জাতীয়

দুই বছরের মধ্যে সবচেয়ে পরিষ্কার পানি বুড়িগঙ্গায়

করোনাভাইরাসের নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টে দিশেহারা সারাবিশ্বের মানুষ। টিকা আবিষ্কারের পরও সংক্রমণ কমছে, লাগাম টানা যাচ্ছে না মৃত্যুর। নিজেকে বাঁচাতে মানুষ এখন ঘরবন্দি। কল-কারখানা, যানবাহন চলাচল সবকিছুতে স্থবিরতা বিদ্যমান। এই সুযোগে নিজেকে দেখবার জো হয়েছে প্রকৃতির। বিধিনিষেধে কল-কারখানা বন্ধ থাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর পানি আগের চেয়ে উন্নতি হলেও গৃহস্থালির বর্জ্যে দূষণ যেন থামছেই না।

Advertisement

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্টামফোর্ডের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণায় উঠে এসেছে নদীর খবরাখবর। তাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, বুড়িগঙ্গার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন বেড়েছে।

বুধবার ক্যাপস’র পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদারের নেতৃত্বে বুড়িগঙ্গা নদীর বসিলা ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা থেকে শুরু হয়ে পুরান ঢাকার সোয়ারিঘাট পর্যন্ত গবেষণা কার্যক্রম চালানো হয়। বসিলা ব্রিজ থেকে সোয়ারিঘাট পর্যন্ত নদীর সাতটি স্থানের পানি পরীক্ষা করে দেখা হয়।

বসিলা ব্রিজ সংলগ্ন নদীর পানিতে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান, দ্রবীভূত অক্সিজেন, পিএইচ মাত্রা, দ্রবীভূত অন্যান্য পদার্থ, প্লাস্টিকসহ অন্যান্য পদার্থ তুলনামূলকভাবে অনেকটাই কম পায় ক্যাপস।

Advertisement

বসিলা ব্রিজ থেকে যত পুরান ঢাকার দিকে এগিয়েছে গবেষণায় দূষণের মাত্রা ততই বাড়তে দেখা গেছে। মানুষের ঘনবসতি যেদিকে বেশি নদীতে দূষণের মাত্রা সেখানে বেশি পাওয়া যায়। বাসা-বাড়ির সাবান ও ডিটারজেন্টের কারণে পানির বাড়ন্ত ক্ষার, গৃহস্থালি বর্জ্য আর পয়ঃবর্জ্যে নদীর বেহাল দশা দেখতে পায় গবেষক দল।

ক্যাপস জানায়, ২০১৯-এর ডিসেম্বর এবং এপ্রিল ২০২০-এর তুলনায় আগস্ট ২০২১-এ বুড়িগঙ্গার পানির মান ভালো হয়েছে। পানির মান নির্ণয়ে অন্যতম একটি নির্দেশক হচ্ছে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন। ২০১৯-এর ডিসেম্বরে বুড়িগঙ্গার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের গড় মান ছিল প্রতি লিটারে ১ দশমিক ৭ মিলিগ্রাম, যা ২০২০ সালে ছিল ১ দশমিক ৮। যেটা বাংলাদেশের আদর্শ মাত্রার চেয়ে প্রায় তিন থেকে চারগুণ কম।

অন্যদিকে ২০২১ সালে প্রতি লিটার পানিতে গড় দ্রবীভূত অক্সিজেন পাওয়া গেছে ৪ দশমিক ২৬ মিলিগ্রাম। অর্থাৎ দুই বছরের ব্যবধানে বুড়িগঙ্গার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মান প্রায় দুই দশমিক ৫ গুণ ভালো পাওয়া গেছে। ক্যাপস প্রতিবছর শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদীর পানির মান পর্যবেক্ষণ করে আসছে।

সংস্থাটি আরও জানায়, বুড়িগঙ্গার পানিতে ২০১৯ ও ২০২০ সালে পানির ঘোলাত্বের মানও আদর্শমানের চেয়ে প্রায় এক থেকে তিনগুণ খারাপ ছিল। তবে ২০২১ সালে এসে পানির ঘোলাত্বের মানের বেশ উন্নতি হয়েছে। আগস্টে বুড়িগঙ্গার পানিতে গড় ঘোলাত্বের পরিমাণ প্রতি লিটারে ৫ এনটিইউ, যা আদর্শমানের (১০ এনটিইউ) মধ্যে রয়েছে। বুড়িগঙ্গার পানি গত দুই বছরে তিন থেকে চারগুণ বেশি পরিষ্কার হয়েছে।

Advertisement

ক্যাপস আরও জানায়, ২০২১-এর পর্যবেক্ষণে বেশিরভাগ স্থানে পানিতে দ্রবীভূত বস্তুকণার (টিডিএস) উপস্থিতি কম পরিলক্ষিত হলেও পুরাতন বুড়িগঙ্গা চ্যানেলে ৬০০ পিপিএম পাওয়া যায়, যা চলতি বছরসহ গত দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। উল্লেখ্য, টিডিএস’র আদর্শমান ১০০ পিপিএম।

