাঠির সদর উপজেলার চাচৈর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সাব-ক্যাম্প। নলছিটি উপজেলা কমান্ডার মো. সেকান্দার মিয়ার নেতৃত্বে ২৮ জন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার এ চাচৈর সাব-ক্যাম্পে পাক হানাদার বাহিনী আক্রমণ করবে বলে ১২ নভেম্বর রাতে খবর পায়। ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরকে জানালে তিনি ১২০ জন মুক্তিযোদ্ধা, সদর উপজেলা কমান্ডার সুলতান হোসেন মাস্টার ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমাদের সঙ্গে ১৩ নভেম্বর সকালে যোগ হয়। ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর আমাদের রণকৌশল জানিয়ে দেয়। পাকহানাদার বাহিনী ধীরে ধীরে আমাদের ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তাদের বিরুদ্ধে অপারেশন চালানোর জন্য পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। সকাল ১০ টায় এক প্লার্টুন পাকহানাদার বাহিনী ঢুকে পড়ে চাচৈর গ্রামে। মুক্তিযোদ্ধারা উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম ৩ দিক থেকে পাকহানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করে। দক্ষিণ দিক খোলা পেয়ে সেদিকে পিছু হটতে থাকে তারা। ইতোমধ্যে অনেক রাজাকার ও পাক হানাদার সদস্য নিহত হয়। একই এলাকার খান বাড়ি চতুর্দিক থেকে ঘিরে থাকায় মাঝখানের আঙিনায় ঢুকে রাজাকার ও হানাদার বাহিনী আশ্রয় নেয়। ইতোমধ্যে তাদের অনেকেই গুলি লেগে আহত হয়েছেন। সেই পূর্ব কৌশলে দক্ষিণ দিকের ছন বনে মুক্তিযোদ্ধারা গোপনে হামলা করার প্রস্তুতি নিয়ে বাকি ৩ দিক থেকে গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে আতঙ্কিত করতে থাকে। এদিকে পাকসেনারাও পাল্টা গুলি ছুঁড়লে শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। এ সময় শহীদ হয় কাঠিপাড়ার আ. আউয়াল, খান বাড়ির বাসিন্দা আদু খান, হামেদ আলী, সেকান্দার মাঝি, আলেয়া ও তার ছোট ভাই শহীদ হন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে হানাদার বাহিনী দক্ষিণ দিক খোলা দেখে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। সেখানে ওৎ পেতে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা সুযোগ বুঝে ব্রাশ ফায়ার করলে ঘটনাস্থলেই ১৮ জন পাকহানাদার নিহত হয়। সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে যুদ্ধ। এ সম্মুখযুদ্ধে রাজাকার ও পাকহানাদার কমান্ডারসহ প্রায় ৬০ জন নিহত এবং যুক্তিযোদ্ধাসহ ৬ জন শহীদ হন। আলোচিত এই যুদ্ধে লজ্জাজনক পরাজয় ঘটে পাক বাহিনীর। বিজয়ী হন মুক্তিযোদ্ধারা। ১৯৯১ সালে একবার স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলেও তা ওই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রয়েছে।মুক্তিযোদ্ধা মফিজ উদ্দিন জানান, আমরা দেশকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ করেছি। যেখানে আমাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছে সেখানে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ তো দূরের কথা কোনো পরিকল্পনাও সরকার গ্রহণ করেনি। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ঝালকাঠি জেলার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার দুলাল সাহা বলেন, চাচৈর রণাঙ্গনে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য একটি প্রস্তাব ঝালকাঠি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ হতে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তার কোনো ফলাফল এখনও দেখতে পাচ্ছি না। চাচৈরে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি :মুক্তিযুদ্ধের চাচৈর রণাঙ্গনে অবিলম্বে ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন