টাকা হলে বাঘের চোখও মেলে। তবে বহুল প্রচলিত এ প্রবাদটি মুমূর্ষু করোনা রোগীর জরুরি চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেকটাই মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে! করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ও মৃত্যুর কারণে রাজধানীর সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালেগুলোতে রোগীর চাপ ক্রমশ বেড়েই চলছে। বিশেষ করে করোনায় আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীর সুচিকিৎসার জন্য ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) ভর্তি রেখে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা অত্যাবশ্যক হলেও রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালের আইসিইউ রোগীতে প্রায় পরিপূর্ণ।
Advertisement
অসংখ্য রোগীর স্বজনরা অ্যাম্বুলেন্সে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে হন্যে হয়ে ঘুরছেন। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে রোগীদের ছটফট মরণ যন্ত্রণা দেখে স্বজনরা যত টাকাই লাগুক পরিশোধ করবেন- এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে রোগীকে আইসিইউতে ভর্তি করার আকুতি জানালেও বেড ফাঁকা না থাকায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছে। কোথাও কোথাও দু-চারটি আইসিইউ বেড ফাঁকা থাকলেও রহস্যজনক কারণে রোগী ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা সম্পর্কিত হালনাগাদ (৬ আগস্ট) হেলথ বুলেটিনের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাজধানীর ৪৬টি সরকারি ও বেসরকারি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে ৯০০ আইসিইউ বেডের মধ্যে সর্বসাকুল্যে মাত্র ৯২টি বেড ফাঁকা। সরকারি ১৭টি করোনা হাসপাতালে ৩৮৫টি আইসিইউ বেডের মধ্যে মাত্র ১৭টি বেড ফাঁকা রয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি ২৯টি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে ৫১৫টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ফাঁকা মাত্র ৭৫টি।
সরকারি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল ১৭টি হলেও একটিতে আইসিইউ নেই। ১৬টি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের মধ্যে উত্তরার কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের ২৬টি আইসিইউ শয্যার ২৬টিতে, ৫০০ শয্যার কুর্মিটোলা হাসপাতালের ১০টি শয্যার ১০টিতে, ২৫০ শয্যার শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৬টির মধ্যে ১৬টিতে, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ছয়টির ছয়টিতে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২০টি শয্যার ২০টিতে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০টিতে ১০টি, ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালের চারটির মধ্যে চারটি, জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটও হাসপাতালের ১৫টির মধ্যে ১৫টি, ন্যাশনাল নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটের ৪০টির মধ্যে ৪০টি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের ২০টির মধ্যে ২০টিতে এবং পঙ্গু হাসপাতালের তিনটির বেডের তিনটিতেই রোগীতে পরিপূর্ণ অর্থাৎ সরকারি ১৭টি হাসপাতালের মধ্যে ১১টিতে কোনো আইসিইউ শয্যা খালি নেই।
Advertisement
৩৮৫টি বেডের মধ্যে যে ১৭টি বেড ফাঁকা রয়েছে এর মধ্যে ৫০০ শয্যার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৫টির মধ্যে একটি, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ১৫টির মধ্যে দুটি, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের ৮টির মধ্যে দুটি, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ১০টির মধ্যে তিনটি, মহাখালী ডিএনসিসির ২১২টির মধ্যে ছয়টি রয়েছে।
অন্যদিকে বেসরকারি ২৯টি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের ৫১৫টির মধ্যে মাত্র ৭৫টি বেড ফাঁকা রয়েছে। যে ৭৫টি আইসিইউ বেড ফাঁকা রয়েছে সেগুলো হলো-ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের ২৬টির মধ্যে তিনটি, স্কয়ার হাসপাতালের ২৮টির মধ্যে ছয়টি, এভার কেয়ার হাসপাতালের ২১টির তিনটি, ইমপালস হাসপাতালের ৫৬টির ছয়টি, জাপান ইস্ট ওয়েস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১২টির মধ্যে চারটি, এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪০টির মধ্যে ২৬টি, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৬টির মধ্যে দুটি, শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২২টির মধ্যে ছয়টি, জয়নুল হক সিকদার উইমেন্স মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের ১৬টির মধ্যে দুটি, ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩৩টির মধ্যে ১০টি, বেটার লাইফ হাসপাতালে ২৪টির মধ্যে চারটি, কমফোর্ট হাসপাতালে ৮টির মধ্যে তিনটি, ফেমাস হাসপাতালে আটটির মধ্যে একটি, মিরপুরে বিআইএইচএস হাসপাতাল ১৬টির মধ্যে দুটি, কেরানীগঞ্জে সাজেদা হাসপাতালে ছয়টির মধ্যে দুটি, গণস্বাস্ত্য নগর হাসপাতালে পাঁচটির মধ্যে তিনটি, আল মানার হাসপাতালে ছয়টির মধ্যে তিনটি শয্যা ফাঁকা রয়েছে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বাড়ছে। শুধু আইসিইউ নয়, সাধারণ বেডও দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। আইসিইউতে মুষূর্ষু রোগী ভর্তি হন। চিকিৎসাকালে তারা একেকজন কমপক্ষে সাত দিন থেকে এস মাসও বেডে থাকেন। রোগী সুস্থ কিংবা মারা না গেলে অন্য রোগী ভর্তি করা সম্ভব হয় না। স্বাস্থ্য অধিদফতর হাসপাতালগুলোতে শয্যা বাড়ানোর চেষ্টা করলেও তা সমস্যার সমাধান নয়।’
তিনি জনসাধারণকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি করোনার উপসর্গ দেখা দিলে নমুনা পরীক্ষা ও করোনা শনাক্ত হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শে হাসপাতাল কিংবা বাসায় অবস্থান করে চিকিৎসা শুরু করার পরামর্শ দেন।
Advertisement
করোনা নিয়ন্ত্রণে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু রোধে শতভাগ মানুষকে মাস্ক পরিধানে প্রয়োজনে বাধ্য করতে হবে। নতুবা হাসপাতালে রোগীর ঠাঁই দেয়া সম্ভব হবে না।’
এমইউ/ইএ/জিকেএস