গবেষক দলের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, পানিতে গন্ধ নেই বললেই চলে। যেসব স্থানে পয়ঃবর্জ্য নিষ্কাশনের লাইন রয়েছে সেখানে আগের মতো দুর্গন্ধ অনুভব হয়। এমন একটি স্থান হলো আশরাফাবাদ পয়েন্ট থেকে কিছু আগে। সেখানে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ছিল প্রতি লিটারে মাত্র ২.৮ মিলিগ্রাম, পিএইচ মান ৯ অর্থাৎ পানি ক্ষারীয়। ধারণা করা হয়, বাসা-বাড়ি থেকে আসা পানিতে সাবান ও ডিটারজেন্টের উপস্থিতির কারণে পানি ক্ষারত্ব লাভ করে। এছাড়াও ওই জায়গার পানিতে ঘোলাত্ব ও ভাসমান বস্তুকণার উপস্থিতি অন্যান্য জায়গার চেয়ে বেশি পেয়েছে গবেষক দল। তবে ২০১৯ ও ২০২০ এর তুলনায় পানির মান ভালো পেয়েছেন তারা।

ফাইল ছবি

ক্যাপস মনে করে, বুড়িগঙ্গার পানির উন্নতির কারণ হলো- যেসব শিল্প-কারখানা নদী দূষণের জন্য দায়ী, করোনার উদ্ভূত পরিস্থিতিতে লকডাউনের কারণে বেশিরভাগ কারখানায় কাজের উৎপাদন কম ছিল। এছাড়া বর্ষাকাল হওয়ায় দূষণের পরিমাণ কম ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।

স্টামফোর্ড বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদারের নেতৃত্বে বুড়িগঙ্গা নদীর বসিলা ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা থেকে গবেষণা কাজ শুরু হয়। এর উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল।

গবেষক দলের প্রধান ও ক্যাপস’র পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, করোনা মহামারির পাশাপাশি প্রতি বছর বিভিন্ন দূষণের কারণে অনেক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। দূষণের কারণে মারা যাচ্ছে নদী। তেমনি একটি মৃতপ্রায় নদী বুড়িগঙ্গা। এক সময় ঢাকার চারপাশের নদীগুলো ছিল ঢাকার সৌন্দর্যের কেন্দ্রভূমি কিন্তু বর্তমানে দূষণের ফলে এগুলো স্বাস্থ্যহানির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি আরও বলেন, মানুষের শরীরের মতো বুড়িগঙ্গা নদীর শরীরে বেশ কিছু টিউমার ও ক্যান্সার রয়েছে। নদী দখল হচ্ছে টিউমার আর ক্যান্সার হচ্ছে কল-কারখানার বর্জ্য নিষ্কাশনের লাইন দিয়ে প্রবাহিত দূষিত তরল। তরল বর্জ্যের দূষণ ক্যান্সারের মতো পুরো নদীতে ছড়িয়ে পড়ে। দখল যদি দূর করা যায় তাহলে দূষণ অনেকাংশে কমে আসবে। বর্তমানে লকডাউন ও বর্ষা মৌসুম হওয়ার কারণে নদীর পানির মানের বেশ উন্নতি হয়েছে। তবে যেসব পয়েন্টে বর্জ্য লাইন এসে মিলিত হয় সেসব জায়গার মান আগের মতোই পরিলক্ষিত হয়েছে।

তিনি বলেন, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ২ দশমিক ৫ গুণ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পানিতে মিশ্রিত লবণাক্ততার পরিমাণ আগের চেয়ে কমেছে। পানিতে ভাসমান বিভিন্ন ধরনের বস্তুকণার পরিমাণ গত বছরের তুলনায় কমেছে এবং অন্যান্য বছরের তুলনায় পানির রং অনেকটা ভালো। অন্যদিকে অন্যান্য বছরের তুলনায় গন্ধের পরিমাণও কম ছিল।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম-সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, নদী একটি জীবন্ত সত্তা এবং এর জন্য একজন অভিভাবক রয়েছে। যার নাম জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন কিন্তু নদীর পানির স্বাস্থ্য দেখার মতো কেউ নেই। দূষণের কারণে নদীতে এখন আর মাছ পাওয়া যায় না কিন্তু একটা সময় বুড়িগঙ্গা নদীর মাছ ধরে অনেক মানুষের সংসার চলত।

তিনি আরও বলেন, ঢাকার চারপাশের পাঁচটি নদীকে রক্ষা করতে হবে। নদী পর্যবেক্ষণের জন্য নির্ধারিত অভিভাবক জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং নদী রক্ষা আইনকে শক্তিশালী করতে হবে।

ক্যাপস’র গবেষণা পর্যবেক্ষণ প্রধান আব্দুল্লাহ আল নাঈম বলেন, বুড়িগঙ্গা নদীর পানির মান ভালো করার জন্য গবেষকদের ভূমিকা অপরিসীম। একই সঙ্গে সরকারের পূর্ণ সহায়তা ও সদিচ্ছার মাধ্যমে নদীর পানির মান আরও ভালো করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, নদীর পানির মান ভালো করতে চাই বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করা। আর এজন্য প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। ক্যাপস’র মতো পরিবেশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত গবেষণাগুলো নদীমাতৃক দেশের নদীর পানির আয়তনের কাছে অতি নগণ্য।

ক্যাপস মনে করে, নদী ও নদী পাড় হতে অবৈধ দখল উচ্ছেদ, শিল্প বর্জ্যের জন্য ইটিপি/সিইটিপি ব্যবহার, ত্রুটিপূর্ণ নৌযান মেরামত ও নৌযানে পয়ঃপ্রণালীর আধুনিকায়ন, নদীতে পৌর বর্জ্য ছাড়ার আগে স্ক্রিনিং পদ্ধতিতে কঠিন বর্জ্য অপসারণ ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমেই বুড়িগঙ্গার আগের রূপ ফিরে পাওয়া যাবে।

এসএম/এআরএ/এমএস