ঝালকাঠির মুক্তিযোদ্ধারা। সাফল্যের ৪৪ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৩ নভেম্বর সদর উপজেলার চাচৈর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত সমাবেশ, স্মৃতিচারণ ও স্মরণসভায় এ দাবি জানানো হয়। একাত্তরের এ দিনে চাচৈরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলা সম্মুখযুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অন্যদিকে শতাধিক পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর রাজাকার মারা যায়। এ যুদ্ধ ৯ নং সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম সাফল্য হিসেবে পরিচিত। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নথুল্লাবাদ ইউনিট কমান্ডার সৈয়দ মিজানুল হক টুটুল অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। সদর উপজেলা ইউনিটের সহকারী কমান্ডার সৈয়দ মুজিবুল হক সেলিম এবং মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুর রব হাওলাদার, মো. আবদুস সোবাহান, আবদুল মালেক খলিফা, সৈয়দ আবদুল হাই ও হাবিবুর রহমান স্মৃতিচারণে অংশ নেন। চাচৈর যুদ্ধে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ দেলোয়ার হোসেন, মো. আবদুর রাজ্জাক হাওলাদার, মো. সুলতান কবির ও মো. ইউছুফ আলী তালুকদার এবং স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশে স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘ সময় পরেও চাচৈরের ঐতিহাসিক স্মৃতি রক্ষায় সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। পরে চাচৈর যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আউয়ালসহ মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের অমর শহীদদের বিদেহী আত্মার প্রতি শান্তি এবং দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়া-মোনাজাত করা হয়।রাজাপুরে ২৫ শহীদ পরিবারের মানবেতর জীবনযাপন : ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলায় শুক্তাগড় ইউনিয়নের কাঠিপাড়া গ্রামের ঠাকুরবাড়ি গভীর জঙ্গল এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বুদ্ধিজীবীসহ মুক্তিকামী ২৫ জনেরও বেশি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোককে হত্যা করা হয়। রাজাকার-আলবদরদের সহায়তায় নৃশংসভাবে হত্যা করে ওই জঙ্গলে গণকবর দিয়ে রাখে পাকিস্তানি বাহিনী। বর্তমানে এ শহীদদের পরিবারের লোকজন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পরে ২০১০ সালের ৯ এপ্রিল স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ খনন করে শহীদদের বেশকিছু কঙ্কাল উদ্ধার করে। কিন্তু দীর্ঘদিন হলেও গণকবর সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এমনকি শহীদ পরিবারগুলো কোনো ভাতাও পায়নি। এ গণকবরের যেসব শহীদের পরিচয় পাওয়া গেছে তারা হলেন- জিতেন্দ্রনাথ বড়াল, অনুকূল বড়াল, কালিকান্ত মন্ডল, ব্রজেন্দ্র নাথ হালদার, সতীশ চন্দ্র, ক্ষিতীশ চন্দ্র হালদার, ললিত চন্দ্র মন্ডল, যোগেন্দ্রনাথ মিস্ত্রি, কামিনী হালদার, হরিমোহন হালদার, কার্ত্তিক চন্দ্র হালদার, যোগেশ্বর মিস্ত্রি; নৈকাঠি গ্রামের অমরকান্ত নাথ, ধীরেন্দ্রনাথ মিস্ত্রি, সুরেন্দ্রনাথ গায়েন, সূর্য ঘরামি, মধুসুধন, ক্ষেত্রমোহন অধিকারী, কালাচাঁদ, হরলাল চক্রবর্তী ও পার্বতী মিস্ত্রিসহ ২৫ জনেরও বেশি হিন্দু লোককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। জেলার বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই :১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনী অত্যাচার চালায় স্বাধীনতাকামী ঝালকাঠির বিভিন্ন স্থানে। পাকহানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের সাক্ষী ঝালকাঠির বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের অভাবে প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে সারাদেশের সঙ্গে ঝালকাঠি জেলায়ও নির্মাণ করা হয় একটি মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি স্তম্ভ। সেই স্মৃতি স্তম্ভটি নির্মাণের ৬ মাসের মধ্যেই মুছে যায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম। দেশের জন্য আত্মত্যাগী শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় স্বাধীনতার ৪৪ বছর পার হলেও বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ কিংবা কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়নি। বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধকালীন জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আজও রচিত হয়নি। বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে তাদের ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে সেই স্মৃতি আজও সগৌরবে ঘোষণা করে চলছে। ঝালকাঠির বধ্যভূমিগুলোর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সূত্রে কয়েকটি বধ্যভূমির তথ্য পাওয়া গেছে। ঝালকাঠি জেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি ছিল পৌর শহরের সুগন্ধা নদীর পাড়ে। এখানে ১৯৭১ সালের ৩০ মে একদিনেই ১শ ৮ জন বাঙালিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। স্থানটি এক পর্যায়ে সুগন্ধা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও বর্তমানে সে স্থানটিতে চর জেগে উঠছে। চরটি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি বরং সেখানে রয়েছে পৌর কসাইখানা এবং ময়লা ফেলার স্থান। এছাড়া সদর উপজেলার ভিমরুলী বধ্যভূমিতে ৭ জুন ৭ জন বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেখানেও নেই কোনো স্মৃতি চিহ্ন।ডুমুরিয়া বধ্যভূমিতে ১০ জুন ১৯ জন বাঙালিকে হত্যা করা হয়। সে স্থানটি বর্তমানে একটি ক্লাবের দখলে। বেশাইনখান বধ্যভূমিতে ১৭ জুন ১৪ জন বাঙালিকে হত্যা করা হয়। সেখানে বর্তমানে রয়েছে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। রমনাথপুর বধ্যভূমিতে ২১ মে ৫ জনকে এবং ২৩ মে ১৭ জনকে শরীফ বাড়ির মসজিদ থেকে টেনে বের করে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। মসজিদের পার্শ্বে একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণ করা হলেও বর্তমানে তা নিশ্চিহ্ন। সাচিলাপুর গ্রামের বধ্যভূমিতে ২২ জুন স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধা রামাবতী বসুসহ ৬ জন গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এখানেও কোনো স্মৃতি চিহ্ন নেই। রাজপাশা বধ্যভূমিতে ২২ জুন বিভিন্ন স্থান থেকে অগণিত লোককে ধরে এনে জবাই ও গুলি করে হত্যা করা হয়। সেখানে বর্তমানে রোকেয়া খাতুন বালিকা বিদ্যালয়। গুয়াটন বধ্যভূমিতে ২ অক্টোবর মুক্তিকামী কয়েকজন গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়। তারও কোনো স্মৃতি চিহ্ন নেই। খায়ের বধ্যভূমিতে তৎকালীন খায়েরহাট ফজলুল হক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে বিভিন্ন দিনে অনেক লোককে হত্যা করা হয়। শহীদদের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। পালবাড়ি গো-ডাউনঘাট বধ্যভূমিতে বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে একটি ঘাটলার উপর রেখে গুলি ও জবাই করে হত্যা করে। ঘাটলাটি এখনও রয়েছে। কিন্তু বধ্যভূমির কোনো স্মৃতি চিহ্ন নেই। এছাড়াও শহরের পৌরসভা সংলগ্ন ব্রিজ এবং সদর উপজেলার পাঁজিপুঁথিপাড়া, কুতুবকাঠি, শ্রীমন্তকাঠি ও কিস্তাকাঠির চর এলাকা ছিল বধ্যভূমির উল্লেখযোগ্য। রাজাপুর উপজেলার বাঘড়িতে অবস্থিত বধ্যভূমিতে ৩ জুলাই ১০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ অসংখ্য মুক্তিকামী জনতাকে হত্যা করা হয়। নলছিটি পৌর এলাকায় বধ্যভূমিতে ১৩ মে স্বাধীনতাকামী ১৪ জন ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। স্থানটি বধ্যভূমি সংরক্ষণ কমিটির নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সেটি এখন গো-চারণ ভূমি। কাঠালিয়া উপজেলায় বধ্যভূমির সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় নি। ঝালকাঠি হানাদার মুক্ত হওয়ার বর্ণনা :১৯৫২, ৬৬, ৬৯ এবং একাত্তর কোনো আন্দোলনেই পিছিয়ে ছিল না ঝালকাঠি। সেই চেতনার ধারাবাহিকতাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের পর আবারও উদ্দীপ্ত হয় ঝালকাঠিবাসী স্বাধিকার আন্দোলনের আকাঙ্খায়।তৎকালীন কতিপয় সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা ও সংশ্লিষ্টদের দেয়া স্মৃতি নির্ভর তথ্যে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ স্থানীয় পুরাতন স্টেডিয়ামে স্বাধীন বাংলার পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলিত হয়। আর এর পর পরই স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশিত প্রক্রিয়ায় স্থানীয় সকল প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে। পাশাপাশি প্রাথমিকভাবে বরিশাল থেকে সংগৃহীত স্বল্প সংখ্যক রাইফেল ও ক’টি বন্দুক দিয়ে চলে মুক্তিবাহিনী গঠনের কাজ। এতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহায়তা করেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ ও ইপিআর এর সদস্য। এরই এক পর্যায়ে পাকিস্তানি হানাদারদের রুখতে মুক্তিপাগল স্বতঃস্ফূর্ত যুবকের সংখ্যা এতটাই বেড়ে যায় যে কারণে অবশেষে বন্দুকের সাদৃশ্য কাঠের অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ কাজ চালাতে হয়। এভাবেই ছোট ছোট মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়। এর মধ্যে পৃথক পৃথকভাবে একেকটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন সর্বহারা পার্টির সিরাজ সিকদার, সেলিম শাহনাজ, কির্ত্তীপাশা ইউনিয়নের মানিক প্রমুখ।  শেষ পর্যন্ত এই মানিকের নেতৃত্বাধীন ২৪ সদস্যের দলটি স্থানীয়ভাবে মানিকবাহিনী নামে পরিচিত ছিল। এরপর ১ মাস ৪ দিনের মাথায় ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাক হানাদারদের একটি দল গানবোটযোগে এসে প্রচণ্ড গোলাগুলি করে শহর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে প্রথমে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করে। বর্বরদের ভারী অস্ত্রের কাছে টিকতে না পেরে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরাসহ শহরবাসী যে যেভাবে পারছে শহর ছেড়ে আত্মরক্ষার্থে অজানা গন্তব্যে চলে গেছে। কিন্তু এরই মধ্যে পাকহানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেছে অসংখ্য অসহায় লোক। স্থানীয় কতিপয় পদলেহীর পরামর্শে বেছে বেছে কটি বাড়ি ঘর রেখে এককালের ঐতিহ্যবাহী “দ্বিতীয় কলকাতা খ্যাত” ব্যবসায়িক ঝালকাঠি বন্দর জ্বালিয়ে দেয়। যে আগুনের লেলিহান শিখা ১২/১৫ মাইল দূর থেকেও মানুষ দেখতে পেরেছে। এ আগুনের স্থায়িত্ব ছিল টানা ৩ দিন। ফলে পাকিস্তানি বর্বর উন্মত্তদের তাণ্ডবে শত বছরের গড়া ঝালকাঠি বন্দরবাসীর সোনার সংসার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কল-কারখানা পুড়ে ছাই হয়ে মাটিতে মিশে গেছে। ১৬ জুন প্রায় ৫ শতাধিক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় বেশাইনখানের মানিক বাহিনীর ২৪ জনের পুরো দলটিকে ধরে এনে নিষ্ঠুর নির্যাতনের পর অবশেষে হত্যা করে। এভাবেই তথাকথিত শান্তি কমিটির বা পিস কমিটির অথবা পাকিস্তানি দালাল রাজাকারদের সহায়তায় ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত নৃশংস বর্বরতা চালিয়ে গোটা ঝালকাঠির মানুষকে নিঃস্ব করে এবং কল্পনাতীত নিষ্ঠুরতার স্বাক্ষর রাখে পাক হানাদার দস্যুরা। এর মধ্যে ছিল ধর্ষণ, লুটতরাজ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও হত্যা। কালের সাক্ষী হয়ে সুগন্ধা প্রবাহমান থাকলেও তারই করাল গ্রাসে বিলীন সেই বধ্যভূমিটি।  