বিশেষ প্রতিবেদন

গণকবরগুলোর চিহ্ন আছে, মর্যাদা নেই

স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য লড়াই-সংগ্রাম তখন চলছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর নিরীহ জনগণ কাউকে রেহাই দেয়নি পাক সেনা ও তার দোসররা। ২৫ মার্চের কালো রাত থেকেই শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ। ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ হয়ে পদ্মা পাড়ি দিয়ে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় প্রবেশ করে হানাদাররা। পাকস্তানী হানাদাররা স্থানীয় দোসরদের নিয়ে চালায় নিরীহ মানুষ হত্যা, নারী ধর্ষণ, অত্যাচার-লুটপাট। মেতে উঠে বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করার মহা উৎসবে। নারী-পুরুষ-শিশু কাউকেই সেদিন ক্ষমা করা হয়নি। ফরিদপুর জেলা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায় ঘাটি গেড়েছিল হানাদাররা। কখনোবা গ্রামে-গ্রামে ঢুকে। আবার কখনো বিভিন্ন জায়গা থেকে হিন্দু-মুসলমানদের ধরে এনে এক সঙ্গে হত্যা করা হয়েছিল। কোথাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে কোথাওবা মরদেহের স্তুপ করে রেখেছিল নরপশুরা। রাজাকার আর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী মানুষ হত্যা করে চলে যাওয়ার পর এলাকাবাসীরা সেই মরদেহগুলোকে একত্র করে মাটি চাপা দিয়েছিল সেদিন। স্বাধীনতার পর সেই স্থানগুলোকে গণকবর হিসেবে চিহ্নিত করলেও রক্ষণাবেক্ষণের তেমন কোনো ব্যবস্থা  হয়নি। ফরিদপুর স্টেডিয়ামের পাশে মহান মুক্তিযোদ্ধের গণকবর নামে একটি জায়গা নির্ধারণ করলেও যথাযথ মর্যাদা হয় না তার। একাত্তরে পাকসেনাদের প্রধান ক্যাম্প ছিল তখন ফরিদপুর স্টেডিয়ামে। স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশে বর্তমান সেটেলম্যান অফিসের নিচতলা পুরুষদের এবং দোতলায় নারীদের রাখা হত। সেখানে অসংখ্য নিরীহ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদে উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালানো হতো। কমসংখ্যক লোকই সেখান থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন। অধিকাংশকেই অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে স্টেডিয়ামের পূর্ব পাশে একটি গর্তের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়। ফরিদপুরের জেলা কমান্ডার আবুল ফয়েজ শাহ্ নেওয়াজ জাগো নিউজকে জানান, স্বাধীনতার পরে স্টেডিয়ামের অভ্যন্তরে একটি বধ্যভূমি আবিস্কৃত হয়। সেখান থেকে মানুষের হাড়-গোড়, কঙ্কাল, মাথার খুলি, নারীদের শাড়ি-কাপড়ের পঁচা টুকরা এবং শাঁখা-চুড়ির সন্ধান মেলে। জায়গাটি দীর্ঘদিন অরক্ষিত ছিল। ফরিদপুর মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন বাবুলসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার উদ্যোগে ৪ মিটার দৈর্ঘ্য এবং তিন মিটার প্রস্থ স্থানটি ছয় সেন্টিমিটার উঁচু লোহার রেলিং করে রক্তলাল রঙ দিয়ে গণকবরের স্মৃতি চিহ্ন রাখা হয়। সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রতি বছর ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর শহীদদের স্মরণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। ফরিদপুর স্টেডিয়ামটি বড় করায় পূর্বের স্থান থেকে গণকবরের স্থানটি কয়েক`শ গজ দুরে পুনস্থাপন করা হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের গণকবর নামে স্তম্ভটি চারপাশের নোংড়া আবর্জনা আর গাছ-পালায় ঢাকা পড়ে থাকে। গণকবরের পেছনে বাসা-বাড়ি থেকে ময়লা আবর্জনা ফেলে নর্দমা সৃষ্টি হয়েছে। দর্শনার্থীদের যাতায়াতের রাস্তা খুব সংর্কীর্ণ ও জঙ্গলে ভরা। বছরের কয়েকটি দিন বাদে গণকবরটির সঙ্গে ঘেষে থাকা গাছপালা আর পশুপাখির বিষ্ঠায় নোংরা আবর্জনায় স্তুপ হয়ে থাকে। এই দৃশ্য শহীদের মর্যাদাকে ম্লান করে দেয় বলে জানান অনেক দর্শনার্থী।