দেশকে শত্রুমুক্ত করার প্রাণপণ এই লড়াইয়ের এক পর্যায়ে ৭ ডিসেম্বর পাকবাহিনী ঝালকাঠির উত্তরাঞ্চলে অভিযান শেষে সুগন্ধা নদী দিয়ে নৌ-পথে বরিশাল যাওয়ার সময় স্থানীয় কাঠপট্টির চরে ৩০ জন রাজাকারকে নামিয়ে দেয়। ওইদিন কতিপয় নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা লাঠি হাতে পিছন থেকে রাজাকার দলটিকে `হ্যান্ডসআপ` বলা মাত্রই রাজাকাররা হাতের অস্ত্র ফেলে দু’হাত উপরে তোলে আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিপাগল মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেললে `টিক্কাখান` নামে পরিচিত আ. বারেক নামের এক রাজাকার প্রতিবাদ করলে বিক্ষুদ্ধ জনতা তার চোখ তুলে ফেলে উল্লাস করে। সন্ধ্যায় টিক্কাখান নামের রাজাকার মারা যায়। ধৃত বাকি রাজাকারদের গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। আর এরই মধ্য দিয়ে রক্তপাতহীন শান্ত পরিবেশ ঝালকাঠি হানাদার মুক্ত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় বীরমুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ। সাবসেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর (বীরউত্তম) :‘৭১ এর মার্চে আমি ছিলাম পাকিস্তানের খারিয়া ক্যান্টনমেন্টে। এ সময় দেখেছিলাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে হাজার হাজার সৈন্যকে বিমানে অথবা জাহাজে করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সৈন্যরা সঙ্গে টাকা-পয়সাও নিচ্ছিলেন। এ সময় আমাদের ইউনিটের কিছু অফিসার পোস্টিং নিয়ে ঢাকায় চলে যান। ঢাকায় থাকা আমার পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবের চিঠির মাধ্যমে জানতে পারলাম ঢাকাসহ অন্যান্য শহরগুলোতে যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ দল-মত-নির্বিশেষে সব বাঙালির ওপর পাকিস্তানিরা হত্যা, গুম, অগ্নিসংযোগসহ নানাভাবে নির্যাতন চালাচ্ছে। ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি অফিসারদের কড়া নজর রাখা হচ্ছিল। এমনকি কে কোন সংবাদপত্র পড়ে, রেডিওতে কে কি শোনে তাও রিপোর্ট হয়ে যাচ্ছিল। তাই আমরা দেশের খবর ভালোভাবে নিতে পারছিলাম না। তারপরও কানাঘুষায় শুনতে পারলাম ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক ভাষণে বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এরপর ২৭ মার্চ বিবিসি রেডিও থেকে জানতে পারলাম, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে একদিন রাওয়ালপিন্ডি ও শেয়ালকোট থেকে কিছু কাজ নিয়ে বাঙালি দুই আর্মি অফিসার বন্ধু আমাদের ক্যান্টনমেন্টে এলেন। তিন বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে পাকিস্তানে আমাদের চাকরি করা ঠিক হবে না। কিন্তু কিভাবে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালাব বুঝতে পারছিলাম না। বাঙালি অফিসারদের ছুটিও দেয়া হচ্ছিল না। আমরা বাঙালিরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরুতেও পারছিলাম না। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। সরকারি ছুটির দিন। এ জন্য আমাদের কিছু সময়ের জন্য বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হলো। সেই সুযোগে আমরা তিন বন্ধু মিলে খাসিয়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে শিয়ালকোটে এলাম। শিয়ালকোট হলো ইন্ডিয়ান বর্ডারের পাকিস্তানের একটি শহর। এখানেও একটি ক্যান্টনমেন্ট আছে। এখানে এসে সন্ধ্যার পর আমরা তিনজন বর্ডার ক্রস করতে রওনা হই। পরদিন ভোরে আমরা ইন্ডিয়ান কাশ্মীরে প্রবেশ করি। সেখানে কয়েকজন ইন্ডিয়ানের সঙ্গে আমাদের দেখা হলো। তাদের বললাম, আমরা পাকিস্তানের আর্মি অফিসার। আমরা বাংলাদেশে স্বাধীনতার যুদ্ধ করতে যাচ্ছি। আমাদের সেখানে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দিতে পারেন? এ কথা শুনে ওই লোকেরা জম্মু ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে খবর দিলো। খবর পেয়ে সেই ক্যান্টনমেন্ট থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি এলো। সন্ধ্যায় ওই ক্যান্টনমেন্ট থেকে আমাদের পাঠানো হলো পাঠানকোট। এরপর সেখান থেকে পাঠানো হলো দিল্লি­। আমরা এক পোশাকেই পাকিস্তান ত্যাগ করেছিলাম। এরপর আমাদের বিমানে কলকাতায় পাঠানো হলো। সেখানে ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে ছিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের হেড কোয়ার্টার। জেনারেল ওসমানীর হেড কোয়ার্টারও ছিল এখানে। ওসমানীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর তিনি ৯ নম্বর সেক্টরে পোস্টিং দিলেন। এ সেক্টর ছিল সাতক্ষীরার হাসনাবাদ, টাকিনগর বলে এক জায়গায়। সেক্টর কমান্ডার হলেন মেজর জলিল। ২১ আগস্ট আমি সেক্টরে এলাম। মেজর জলিল আমাকে পেয়ে খুশি হলেন। আমাকে তিনি বরিশালের অভ্যন্তরে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন। ২৬ আগস্ট ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমি পশ্চিম বাংলার বর্ডার ক্রস করে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। যশোরের পাশ দিয়ে কালীগঞ্জ, তাহেরপুর, টুঙ্গিপাড়া ও পয়সাঘাট হয়ে আমি উজিরপুর এসে ক্যাম্প গঠন করি। আমাদের পেয়ে সেখানকার মুক্তিযোদ্ধারা সাহস পেলেন। ২ সেপ্টেম্বর উজিরপুরের হার্তা এলাকায় পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর বিমান ও গানবোট হামলা করে। মুক্তিযুদ্ধে এখানে আমি প্রথম যুদ্ধ শুরু করি। মিলিটারি একাডেমি থেকে ট্রেনিং নিয়েছি সত্যি, কিন্তু কখনো বাস্তব যুদ্ধ করতে হয়নি। তাই এখানে যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, আমার ঠোঁট-মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। আমার সঙ্গে আসা কিছু সিনিয়র সৈনিক বললেন, স্যার ঘাবড়াবেন না। আপনি শুধু আমাদের পাশে থাকেন। তখন আমি পাকিস্তানের গানবোটগুলো লক্ষ্য করে রকেট লাঞ্চারের গোলা ছুঁড়তে থাকি। একটা গানবোট ওখানেই ধ্বংস হয়ে যায়। সেখানে আমরা ছয়টি লঞ্চ ধ্বংস করতে সক্ষম হই। এছাড়া সেখানে অনেক পাঞ্জাবি ও রাজাকার মারা যায় এবং শত্রু পক্ষের অনেকেই আহত হয়। এতে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস বেড়ে যায়। হার্তায় সফল অপারেশন সম্পন্ন করার পর বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে থাকে একটার পর একটা অপারেশন। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর আমরা ৯ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা বরিশাল শহর দখল করে নিই। বন্দি করি পাঞ্জাবি অফিসার, রাজাকারসহ বেশকিছু পাকিস্তানি সৈন্যকে। এই বন্দিদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী যখন বীরের বেশে বরিশাল শহরে প্রবেশ করছিল, তখন রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত করছিল সর্বস্তরের জনতা। বরিশাল সদর রোডের সেই দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিক পর্যন্ত পুরো রাস্তায় এমনভাবে ফুল ছিটানো হয়েছিল এতে আমার জিপের চাকা এগোতে পারছিল না। এতো ফুল আমি জীবনে দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যদি আমি কখনো বই লিখি তাহলে বইয়ের নাম দেব ‘আমি ফুল দেখেছি’। এসএস/পিআর

Advertisement