গণকবরের ওই স্থানটি যদি সুন্দর করে পরিকল্পিতভাবে ইতিহাস সংরক্ষণের প্রদর্শনী স্থান করা হয়। তাহলে শহীদদের প্রতি যথাযথ মর্যাদা হবে এবং দেশের জন্য তাদের ত্যাগ স্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে মনে করেন অনেকে।অপরদিকে, ফরিদপুর জেলার বাকি গণকবরগুলোর মধ্যে ব্যক্তিগত চেষ্টায় কোথাও কোথাও ইট, সিমেন্ট আর টাইলস লাগানো হয়েছে চিহ্নটি ধরে রাখতে। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও এখনো পর্যন্ত কিছু গণ কবরের ইতিহাস থাকলেও কোনো প্রকার স্মৃতি চিহ্ন ধরে রাখার কাজ আজ পর্যন্ত হয়নি। সুন্দর ও আকর্ষণীয় কোনো কিছুর ছোঁয়া লাগেনি সেই জায়গাগুলোতে। বিভিন্ন এলাকার গণকবরগুলোর কাহিনী লোকমুখে শোনা গেলেও আগামী প্রজন্ম হয়তো তার চিহ্ন পাবে না। তাই দ্রুতই এই স্মৃতিকথা আর চিহ্নকে ধরে রাখা জরুরি বলে মনে করেন অনেকে। পাকহানাদার বাহিনী একাত্তরের ২১ এপ্রিলে ফরিদপুর জেলা শহরের প্রবেশমুখে শ্রী অঙ্গনে কীর্তনরত আট সাধুকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী কান্তি বন্ধু ব্রহ্মচারী জাগো নিউজকে বলেন, শ্রী জগদ্বন্ধু সুন্দরের স্মৃতিবিজড়িত শ্রী অঙ্গন আশ্রমে হামলা চালায় পাকবাহিনী। আশ্রমে ঢুকে কৃর্তনরত আট সাধুকে চালতা তলায় দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। কয়েক বছর আগে ব্যক্তি উদ্যোগেই সেখানে নিহত আট সাধুর নাম লিখে আটটি কালো স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু সরকারিভাবে আজ পর্যন্ত সেখানে গণহত্যার কোনো স্মৃতিফলক তৈরি করা হয়নি। একাত্তরের সেই ইতিহাসকে ধরে রাখতে শ্রী অঙ্গনের ওই জায়গাটিতে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণসহ নিহতদেরকে শহীদী মর্যাদার দাবি জানান ফরিদপুরবাসী ও মুক্তিযোদ্ধারা।হানাদাররা ফরিদপুরে প্রথম পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ চালায় ঈশান গোপালপুর জমিদার বাড়িতে। ফরিদপুর শহর থেকে দশ কিলোমিটার দূরে ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীদাস হাটের পাশে জমিদার শ্রী ক্ষিতীশ চন্দ্র সরকারের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। সেখানে আশ্রয় নেয়া ২৮ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনীরা। স্থানীয় রাজাকার জব্বার ও দরা’র সহযোগীতায় ১৯৭১ সালের ২রা মে বিকাল বেলায় পাকাসেনারা জমিদার বাড়ীতে গিয়ে গণহত্যা চালায়।  পাকসেনারা চলে যাওয়ার পর এলাকাবাসী জমিদার বাড়ির পুকুর পাড়ে ২৮ জনের মরদেহ মাটিচাপা দিয়ে রাখে।জেলার বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং নিহত পরিবারের সদস্য শ্রী জগদিশ চন্দ্র ঘোষ জাগো নিউজকে জানান, যুদ্ধের দীর্ঘদিন পরও গণকবরটি সংরক্ষণ করার কোনো উদ্যোগ কেউ নেয়নি। পরে ২০১০ সালের ২ মে শহীদ পরিবারের সদস্যরা ও এলাকাবাসীরা মিলে নিহত ২৮ জনের নাম ফলকসহ একটি স্মৃতিফলক তৈরি করে চিহ্নটি ধরে রাখে।  ঈশান গোপালপুর ইউপি চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান চৌধুরী পংকজ জাগো নিউজকে জানান, জমিদার বাড়ির গণকবরটি স্থানীয়ভাবে কিছুটা চিহ্ন ধরে রাখলেও নিহতদের স্মৃতির প্রতি মর্যাদা দেখানোর মতো সরকারিভাবে কোনো কার্যক্রম এ পর্যন্ত নেয়া হয়নি। আমাদের দাবি এতো বড় জঘন্য গণহত্যার ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে। তাই গণকবরটি রক্ষণাবেক্ষণ ও নিহতদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করার ব্যবস্থা করা হোক। তাহলেই স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস অক্ষুন্ন থাকবে বলে তার বিশ্বাস। উক্ত জমিদার পরিবারের সদস্য বাবু উৎপল সরকার জাগো নিউজকে জানান, গণকবরগুলো মর্যাদার সঙ্গে টিকিয়ে রাখতে সরকার যদি উদ্যোগ নেয় তবেই ১৯৭১ সালের ইতিহাস আগামী প্রজন্মের কাছে বেঁচে থাকবে। তাই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে গণকবরের ইতিহাস জানাতে স্বশরীরে ঘটনাস্থলগুলো পরিদর্শনে উদ্বুদ্ধ করাসহ উৎসাহ যোগানো উচিত। তাহলেই যুদ্ধের স্মৃতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বেঁচে থাকবে।স্থানীয় রাজাকার ও আলবদরের সহয়তায় পাকসেনারা জেলার সদর উপজেলার মাচ্চর ইউনিয়নের বাকচর গ্রামে ১১জন নিরীহ মানুষকে বাড়ি থেকে ধরে এনে হত্যা করে। পরে মরদহেগুলোকে রাস্তার পাশে এনে মাটিচাপা দেন এলাকাবাসী। নিহতদের স্মরণে আজও সেখানে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলা হয়নি। সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শাসসুদ্দিন মোল্লা জাগো নিউজকে জানান, তার বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরেই এই গণহত্যার ঘটনাটি ঘটে। এখন পর্যন্ত সেই স্থানটিতে কোনো স্মৃতিফলক না থাকায় নতুন প্রজন্মের অনেকেই এই ইতিহাসটি সম্পর্কে জানেন না। আজ যদি সেখানে একটি গণকবরের স্মৃতিফলক থাকতো তাহলে সেই জঘন্য হত্যার ইতিহাস সবাই মনে রাখতেন।  যশোর সেনানিবাস থেকে মেজর নেওয়াজের নেতৃত্বে তিন শতাধিক পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঢুকে পড়ে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার হাসামদিয়া ও রাজাপুর রামনগর গ্রামে ঢুকে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারী ধর্ষণ শুরু করে। ১৬ মে বোয়ালমারীতে সেদিন ৩৩ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। আজও সেখানে শহীদদের স্মরণে সরকারি উদ্যোগে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলা হয়নি। তৎকালীন মুজিব বাহিনীর কমান্ডার শাহ মো. আবু জাফর জাগো নিউজকে জানান, একাত্তরের গণহত্যায় শহীদ পরিবারের সদস্যরা আজও কোনো রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও স্বীকৃতি পাননি। আমরা ব্যক্তি উদ্যোগে ৩৩ জনের নামফলক নির্মাণ করি। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকাবস্থায় নিহত পরিবারদেরকে তিনি দুই হাজার করে টাকা দিয়েছিলেন, পরে আর কেউ খোঁজ নেননি।১৯৭১ সালের মে মাসের দিকে নগরকান্দা উপজেলার কোদালিয়া গ্রামে গণহত্যা চালায় স্থানীয় দোসর ও পাক সেনারা। সেদিন ১৮ জন নারীসহ ৩৭ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেসময় আরো চারজনকে ঘরের মধ্যে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। ৯৬ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোদালিয়া শহীদ নগরে গণকবরের স্মৃতি ফলকটি উদ্বোধন করে যান। গণকবরের স্মৃতি স্তম্ভটিতে এখন শ্যওলা পড়ে গেছে। চত্বরটিতে ধান-পাট শুকানোসহ নোংরা করে রাখা হয় বলে অভিযোগ অনেকের। তাই স্মৃতিস্তম্ভটি আরও আকর্ষণীয় ও নান্দনিক করার দাবি উপজেলাবাসীর।এমজেড/এমএস

Advertisement